স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৬২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৮, ২০২২

‘মহুয়ার ঘ্রাণ’ উপন্যাস নিয়ে বিতর্কটা শুরু করেছিলেন কমলকুমার শিষ্য পশ্চিমবঙ্গের হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায়। গতকাল আমি একটা উত্তরও দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি প্রাজ্ঞজন, তার সঙ্গে বিতর্ক চালিয়ে নেওয়া যাবে। পদাতিক পদাতিকের সঙ্গে, গদাধারী গদাধারীর সঙ্গে, তীরন্দাজ তীরন্দাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে―এটাই যুদ্ধের নিয়ম।

কিন্তু না, তিনি আমার ভুল ভেঙে দিলেন। তার আসলে এক কমলকুমার ছাড়া অস্ত্রশস্ত্র বলতে বিশেষ কিছু নেই। বড়ই নিঃশস্ত্র এক বিপন্ন যোদ্ধা তিনি। ভুলভাল বাক্যে নিজে একটা উত্তর লিখে চালিয়ে দিলেন অন্যের নামে। বললেন, সেটি নাকি বাংলাদেশের কেউ একজন তাকে ইনবক্স করেছে।

সেই জবাবে তিনি লিখলেন, আমি নাকি তার সঙ্গে বেয়াদবি করেছি। বেয়াদবি করার কারণ, আমরা বাংলাদেশিরা সবসময় গরম মসলাদার খাবার খাই, সে জন্য আমাদের ঝাঁঝ গরম থাকে। এটাই নাকি এই অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। সে কারণেই আমাদের মধ্যে ভদ্রতাবোধ নেই, বিনয় নেই, আমাদের কথাবার্তা বর্বোরিচত। বাংলাদেশ ভদ্রতার বিচারে খুবই গরিব একটা জায়গা। বাংলাদেশে যেসব সাহিত্য চর্চা হয়, সবই বস্তাপঁচা। এসব কালের বিচারে টিকবে না। পশ্চিমবঙ্গের লেখা অনবদ্য।
শ্রী হিরণ্ময় আরও লিখেছেন, বাংলাদেশে একসময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বাংলাদেশের সাহিত্যে ভালো কোনো কাজ হয়নি। সে কারণেই নাকি আমরা বাতিঘর থেকে বেশি দাম দিয়ে কলকাতার বই কিনে পড়ি।
কেউ যখন কারো সঙ্গে পেরে ওঠে না, তখন জাত-বংশ তুলে গালাগাল শুরু করে। শব্দবাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রথী অর্জুনকে নিয়ে তার সারথী শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রের বাইরে চলে যাচ্ছিলেন, তখন পেছনে ছুটছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী মহাবীর কর্ণ। অর্জুনকে বারবার যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছিলেন সূর্যপুত্র। তবুও অর্জুন যখন দাঁড়াচ্ছিলেন না, কর্ণ তখন শুরু করলেন শব্দবাণ নিক্ষেপ। শব্দবাণ নিক্ষেপ করে বাধ্য করলেন অর্জুনকে ধনুক হাতে তুলে নিতে।
গতকাল জবাবটি দেওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম এ নিয়ে আর কিছু বলব না। কিন্তু হিরণ্ময় শব্দবাণ নিক্ষেপ করে আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য করলেন। লিটারারি ডিবেট করতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের গোটা জনগোষ্ঠীর প্রতি শব্দবাণ নিক্ষেপ করে বসলেন। বাংলাদেশবাসীর ভদ্রতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসলেন।

হায় হিরণ্ময়! আপনি আজ যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে বড়াই করছেন, যে সাহিত্যিকদের নিয়ে আপনার গর্ব, তাঁদের অধিকাংশের শিকড় খুঁজে দেখুন। দেখবেন, তাদের শেকড় এই হিজল-তমাল-বট-অশ্বত্থের দেশ বাংলাদেশেই ছড়িয়ে আছে। আমাকে অপমান করতে গিয়ে আপনি আপনার পূর্বপুরুষদেরও অপমান করে বসে আছেন। কী দুর্ভাগ্য আপনার!

