মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৬১

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০২২

আড়াইশো পৃষ্ঠার মহুয়ার ঘ্রাণকে ‘ছোট্ট উপন্যাস’ বলায় কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কমলকুমার শিষ্য হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবল আপত্তি। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একজন কথাসাহিত্যিক ২৫০ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাসকে বলেছেন ছোট্ট উপন্যাস। বড় উপন্যাস বলতে তিনি হয়তো পৃষ্ঠা সংখ্যা বোঝেন! ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ‘বড়ো’ উপন্যাস তিনি লিখেছেন। শ্রী হীরন্ময় ক্ষোভের সঙ্গে আরও লিখেছেন, ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস কিছুই শিক্ষা দিতে পারেননি পরবর্তী প্রজন্মকে।

শ্রদ্ধেয় হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের সদয় অগতির জন্য, ফেসবুক হচ্ছে একটি হাট। হাটে কত ধরনের শব্দই তো উচ্চারিত হয়। আপনি যদি সেসব শব্দের প্রতিটিকে ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ’ ধরে বসে থাকেন, তবে তো বিরাট সমস্যা। আমি পৃষ্ঠা সংখ্যা দিয়েই বড়-ছোট বোঝাতে চেয়েছি। এই ‘ছোট’ আয়তনের দিক থেকে ছোট, অবশ্যই শিল্পমানের দিক থেকে নয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আয়তনে ছোট, কিন্তু শিল্পমানে বড়। যেমন হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান ইন দ্য সি’, আলবেয়ার কামুর ‘আউটসাইডার’, জর্জ অরওয়েলের ‘এনিমেল ফার্ম’, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘দ্য ক্রনিকল অব আ ডেথ ফোরটোল্ড’ কিংবা ‘আমার স্মৃতির বিষাদ গণিকারা’ আয়তনে ছোট হলেও শিল্পমানে বড়।

দেবেশ রায়ের ছোট আয়তনের উপন্যাস ‘খরার প্রতিবেদন’, ‘মফস্বলী বৃত্তান্ত’কেও শিল্পমানে বড় উপন্যাস মনে করি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’র কথা নাই-বা বললাম। এমন বিস্তর উপন্যাস আছে, যেগুলো আয়তনে ছোট, কিন্তু শিল্পমানে বড়। হিরন্ময় গঙ্গোপাধ্যায়ের বড় আক্ষেপ, ‘ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াস আমাদের কিছুই শিক্ষা দিতে পারেননি।’ জনাব হিরন্ময়, শিক্ষা কেবল আমরা ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াসের কাছ থেকে নিইনি, পৃথিবীর বড় বড় ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকেও নিয়েছি। কমলকুমারকে গ্রহণ করেছি, কিন্তু তাঁর মধ্যে আটকে থাকিনি, আপনি যেমন আটকে আছেন, আপনি যেমন কমলকুমার নামক দাঁড়িপাল্লা দিয়ে পৃথিবীর সব সাহিত্যকে বিচার করেন। ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াসকে শ্রদ্ধার আসনে রেখেছি, কিন্তু তাঁদের শিল্পতত্ত্বকে, তাঁদের রচনাকৌশলকে সর্বোতভাবে গ্রহণ করিনি। গ্রহণ করার দরকার মনে করি না। কেননা প্রত্যেক ঔপন্যাসিকের পথ আলাদা। যে পথে হেঁটে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, একই পথে মানিক হাঁটার প্রয়োজন মনে করেননি। যে পথে হেঁটে গেছেন কমলকুমার, একই পথে সুনীল গাঙ্গুলি হাঁটার দরকার মনে করেননি।


আমাকে উদ্দেশ্য করে আপনার মন্তব্য, “একটা লেখা পড়েছি স্বকৃত নোমানের, ইমপ্রেস করেনি। বাক্যগঠন দুর্বল। অনুশীলনের আগেই বহুপ্রসব শুরু হয়ে গেছে।” আপনার এই মন্তব্য নিয়ে আমার বিশেষ কোনো মন্তব্য নেই। কেননা পৃথিবীর সকল পাঠককে ইমপ্রেস করার মহান দায়িত্ব নিয়ে আমি লিখতে আসিনি, লিখি না। সেই দায়িত্ব স্বয়ং কমলকুমারও নিয়েছিলেন কিনা সন্দেহ। তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, কাফকা, কামু, জোলা, মার্কেসও নেননি। মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর, দেবেশও নেননি। তবে, আমি নিশ্চিত, আপনি আমার কোনো উপন্যাস পড়েননি। পড়েছেন কোনো ফেসবুক পোস্ট। সেই পোস্টকেই আপনি সম্ভবত মহান সাহিত্যকর্ম ভেবে বসে আছেন এবং সেই দাঁড়িপাল্লা দিয়েই আমার বিচার করে রায় ঘোষণা করে দিয়েছেন।

