মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ২৫

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০২০

হিরো আলমের সমস্যাটা আসলে কোথায়? তিনি কি চোর? ডাকাত? দুর্নীতিবাজ? মাস্তান? না, এর কিছুই তিনি নন। তিনি একজন অভিনেতা। নিজে সিনেমা প্রযোজনা করেন, নির্মাণ করেন, অভিনয় করেন। তার সিনেমা কতটা ভালো, কতটা মন্দ, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। এই বদ্ধ সমাজে, ক্রমশ আরো বদ্ধতার দিকে ছুটতে থাকা এই সমাজে তিনি সাংস্কৃতিক তৎপরতা সঙ্গে রয়েছেন―এটিকে আমি অনেক বড় কাজ বলে মনে করি। সকল ধরনের সাংস্কৃতির তৎপরতা ইতিবাচক। স্কুল-কলেজের নানা অনুষ্ঠানে যেসব ছাত্রছাত্রী ভুল ভাষায়, ভুল সংলাপে, ভুল অভিনয়ে নাটক মঞ্চস্থ করে, গান গায়―সেগুলোও সাংস্কৃতিক তৎপরতা। গায়ে হলুদ কিংবা বিয়ের আসরে যে মেয়েটি বা ছেলেটি ভাঙা গলায় গান গায়, ভুল তালে নাচে―সেটাও সাংস্কৃতিক তৎপরতা। ইতিবাচক। সমাজের জন্য ভালো। হিরো আলম তেমনই তৎপরতার সঙ্গে রয়েছেন। এজন্য তাকে প্রণাম। তার মধ্যে কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা নেই। কে কী বলল, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। নিজে যা বোঝেন, যা পারেন, তাই করছেন, করে যাচ্ছেন। তার সিনেমা আমি বা আমরা দেখলাম কিনা, প্রশংসা করলাম কিনা, নিন্দা করলাম কিনা―এসব নিয়ে তার কোনো টেনশনই নেই।

তাহলে তার সমস্যাটা আসলে কোথায়? মিডল ক্লাসের একটা শ্রেণি কেন তার নিন্দা করে? কেন তাকে রিসিভ করতে পারছে না? কেন তার সমালোচনায় মুখর থাকে? কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, হিরো আলম অন্যের ছবি নকল করেন, অন্যের অভিনয় নকল করেন। পাল্টা প্রশ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান সিনেমার মৌলিকত্ব কতটা? আমি একজন সিনেমার দর্শক। সব ধরনের সিনেমাই দেখি। বাংলাদেশের বিস্তর সিনেমা তো বলিউডের সিনেমার নকল, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার নকল, এমনকি কলকাতার সিনেমারও নকল। অভিনেতাদের অভিনয়ও নকল। নকলবাজি করে করে তারা একেকজন ‘বড় মাপের’ অভিনেতা হয়ে যাচ্ছেন, সেলিব্রেটি হয়ে যাচ্ছেন, টাকা কামাচ্ছেন, রেডিও-টেলিভিশন, পত্রপত্রিকায় ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব নকলবাজদের সমালোচনায় আমরা কতটা মুখর? তাদের নকলবাজির কতটা নিন্দা করি? তাহলে হিরো আলমের নিন্দা কেন? কোন যুক্তিতে? তিনি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন না বলে? তার ভাষায় আঞ্চলিকতার স্পষ্ট ছাপ বলে? দেখতে তিনি কালো বলে? বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো সুন্দর-সুঠাম দেহের অধিকারী নন বলে? এছাড়া তার আর কোনো সমস্যা তো দেখছি না। কেউ বলতে পারেন, হিরো আলম একটা ভাঁড়। তো সমাজে কি ভাঁড়ের প্রয়োজন নেই? ভাঁড়কে কি খাটো করতে হয়? তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে হয়?

