স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৫৯

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০২১

দীর্ঘ সময় ব্যয় করে মেগা সিরিয়াল ‘সুলতান সুলেমান’ দেখলাম। নাটকটি মূলত উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়কালব্যাপী রাজত্ব বিস্তারকারী উসমানীয় সম্রাট প্রথম সুলাইমান এবং তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী হুররাম সুলতানের জীবনগাঁথার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের লেখাজোখায় তুরস্ককে পাওয়া যায়। তাঁর একজন পাঠক হিসেবে তুরস্ক বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে। সেই তুরস্কের সম্রাট ছিলেন সুলেমান, যাঁর সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। টিভি সিরিয়াল কখনো ইতিহাস হতে পারে না, তবে ইতিহাসের বিস্তর উপাদান থাকে সিরিয়ালে। মূলত সে কারণেই দেখা। এই সিরিয়ালে তিন মহাদেশের ইতিহাসের কিছু কিছু বিষয় রয়েছে, যা ইতিহাসের পাঠকে সুসংহত করে।

সিরিয়ালটি দেখে মনে হলো, একটি মহাকাব্যের দৃশ্যরূপ দেখেছি। রাজরাজড়াদের জীবন নিয়েই আসলে মহাকাব্য হয়। পৃথিবীর মহাকাব্যগুলো তাই। দেবতা, রাজা ও রাজপুত্ররাই প্রধান চরিত্র। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে মহাকাব্য হয়নি। হবেও না। হয়েছে উপন্যাস। উপন্যাস মহাকাব্যের বংশধর। পুত্র বলা যেতে পারে। ধরা যাক দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’। এটা মহাকাব্য। ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’কেও মহাকাব্য মনে করি। মার্কেসের ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিসিউড` তো মহাকাব্যই। সমগ্রতাবিস্তারী প্রত্যেক উপন্যাসই আসলে মহাকাব্যের পুত্র।

সুলতান সুলেমান যে শুধু সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন তা নয়, সাম্রাজ্যের সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক প্রণালীও তৈরি করেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরা তা অনুসরণ করেছেন। আধুনিক তুরস্কেও তার কিছু অনুসরণ করা হয়। এই কারণে সুলতান সুলেমানকে ‘সুলেমান আল কানুনি’ বা ‘আইন প্রণেতা’ হিসেবে তাকে ডাকা হয়। তার সম্রাজ্যে মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করতে পারত। কেউ তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে তাকে পেতে হতো কঠোর শাস্তি।

বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উন্নয়ন ঘটেছিল সুলতান সুলেমানের আমলে। তাঁর সময়কে ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবেও আখ্যা দেন ঐতিহাসিকরা। সুলেমান নিজে কবিতা লিখতেন। ‘মুহিব্বি’ নামে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। ‘মুহিব্বি’ অর্থ প্রেমিক। প্রেমই ছিল তাঁর কবিতার বিষয়। পারস্যের কবি জালালুদ্দিন রুমির ভক্ত ছিলেন তিনি এবং মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিক মুহিউদ্দিন আল আরবি প্রমুখ দার্শনিকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাঁর সময়ে স্থাপত্যকলার উৎকর্ষও ঘটেছিল।

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা অন্ধকার দিক থাকে। যতই ন্যায়পরায়ণ হোন না কেন, সম্রাট সুলেমানেরও অন্ধকার দিক ছিল। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কাছের মানুষদের হত্যা করে তিনি নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে হত্যার আদেশ দেন উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশাকে, যিনি ছিলেন সুলতানের বাল্যবন্ধু, উপদেষ্টা। হত্যা করেন বড়পুত্র শাহজাদা মুস্তাফাকে। হত্যার আদেশ দেন পুত্র বায়েজিদকেও। পরে যাকে চারপুত্রসহ ভাই সেলিম হত্যা করে।

শাহজাদা মুস্তাফা হত্যাকাণ্ড এতই নির্মম যে, মনে হয়েছে, পৃথিবীতে দুটি পুত্রহত্যার ঘটনা বড় নির্মম। একটি ঘটেছিল পারস্যে, ফেরদৌসির ‘শাহনামা’য় আমরা তা দেখি। পিতা রুস্তম হত্যা করেছিল সোহরাবকে। আরেকটি তুরস্কে। পিতা সুলেমান হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন পুত্র মুস্তাফাকে। দুটি হত্যাকাণ্ড বড় বেদনাদায়ক।  ক্ষমতালিপ্সার কারণেই বুঝি তিনি এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিলেন।

