মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৩৩

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০২০

এক সপ্তাহ ধরে ঝিলাম নদীর তীরে ছিলাম। পৌরব রাষ্ট্রে। তবে বাস্তবে নয়, মননে; সিদ্ধার্থ কুমার তিওয়ারি নির্মিত সিরিয়ালের মাধ্যমে। মেসেডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম ভারত পরস্পরবিরোধী অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বহিরাক্রমণ ঠেকানো ছিল অসম্ভব। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দের মধ্যে সমগ্র পারস্য ও আফগানিস্তান আলেকজান্ডারের দখলে এলে তিনি আরও পূবে অবস্থিত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরান। নৌকাসেতুর সাহায্যে সিন্ধু নদ পার হয়ে পদার্পণ করেন ভারত ভূখণ্ডে।

পূর্বতন আকামেনিদীয় সাম্রাজ্যের গান্ধার প্রদেশের অধীন ও সংলগ্ন সমস্ত রাজা ও গোষ্ঠীপ্রধানদের তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য আহ্বান জানালে তক্ষশীলার রাজা অম্ভি তার কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু আলেকজান্ডারের আহ্বানে সাড়া দিলেন না পৌরবরাজ পুরুষোত্তম বা পুরো। আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন প্রবল প্রতিরোধ।

এ ঐতিহাসিক কাহিনিকে অবলম্বন করে ভারতের সিদ্ধার্থ কুমার তিওয়ারি নির্মাণ করেছেন এক মহাকাব্যিক সিরিয়াল, যার নাম ‘পোরাস’। ২৪৯ পর্বের এই সিরিয়াল দেখলাম টানা এক সপ্তাহ ধরে। অবিরাম। ঢুকে গিয়েছিলাম ইতিহাসের গভীরে। এখানেই সিরিয়ালটির সফলতা যে, দর্শকের বর্তমানকে ভুলিয়ে টেনে নিয়ে যায় বিষয়বস্তুতে। কুমিরের সঙ্গে পুরুর লড়াই এবং হস্তিবাহিনী কর্তৃক আলেকজান্ডার বাহিনীর ওপর আক্রমণ―এ দুটি ছাড়া আর কোনো দৃশ্যকে বানানো মনে হয়নি, যেন একেবারেই বাস্তব। একবারও মনে হয়নি ইউটিইউবে কোনো সিরিয়াল দেখছি। মনে হচ্ছিল যেন চোখের সামনে ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহগুলো ঘটে চলেছে।

অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নে মহারানী অনসূয়ার আত্মত্যাগ দেখে অশ্রুসিক্ত হয়েছি, পৌরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা এবং অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নে হাজার হাজার পৌরব-সৈন্যের অকাতর বলিদান দেখে আতকে উঠেছি, অসীম সাহসী রাজা পুরুর বীরত্ব দেখে বিস্মিত হয়েছি, মহান চিন্তক চাণক্যের প্রজ্ঞা দেখে শ্রদ্ধাবনত হয়েছি, আলেকজান্ডারের পৈশাচিকতা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং সিরিয়ালটি দেখা শেষ করে বিষণ্ণ হয়েছি।

মহাকাব্য পড়েছি, কিন্তু সেই অর্থে কখনো দেখা হয়নি। ‘রামায়ণ’ অবলম্বনে নির্মিত ‘লব-কুশ আর রাম-সীতা’ দেখেছি। কিন্তু নির্মাণে দুর্বলতা ছিল বলে স্বাদ মেটেনি। ‘পোরাস’ দেখে সেই অভাব পূর্ণ হলো। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে জানার জন্য অন্তত পাঁচশো বই পড়া এবং ‘পোরাস’-এর মতো একটি সিরিয়াল দেখা প্রায় সমান। আগামী এক বছর দেড়-দুই ঘণ্টার কোনো সিনেমা দেখার ইচ্ছাকে নিকেশ করে দিয়েছে এই সিরিয়াল। মহাকাব্যে যে বিস্তার থাকে, তা রয়েছে সিরিয়ালটিতে। একেকটি পর্বে যা ঘটবে বলে ধারণা করি তা ঘটে না, ঘটে তার উল্টো। আনপ্রেডিক্টেবল।

দেশপ্রেম জনগণের মধ্যে এমনি এমনি তৈরি হয় না, আকাশ থেকেও পড়ে না, দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে হয়। সেই কাজটিই করে শিল্প-সাহিত্য। যেমন করেছে ‘পোরাস’। ভারতবর্ষের কোনো সন্তান ‘পোরাস’ দেখার পর দেশের সঙ্গে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করতে অন্তত একবার হলেও ভেবে নেবে। এখানেই শিল্পের শক্তি। সিদ্ধার্থ কুমার তিওয়ারি কত বছর সময় ব্যয় করেছেন এই সিরিয়ালের পেছনে, কত শ্রম দিয়েছেন, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়!

বাংলাদেশে কি এমন সিরিয়াল নির্মাণ সম্ভব? ঈসা খাঁকে নিয়েও তো এমন একটি সিরয়াল হতে পারে, যিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাট আকবরের আগ্রাসন। দক্ষিণ পূর্ববাংলার শমসের গাজীকেও নিয়েও তো হতে পারে, যিনি দাঁড়িয়েছিলেন ইংরেজ আধিপত্যের বিরুদ্ধে। হতে পারে বারো ভূঁঞাদের নিয়েও। প্রতাপাদিত্য, চাঁদরায়, কেদার রায়, কর্ন্দপ রায়, লক্ষণমাণিক্য, মুকুন্দরাম রায়, জফল গাজী, বীর হাম্বীর, কংসনারায়ণ রায়, রাজা রামকৃষ্ণ, পীতাম্বর ও নীলাম্বর, ঈশা খাঁ লোহানী ও উসমান খাঁ লোহানী, রশ্নি খাঁ―এদের প্রত্যেককে নিয়েই সিরিয়াল হতে পারে। হতে পারে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকার’ পালাগুলো নিয়েও। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো হতে পারে হাজার পর্বের সিরিয়াল। কিন্তু কে করবে? ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ সেই পরিচালক কই? সেই ব্যয়বহুল সিরিয়াল নির্মাণের জন্য অর্থের জোগানই-বা কে দেবেন?

সিদ্ধার্থ কুমার তিওয়ারিকে করজোড় প্রণতি। চলবে