বিগত দিনগুলোতে দেখেছি, বিশেষ করে হিরো আলম যখন নির্বাচনে দাঁড়ালেন, বিভিন্ন টেলিভশন টক শো-তে তাকে এনেছে। উপস্থাপক এমন সব প্রশ্ন তাকে করেছেন, উপস্থাপকের প্রশ্নে এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল, যেন হিরো আলম একজন মহা অপরাধী। তিনি বড় বড় সব অপরাধ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, হিরো আলম কোনো প্রশ্নেই ক্ষিপ্ত হতেন না। তার মতো করে তিনি সুন্দর ও যৌক্তিক উত্তর দিতেন। হিরো আলমকে তো আপনারাই আমন্ত্রণ করে এনেছেন। তাকে পছন্দ না হলে আমন্ত্রণ করতেন না। আমন্ত্রণ করে কেন তাকে হেয় করা, কেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা? তাকে হেয় করতে গিয়ে প্রকারান্তরে আপনাদের হীনম্মন্যতা প্রকাশ পেয়েছে। আপনাদের নীচতা প্রকাশ পেয়েছে।

সম্প্রতি হিরো আলমকে নিয়ে একটা সিনেমা বানানোর কথা ছিল অভিনেতা অনন্ত জলিলের। এজন্য তিনি হিরো আলমের সঙ্গে চুক্তিও করেছিলেন, পঞ্চাশ হাজার টাকা সাইনিং মানিও দিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানালেন, হিরো আলমকে নিয়ে তিনি সিনেমা বানাবেন না এবং তাকে দেয়া পঞ্চাশ হাজার টাকাও ফেরত নেবেন না। তার পোস্টটি দেখা যাক। তিনি লিখেছেন, “আমি হিরো আলমকে নিয়ে কোন সিনেমা বানাবো না এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা সাইনিং মানি ফেরৎ নিবনা!! সিংহভাগ বিনোদন সাংবাদিকরা এবং চলচ্চিত্র পরিবারের সকল গুণীজনরা হিরো আলম কে নিয়ে সিনেমা বানানোর আপত্তি জানাচ্ছেন। এবং রিসেন্টলি তার কিছু অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সকলেই আবারো আমাকে নিষেধ করছেন, তাকে নিয়ে যেন সিনেমা না বানাই। সব সময় আমি বিব্রত হচ্ছি, হিরো আলমের এসব বিতর্কিত বিষয় গুলোর জন্য। দীর্ঘদিন যাবৎ আমি চলচ্চিত্র অঙ্গনে সম্মানের সহিত কাজ করে আসছি, চলচিত্রের প্রতিটি সংগঠনের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে, প্রতিটি সংগঠনই আমাকে সন্মনের চোখে দেখে। তাই এই সন্মন রক্ষার্থে, বিতর্কিত কাউকে নিয়ে আমি সিনেমা বানাতে চাইন না। চলচ্চিত্রের কোন সংগঠনই চাচ্ছেনা যে আমি হিরো আলমকে নিয়ে সিনেমা বানাই। চলচ্চিত্রের প্রত্যকটি সংগঠনের সন্মানার্থে আমিও চাইনা বিতর্কিত কাউকে নিয়ে সিনেমা বানাতে।

আরকটি কারন, উল্ল্যেখ না করলেই নয়। কিছুদিন আগে আমি নিজ উদ্যোগে জায়েদ খানের সঙ্গে হিরো আলমকে মিল করিয়ে দিয়েছিলাম, এবং প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও তাদেরকে নিয়ে একসঙ্গে লাঞ্চ করেছিলাম। মীমাংসা করে দেওয়ার পরেও একই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হিরো আলম মন্তব্য করছেন যা মোটেও কাম্য নয়। আমার এত ব্যস্ততার মাঝেও আমি তাকে পাশে বসিয়েছিলাম, সে আমার মর্যাদা বোঝে নাই। আমার মর্যাদা যেহেতু বোঝেনাই তাই আমি চাইনা ভবিষ্যতে তার দ্বারা আমার মর্যাদা ক্ষুন্ন হোক। আমি চাচ্ছিলাম, তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সহযোগিতা করার, যাতে করে তার উপকার হয়। এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানুষের সঙ্গে আমার কাজ করা সম্ভব না। তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে আমি আর তাকে নিয়ে সিনেমা বানাবো না। পঞ্চাশ হাজার টাকা সাইনিং মানি যেটি দিয়েছি সেটি আমি চাইছি না, সেটি তাকে আমি দিয়ে দিলাম।”

শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে না পারা যদি হিরো আলমের সমস্যা হয়, শুদ্ধভাবে লিখতে না পারাটাও তো অনন্ত জলিলের সমস্যা। তার ছোট্ট এই লেখাটির মধ্যে তো বিস্তর বানান ভুল। মাতৃভাষা বাংলাটাও তো তিনি ঠিকঠাক লিখতে পারেন না। এজন্য কি আমরা তার নিন্দা করব? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিরো আলমের কিছু অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে পড়া যদি হিরো আলমের দোষ হয়, এদেশের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীরও তো অনেক ‘অশ্লীল ভিডিও’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সে কারণে কি তারা অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছেন? দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন?