আপনার মতে, “একজন লেখক সবসময়ই সিরিয়াস। তাঁর ছোট ছোট মন্তব্যগুলিও তাঁর মনের প্রকাশ।” অর্থাৎ ফেসবুকে আমরা যা কিছুই করি না কেন, সবই সিরিয়াস, সবই মৌলিক হতে হবে। হাসি-ঠাট্টা করা যাবে না, ইয়ার্কি-ফাজলামো করা যাবে না। ওহে দাদা, ফেসবুকে সবসময় এত সিরিয়াস হয়ে থাকা অন্তত আমাকে দিয়ে হবে না। সিরিয়াস আমি টেক্সটে, গল্পে, উপন্যাসে। ফেসবুক হচ্ছে একটি নদী, যে নদীতে স্বচ্ছ জল যেমন আছে, তেমনি আছে ময়লা-আবর্জনাও। আপনি যদি ময়লা-আবর্জনাকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বসে থাকেন, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই।

আমার উদ্দেশে আপনার কটাক্ষ, “এঁরাই বাংলাদেশের ক্লাসিক লেখক!” অর্থাৎ আপনি বোঝাতে চাইছেন, আমার মতো দুর্বল, মুর্খ, কিছু না জানা, সাহিত্য না বোঝা লেখকরাই বাংলাদেশের ক্লাসিক লেখক। বোঝা গেল, বাংলাদেশের সাহিত্য-জগত সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই। ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াসের পর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের কত জল গড়িয়েছে, আপনি তার কোনো খবরই রাখেননি। এখন কারা উপন্যাস লিখছেন, কী লিখছেন, কীভাবে লিখছেন, আপনি কিছুই জানেন না। আপনার বক্তব্যে বোঝা গেল, পশ্চিমবঙ্গেই কেবল ক্লাসিক সব উপন্যাস লিখিত হচ্ছে। বাংলাদেশের লেখকরা ম্লেচ্ছ, এরা সাহিত্য বোঝে না, এদের লেখাজোখা কিছু হয় না। এরা উপন্যাস কী বোঝে না, সাহিত্য কী বোঝে না, এরা যা লিখছে সবই মস্ত মস্ত সব ঘোড়ার ডিম।

হে কমলকুমার শিষ্য, কারো কোনো সাহিত্যকর্ম না পড়ে হুটহাট মন্তব্য করে বসলে কমলকুমার হওয়া যায় না। আপনার সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে আগে আমাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহীরা’ পড়তে হবে। পড়ে তারপর বলতে হবে আপনি কেমন লেখেন। ওটা না পড়েই যদি ফেসবুকে আপনার টুকরো গদ্য পড়ে মন্তব্য করে বসি, ‘এরাই এখন পশ্চিমবঙ্গের ক্লাসিক লেখক’, তবে তা হবে অসাহিত্যিক কর্ম, যেটা আপনি করেছেন। ব্যস, এটুকুই আমার বক্তব্য। আপনার জন্য শুভ কামনা।

দুই.
আমি মহাকাব্যের কাছে যাই। মাঝে মাঝেই মহাকাব্যগুলোর পাতা ওল্টাই। কখনো মহাভারতের কাছে যাই, কখনো শাহনামার কাছে, কখনোবা রামায়ণ, ইলিয়াড, ওডিসি কিংবা ডিভাইন কমেডিয়ার কাছে। যাই নিজের অক্ষমতা বোঝার জন্য, নিজের খর্বতাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। এবং যাই বৃহতের পরশ লাভের জন্য।

কখনো কখনো বিহ্বল বোধ করি মহাকাব্যগুলোর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে। ভাবি, আমাদের প্রতিভাবান পূর্বজরা কী অসাধারণ দক্ষতায় নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন এসব মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে! মানব জীবনের সকল বোধ, উপলব্ধি, অনুভূতি, আনন্দ, বেদনা, চেতনা, শোক, তাপ, বিলাপ তারা গুঁজে দিয়েছেন শ্লোক ও আখ্যানের ভেতরে।

মানব জীবনের এমন কোন বিষয় আছে, যা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন তাঁর রাজগাথা, বীরগাথা, প্রকৃতিগাথা, জ্ঞানগাথা মহাভারতে ধরে রাখেননি? এমন কোন প্রসঙ্গ আছে যা ফেরদৌসী তাঁর শাহনামায় টুকে রাখেনিন? কখনো কখনো মনে হয়, গত কয়েকশো বছর ধরে পৃথিবীর কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকরা মানবজীবন বা মানবেতর প্রাণিজীবনের যে সব বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন এবং এখনো লিখে চলেছেন, সে সব বিষয় নিয়ে তো বহু শতাব্দী আগেই লিখে গেছেন বাল্মিকী, লিখে গেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, হোমার কিংবা ফেরদৌসী। পরবর্তীকালের কবি-সাহিত্যিকরা সেসব বিষয়েরই পুনরাবৃত্তি করে গেছেন, করে যাচ্ছেন নানা আঙ্গিকে, নানা ভাষায়। তখন মনে হয়, শিল্প-সাহিত্যের মৌলিকতা বলে আসলে কিছু নেই, সবই পুনরাবৃত্তি।

একজন কবি-সাহিত্যিককে মহাকাব্য কেন পড়তে হবে? পড়তে হবে এই জন্য যে, বৃহতের কাছে যাওয়া ছাড়া বৃহৎকে বোঝা যায় না। মহৎ সাহিত্যের কাছে না গেলে মহৎ সাহিত্য কী, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে এ যাবৎ যত সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে, তার মধ্যে এখনো পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে আছে মহাকাব্যগুলো। এই শ্রেষ্ঠ’র কাছে তো যেতেই হবে। যাওয়া ছাড়া উপায় কী? চলবে