নিঃশস্ত্র, অথচ শস্ত্রধারীর ভান করে থাকা হিরণ্ময়ের ধারণা, তার মুখনিসৃত সব কথাই বেদবাক্য, সবই ব্রহ্মার মুখনিসৃত বাণী। তার ধারণা, তার সব কথায় আমি ‘আজ্ঞে দাদা, আপনি সঠিক কয়েছেন’ বলব। কিন্তু আমি তা বলিনি। তার বক্তব্যের উত্তর দিয়েছি। কিন্তু তিনি ভাবলেন আমি তার সঙ্গে বেয়াদবি করেছি।

তার মানে বোঝা যাচ্ছে, তিনি এখানো জমিদারি প্রথার কালে বসবাস করছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন, তার বক্তব্যের বিপরীতে কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না। দিলে সেটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। বোঝা গেল, তিনি বাংলাদেশকে কলকাতার উপনিবেশ ভাবছেন, বাংলাদেশকে কলকাতার কোনো রাজ্য ভাবছেন। আরও বোঝা গেল, তিনি প্রচণ্ড রকমের বাংলাদেশ বিরোধী একজন মানুষ।

শ্রী হিরণ্ময়ের মধ্যে ভয়াবহ রকমের উন্নাসিকতা দেখা গেল। এই উন্নাসিকতা অবশ্য তার পূর্বজদের কারো কারো মধ্যেও ছিল। বহুদিন আগের কথা। একবার বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট প্রকাশক (অনুমতি ছাড়া নাম প্রকাশ করলাম না) কথাসাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ফেরার সময় তাঁর প্রকাশনীর কয়েকটি বই দিলেন অমিয়ভূষণকে। অমিয়ভূষণ বললেন, ‘বাংলাদেশে বইও লেখা হয়! উপন্যাসও লেখা হয়! বাংলাদেশের কেউ লিখতেও পারে! তা আবার সেই বই আমাকে পড়েও দেখতে হবে!’

মিস্টার হিরণ্ময়, আমি ঠিকই লিখেছিলাম, আপনি এখনো ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস, শওকত ওসমানেই আটকে আছেন। গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই। এই দেশের সাহিত্য-জগৎ সম্পর্কে আপনি কিছুই জানে না। কী গভীর অন্ধকারে আপনি তলিয়ে আছেন! কিংবা এমনও হতে পারে, সাহিত্যক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি আপনার সহ্য হচ্ছে না। বাংলাদেশ যে এখন বাংলা সাহিত্যের রাজধানী, এটা আপনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। পারছেন না বলেই প্রলাপ বকে চলেছেন।

ভ্রাতা হিরন্ময়, বাংলাদেশকে আপনি যতই খাটো করতে চান না কেন, সুবিধা করতে পারবেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা আপনার পক্ষে মুশকিল। কারণ আপনার চেয়ে আমাদের অস্ত্র বেশি। আপনি শুধু পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-ঐতিহ্যকে ধারন করেন। আর আমরা একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-ঐতিহ্যকে ধারন করি। আমাদের এক কাঁধে রবীন্দ্রনাথ, আরেক কাঁধে নজরুল। আমাদের এক হাতে শঙ্খ ঘোষ, আরেক হাতে শামসুর রাহমান। আমাদের মাথার ডান দিকে বসে আছেন মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর-দেবেশ, বাঁ দিকে ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াস-শওকত আলী-সৈয়দ হক। আমাদের এক চোখে অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী; আরেক চোখে হাসান আজিজুল, শহীদুল জহির। কী করে পারবেন আমাদের সঙ্গে?

সুতরাং মৌন হয়ে যাওয়াটাই উত্তম। মৌনতাই সর্বোত্তম পন্থা। আপনি মৌন হয়ে যান। চলবে