কিংবা ক্ষমতালিপ্সা নয়। একজন সুলতান যখন দেখবেন তার পুত্রের জনপ্রিয়তা তার চেয়ে বেশি এবং তার কানে যদি খবর আসতে থাকে সেই পুত্র বিদ্রোহ করতে পারেন, তাহলে তখন সেই ব্যক্তি কিন্তু বাবা হিসেবে সিদ্ধান্ত নেন না, সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট হিসেবে। সাম্রাজ্য সুরক্ষার জন্য তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। মুস্তাফার জনপ্রিয়তা খুব বেশি ছিল। সেনাসদস্যরা পছন্দ করত তাকে। বিদ্রোহ সংগঠনের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু মুস্তাফা পিতার অবাধ্য হতে চাননি। না চাওয়াটাই ছিল তার কাল। বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে গিয়ে পিতার আদেশে পিতার সামনে জল্লাদবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন।

অটোমানদের আমলে উত্তরাধিকার নিয়ে যাতে কোনো সমস্যা তৈরি না হয় সেজন্য ছিল বিধিবদ্ধ ‘ভাতৃহত্যা আইন’। সুলতান সুলেমানের আগেই আইনটি তৈরি করা ছিল। সাম্রাজ্য যাতে হুমকির মুখে না পড়ে বা স্থায়িত্ব কম না হয়, সে কারণে আইনটি করা হয়েছিল। সে আইনে শুধু ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ভাই ও সন্তানদের হত্যা করা যেত। এটি একটি অমানবিক আইন। সেই আইনের চর্চা সুলতান সুলেমান নিজেও করেছেন তাঁর সাম্রাজ্য ও ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য। এটা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি ছিল তাঁর অন্ধকার দিক।

সিরিয়ালটি দেখলে বোঝা যায় সম্রাটরা কতটা নিঃসঙ্গ। এত বড় সাম্রাজ্যের অধিপতি সুলতান সুলেমান, অথচ তিনি ভয়াবহ নিঃসঙ্গ। হাসেকি সুলতান হুররাম, যাকে দাসী থেকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করেছিলেন, তিনি সুলতানের আড়ালে যাবতীয় কূটিলতা করে যাচ্ছেন, অথচ সুলতান কিছুই জানতে পারেন না। পরবর্তীকালের উজিরে আজম রুস্তম পাশা হুররামের সঙ্গে মিলে যাবতীয় ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন, অথচ সুলতান কিছুই জানেন না। তাঁকে কিছু জানতে দেওয়া হয় না। এই নিঃসঙ্গতার বেদনা শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

সিরিয়ালটি নিয়ে বির্তকও আছে। তুর্কি সুলতান সুলেমানকে ‘অসম্মানিত’, ‘অশ্লীল’ ও ‘ফূর্তিবাজ’ হিসেবে চিত্রায়িত করার অভিযোগ তুলেছিল তুরস্কের কিছু দর্শক। তুরস্কের সর্বোচ্চ বেতার ও টেলিভিশন পরিষদ আরটিইউকে দাবি করেছিল যে তারা সিরিজটির বিরুদ্ধে ৭০ হাজার অভিযোগ পেয়েছে এবং একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের গোপনীয়তাকে ভুলভাবে প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সিরিজটিকে সতর্ক করে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তাইয়িপ এরদোয়ান ধারাবাহিকটিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের ইতিহাসকে নেতিবাচক আলোকে প্রদর্শন করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে নিন্দা করেন। ইসলামপন্থি এবং জাতীয়তাবাদীদের কিছু ক্ষুদ্র দল স্টুডিওর সামনে প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। তবুও সিরিজটি আশানুরূপ উচ্চমানের  রেটিংসহ সফলভাবে চলমান ছিল।

রাজনীতি সম্পর্কে যাদের আগ্রহ আছে, ইতিহাস বিষয়ে যারা কৌতুহলী, তারা সিরিয়ালটি দেখতে পারেন। ভালো লাগবে। রাজনীতি কতটা ভয়াবহ, কতটা কূটিলতা আর ষড়যন্ত্রে ভরা থাকে, তা বোঝা যাবে সিরিয়ালটি দেখে। সিরিয়ালটি দেখতে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল Nasrin Nazu. ইউটিইউবে রয়েছে। চলবে