স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৬৬

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২২

কোনো কোনো মানুষের সান্নিধ্যে আপনার মনে হবে, এইমাত্র আপনি মানস সরোবর থেকে স্নান করে উঠেছেন। একেবারে নিষ্কলুষ হয়ে গেছেন। আপনার ভেতরে আসবে পবিত্রতার এক ভাব। সেই ভাব আপনাকে নাড়িয়ে দেবে, কাঁদিয়ে দেবে, করে তুলবে পরিশুদ্ধ।

তেমনই একজন মানুষ কবি আসগর আলী। সকালে যখন অফিসে গিয়ে বসলাম, খানিক পরেই তিনি এলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি একটু আসতি পারি?’ প্রতিদিন কত মানুষই তো আসে। সবাইকে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। দিতে গেলে কাজের ক্ষতি হয়। তাই কণ্ঠস্বরটাকে একটু গম্ভীর করে বললাম, ‘আসুন।’

লাঠিভর দিয়ে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। বললাম, ‘বলুন?’ সঙ্গে সঙ্গে তার মুখভঙ্গি বদলে গেল। হাসিটা উবে গেল। ঠোঁটের কোণ দুটি তিরতির করে কাঁপতে লাগল। সেই কাঁপুনি নিয়ে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি কবি আসগার আলী। নিরক্ষর। লেখাপড়া জানি নে। আপনার ইখানে একটু বসতি পারি?’ আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, সহজ হয়ে গেলাম। নম্র গলায় বললাম, ‘অবশ্যই অবশ্যই, বসুন বসুন।’ তার দু’হাত ধরে চেয়ারে বসালাম।


জমে উঠল তার সঙ্গে আলাপ। বাড়ি তার যশোরে। ঢাকায় এসেছেন গতকাল। কবে থেকে কবিতা লিখলে শুরু করেন? প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘আমি তো লিখি নে, স্যার। লিখতি পারি নে। মুখে বলি, আরেকজনকে দিয়ে লিখিয়ে নিই। তা ধরেন দশ-বারো বছর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করি। ছোটবেলায় লেখা একটি কবিতা এখনো মনে আছে:

মার সাথে মামাবাড়ি
যেতে হবে তাড়াতাড়ি
নানা এলো গাড়ি নিয়ে
বুধবার দিন মামার বিয়ে
এক হাঁড়ি মিষ্টি নিলাম
আরেক হাঁড়ি পিঠে
বিয়ে বাড়ি হইচই
আমি খুঁজি মা কই।

একাশি বছর বয়সী কবি আসগর আলীর কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে বেশ ক’টি। সবই যশোর থেকে। ছোট ছোট বই। দশ টাকায় বিক্রি করতেন হাটে-বাজারে। এখনো করেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবিতা মানুষের কী কাজে লাগে?’ তিনি হাসলেন। বললেন, ‘কবিতা কী কাজে লাগে? শোনেন, কবির কাজ হতিছে মানুষকে তাড়া দেওয়া। বুঝিছেন, তাড়া দেওয়া। তাড়া না দিলে তো সাড়া পাওয়া যাবি না নে। তাই তাড়া দিতে হয়। কবিরা মানুষকে তাড়া দেয়। এই যে ধরিত্রী মাতার কথাই ধরেন। এই মায়ের নুন তো আমরা সকলে খাই। কী, খাই না? কিন্তু সবাই কি গুণ গায়? গায় না। কবিরা গায়। তারা ধরিত্রী মায়ের পাগল ছেলে। এই পাগলেরাই মায়ের গান গায়:

জন্মেছি মা তোমার কোলে
এই তো আমার অনেক পাওয়া
তোমার বুকে হেসেখেলে
দু’দিনেরই আসা-যাওয়া।
মা গো তোমায় ভুলে যেয়ে
সুখি হতে পারব না
যে তোমায় ছাড়বে ছাড়ুক
আমি তোমায় ছাড়ব না।
কুঁড়েঘরে থাকি বলে
তাকাস নে মা মলিন মুখে
যে যত বলে বলুক
আছি আমি অনেক সুখে।
তাই চলার পথে বলে বেড়াই
মা গো তোমার গুণের কথা
যাই যেখানে আবার ফিরে এসে
পাই যেন মা আঁচল পাতা।
তোমার কথা ভাবতে মা গো
খুশিতে হই আত্মহারা
নুন খেয়েছে অনেকে মা গো
গান গেয়েছে এই পাগল যারা।
মা গো তোমার পাগল ছেলে
ঘুরে বেড়াই আশেপাশে, দেশ-বিদেশে
জীবনে-মরণে তুমি
বলো, বলো ও মা ভাবনা কীসে?

