মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৩৫

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৩, ২০২০

একটু দেরিতেই ‘যুবতী রাধে’ বা ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি শুনলাম। সরলপুর ও আইপিডিসির দুটি পরিবেশনাই নান্দনিক, মনকাড়া। তবে আইপিডিসির পরেবেশনাটি তুলনাহীন। মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরীর পরিবেশনের ঢং গানটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে এমন চমৎকার গান কমই শোনা হয়েছে। গানটি শুনে সত্যিকার অর্থেই শিল্পে স্নাত হয়েছি। বেশ কদিন ধরে বিতর্ক চলছে গানটির কপিরাইট নিয়ে। নানাজন নানা মত দিচ্ছেন। গান নিয়ে বিতর্ক ইতিবাচক, প্রশংসনীয়। এ বিতর্ককে সাধুবাদ জানাই। একটি গান নিয়ে বিতর্ক―এটি সংস্কৃতি চর্চার লক্ষণ। সংস্কৃতি বর্জিত জাতি অসভ্য, বর্বর। বিস্তর বাঙালি যে এখনো সংগীতকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করে, এই বিতর্ক তার প্রমাণ।

গত দুদিন ধরে এই বিতর্ক সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। জানতে পারি, ২০১৮ সালের জুনে ‘যুবতী রাধে’ শিরোনামে গানের জন্য সরলপুর ব্যান্ডকে কপিরাইট সনদ দেয় বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস। সেই গানের কথা ও সুর হুবহু রেখে সরলপুরের অনুমতি ছাড়াই ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামে প্রকাশ করে আইপিডিসি। ক্রিয়েটোর পরিচালনায় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের কণ্ঠে প্রকাশিত গানের কথা ও সুরকে ‘সংগৃহীত’ বলে উল্লেখ করায় ফেসবুক লাইভে ও গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানায় সরলপুর। এখন শোনা যাচ্ছে কপিরাইট ইস্যু নিয়ে সরলপুর ব্যান্ড মামলাও করতে যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ পার্থ বড়ুয়া, চঞ্চল  চৌধুরী ও শাওনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করবে।

বাংলা গানের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলোর মধ্যে রয়েছে : কীর্তন, ভজন, শ্যামা, বাউল, বিষ্ণপুর, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, কবিগান, আলকাপ, রবীন্দ্র, নজরুল, আধুনিক, বাংলা ব্যান্ড। বাংলার প্রাচীন সংগীতকলা সংস্কৃত স্তোত্রসংগীত প্রভাবিত। অধিকাংশই ধর্মীয় সংগীত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’ এই জাতীয় সংগীতের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। মধ্যযুগের প্রথম দিকে বিদ্যাপতি, চ-ীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, ও বলরামদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তারা রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমচেতনার একটি পার্থক্য দেখিয়েছেন। আবার মধ্যযুগের শেষ দিকে রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্তপদাবলিকাররা তাদের গানে ঈশ্বরকে শুদ্ধ মাতৃরূপে বন্দনার কথা বলেছেন। বৈষ্ণব ও শাক্তপদাবলি (শ্যামাসংগীত ও উমাসংগীত) উভয়েরই মূল উপজীব্য ভক্তিবাদ। বৈষ্ণব সংগীতে যখন জীবাত্মা-পরমাত্মাকেন্দ্রিক প্রেমভক্তির তত্ত্ব প্রচারিত হয়, তখনই শাক্তগানে তন্ত্র ও শুদ্ধা মাতৃবন্দনার এক সম্মিলন গড়ে ওঠে।

‘যুবতী রাধে’ বা ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি কীর্তন ধারার গান। কৃষ্ণ ও রাধার কীর্তন। আরো নির্দিষ্ট করে বললে রাধা-কৃষ্ণ লালীকীর্তন। এ ধরনের কীর্তন সাত-আট শতক ধরে বাংলা অঞ্চলে গীত হচ্ছে। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্যের গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের পর এ ধারার গান আরো বেশি শক্তি অর্জন করে গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ ধারার গানের একটা রীতি হচ্ছে, গানের ভাব ও সুর ঠিক রেখে দু-একটি শব্দ বা লাইন এদিক-ওদিক করে একেক শিল্পী একেকভাবে গেয়ে থাকেন। এই রীতিটি আমরা জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান ও বাউল গানের মধ্যেও দেখতে পাই। ভাব ও সুর ঠিক রেখে গায়েনরা নিজেদের মতো শব্দ প্রয়োগ করে বা দু-একটি লাইন সংযোজন-বিয়োজন করে আসরে পরিবেশন করেন। সংগীত ও সংস্কৃতি গবেষকরা এ সম্পর্কে অবগত আছেন।