আর অনন্ত জলিলের কথাগুলো এতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ যে, মনে হচ্ছে, হিরো আলম নয়, অনন্ত জলিলই সবচেয়ে বড় মূর্খ, সবচেয়ে বড় অশ্লীল। তিনি লিখেছেন হিরো আলম তার মর্যাদ বোঝেনি। অনন্ত জলিলের মর্যাদাটা কী? তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সিআইপি―এটা তার অন্য পরিচয়। তার এ পরিচয় নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমিও বলছি না। এরকম বিস্তর সিআইপি দেশে আছে, যাদের কেউ চেনে না, নামও জানে না। একজন অভিনেতা হিসেবেই অনন্ত জলিলকে সবাই চেনে। কথা হচ্ছে তার অভিনয় সত্তা নিয়ে। তিনি কি হিরো আলমের চেয়ে ভালো অভিনয় করেন? তার অভিনয় তো আমার কাছে খুবই কাঁচা, দুর্বল এমনকি কখনো কখনো হাস্যকর মনে হয়। হিরো আলমের চেয়ে তার আলাদা মর্যাদাটা কোথায়? তার টাকা আছে, হিরো আলমের নেই―এই তো? আর নিজে কতটা মর্যাদাবান, সেটা মূর্খরাই প্রকাশ করে। প্রকৃত মর্যদাবান কখনো নিজের মান-সম্মানের কথা প্রচার করে বেড়ান না। রবীন্দ্রনাথের উক্তি, ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান।’

অনন্ত জলিল লিখেছেন, হিরো আলমকে দেওয়া সাইনিং মানির পঞ্চাশ হাজার টাকা ফেরত নেবেন না। তার কথাটি খেয়াল করা যেতে পারে, “পঞ্চাশ হাজার টাকা সাইনিং মানি যেটি দিয়েছি সেটি আমি চাইছি না, সেটি তাকে আমি দিয়ে দিলাম।” দিয়ে দিলেন মানে কী? আপনি কি হিরো আলমকে ভিক্ষা দিচ্ছেন? আমি একজন লেখক। আমার সঙ্গে কোনো প্রকাশক যদি চুক্তি করেন, আমাকে সাইনিং মানি দেন, পরে যদি আমার বইটি প্রকাশ না করে এরকম কোনো পোস্ট দেন, আমি তো তার বিরুদ্ধে মানহানি ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করে দেব এবং বই বিক্রির সমস্ত টাকা দাবি করব। কারণ আমি তো চুক্তি ভঙ্গ করছি না, করছেন তো প্রকাশক। একইভাবে হিরো আলম তো চুক্তি ভঙ্গ করেননি, করেছেন অনন্ত জলিল। সেক্ষেত্রে সমস্ত টাকাই তো হিরো আলমকে দিয়ে দেওয়ার কথা। তা না করে তিনি সীমাহীন ঔদ্ধত্যের সঙ্গে লিখেছেন, ‘সেটি তাকে আমি দিয়ে দিলাম।’ হিরো আলমের তো উচিত অনন্ত জলিলের বিরুদ্ধে মানহানি ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করে চুক্তির সমস্ত টাকা দাবি করা। নীতি তো তাই বলে, বিবেক তো তাই বলে। আইনও তো সম্ভবত তাই বলার কথা। নাকি এ নিয়ে বাংলাদেশে কোনো আইনই নেই?

মানুষের ঔদ্ধত্যের সীমা থাকা দরকার। অনন্ত জলিল সমস্ত সীমা লংঘন করেছেন। হিরো আলমকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনি অভদ্রতা, নীচতা ও মূর্খতার পরিচয় দিয়েছেন। এমন যার ভাষাজ্ঞান, ভাষারুচি, ভদ্রতাজ্ঞান, তিনি কেমন করে চলচ্চিত্রের অভিনেতা হন? অনন্ত জলিলের উচিত হিরো আলমের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে তার সমুদয় পাওনা দিয়ে দেওয়া। আর হিরো আলম, আপনাকে অভিবাদন। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক, অব্যাহত থাকুক আপনার সাংস্কৃতিক তৎপরতা। নিরন্তর শুভ কামনা আপনার জন্য। চলবে

১৭.৭.২০২০