কবি আসগর আলী একের পর এক কবিতা বলে যেতে থাকেন, আমি শুনতে থাকি তন্ময় হয়ে। জানি, নাগরিক কবিরা, আধুনিক কবিরা বলবেন, ‘আসগর আলীর কবিতা তো হয় না। এখন কি আর এভাবে কবিতা লেখা হয়? কেউ লেখে? তার কবিতার তো ছন্দের ঠিক নাই।’ কিন্তু আমি তাঁর কবিতার মধ্যে ব্যাকরণ খুঁজি না, ছন্দ খুঁজি না, অন্তমিলও খুঁজি না। খুঁজি কবিতার জন্য তার নিবেদন। একটা জীবন তিনি কবিতার পেছনে ছুটেছেন, কবিতার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, মুখে মুখে রচেছেন হাজার হাজার কবিতা। এখনো তিনি কবিতাচর্চায় সমান সক্রিয়।

আর দেখি তার হাসি। কথা কথায় তিনি হাসতে পারেন। হাসতে পারা একটা বড় ক্ষমতা। আর দেখি তার কান্না। কবিতা পড়তে পড়তে তিনি হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ওঠেন। এই কান্না তাঁর ভাবের কান্না, সরলতার কান্না। তার ভেতরে কোনো কূটিলতা নেই। তার চোখে, মুখে, কপালের ভাঁজে জটিলতার কোনো চিহ্নমাত্র নেই। ভাবি, এই কালে এমন সহজ, এমন সরল মানুষও থাকতে পারে?

তিনি বারবার আমাকে ‘স্যার’ সম্মোধন করছিলেন। আমি বললাম, আপনি আমাকে স্যার ডাকছেন কেন? আমি তো বয়সে আপনার অর্ধেকেরও কম। তিনি বললেন, আপনি জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানীজন বয়সে ছোট হলেও তাকে সম্মান করতে হয়। আমি বললাম, আমি তো আপনার চেয়ে কম জ্ঞানী। আপনি আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। এই জগৎ আর জীবনকে আমার চেয়ে আপনি বেশি দেখেছেন, বেশি জেনেছেন। সুতরাং স্যার ডাকা চলবে না।

আজগর আলীর সঙ্গে আলাপ চলতে থাকে নানা বিষয়ে। রাজনীতি, ধর্ম কিছুই বাদ যায় না। বাদ যায় না প্রকৃতি প্রসঙ্গও। মাছরাঙাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন তিনি। সেই কবিতার প্রেক্ষাপট বললেন। নদীর ধারে গাছের ডালে বসে আছে একটি মাছরাঙা। বড় দুশ্চিন্তা তার। এ নদী থেকে কত চুনোপুঁটি আর ছোট মাছ ধরে সে খেয়েছে, তার বাচ্চাদের খাইয়েছে। এখন নদীতে ছোট মাছ নাই। জমিনে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সব ছোট মাছ মরে সাফ হয়ে গেছে। এখন আছে বড় বড় সব রুই-কাতল। কিন্তু মাছরাঙা তো রুই-কাতল শিকার করতে পারবে না। উল্টো রুই-কাতল পারলে তাকে শিকার করে ফেলবে। এখন সে খাবে কী? সে কারণেই তার বড় দুশ্চিন্তা।

কবি আসগর আলী বলেন, ‘কবি তো শুধু মানুষকে নিয়ে ভাবে না, এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও আরো যত প্রাণী আছে, সবাইকে নিয়ে ভাবে। ভাবাটা তার কাজ।’

দীর্ঘ সময়ের আড্ডা শেষে কবি আসগর আলী চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন, ‘একটা কথা কই বাজান?’ আমি বললাম, ‘বলেন।’ তিনি বললেন, ‘তোমার সাথি কথা কইয়ে অনেক ভালো লাগিছে। দোয়া করি তুমি অনেক বড় লেখক হও।’ আমি বললাম, স্যারের বদলে আমাকে ‘বাজান’ এবং ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’ সম্মোধনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

৩১ মার্চ ২০২২