‘যুবতী রাধে’ বা ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংগীত। কেউ কেউ একে ‘লোকসংগীত’ বলবেন। কিন্তু আমি মনে করি না সংগীতের ‘লোক’ আর ‘অলোক’ বলে কিছু আছে। সব সংগীতই লোকের জন্য, মানুষের চিত্তানন্দের জন্য। সেই মানুষ নগরের হোক বা গ্রামের। একে আমি বলব ‘ঐতিহ্যবাহী সংগীত’। এই ঐতিহ্যবাহী সংগীতের অনেক সয় গীতিকারের হদিস থাকে না। কারণ গীতিকারেরা নাম প্রচারের জন্য নয়, একটা আদর্শ প্রচারে জন্য এসব গান রচনা করতেন। একটা সময় এগুলো মুখে মুখে গীত হতো। কেউ লিখে রাখার প্রয়োজন মনে করতেন না। যেমন ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র পালাগুলোর কথাই ধারা যাক। চৌদ্দ থেকে সতের শ শতকের মধ্যে পূর্ববঙ্গের সাধারণ কৃষকদের মুখে মুখে রচিত হয়েছিল অসংখ্য কাহিনিকাব্য বা পালা। রচয়িতারা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কেউ কেউ হয়ত সামান্য লিখতে-পড়তে পারতেন। তবে তাঁদের মধ্যে ভাবরসের কোনো কমতি ছিল না। তৎকালীন সমাজ, ইতিহাস, যুদ্ধ, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, মানব-মানবীর প্রেম, নারীর আত্মত্যাগসহ মানবজীবনের নানা ঘটনা নিয়ে ছড়া-পাঁচালির ঢঙে মুখে মুখে পালাগুলো রচনা করতেন তাঁরা। পরে গায়েনের দল সুরারোপ করে গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়াত। এসব পালাই ছিল গ্রামবাংলার মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম।

১৯১৩ সাল থেকে চন্দ্রকুমার দে প্রথম এই ধরনের পালাগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেন। খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর পালাগুলো পড়ে মুগ্ধ হন এবং চন্দ্রকুমার দে’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তাঁর নেতৃত্বে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফরিদপুর, সিলেট, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পালাগুলো সংগৃহীত হয়। প্রধান প্রধান সংগ্রাহকের মধ্যে ছিলেন চন্দ্রকুমার দে, দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ চৌধুরী, জসীমউদ্দীন, নগেন্দ্রচন্দ্র দে, রজনীকান্ত ভদ্র, বিহারীলাল রায়, বিজয়নারাণ আচার্য প্রমুখ। পরবর্তীকালে দীনেশচন্দ্র সেনের সংকলন ও সম্পাদনায় চার খ-ে প্রকাশিত হয় ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’।

মধ্যযুগ ও তৎপরবর্তীকালে বিস্তর সংগীত মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হতো। গীতিকারের কোনো হদিস পাওয়া যেত না। পরবর্তীকালে গবেষকরা এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী গানগুলো সংগ্রহ করে সংকলন প্রকাশ করেন। তেমনি একটি সংকলন ‘বাঙলার গ্রাম্যছড়া’। কলকাতার স্বারস্বত লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়ের এ বইটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। সাভারের পিএটিসি লাইব্রেরিতে বইটি আছে, চাইলে যে কেউ ওখান থেকে দেখে নিতে পারবেন। বইটির ১৬-১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় আলোচ্য গানটি এমন:

‘সর্বমঙ্গলে রাধে বিনোদিনী রাই
বৃন্দাবনে বন্দী পীর ঠাকুর কানাই।
তুমি তো কালুয়া কানাই তাইতে তোমার এত
সুন্দর হইলে পদ ভূমে না পড়িত।
কালো কালো করিস না লো ও গোয়ালের ঝি
বিধাতা করেছে কালো আমি করব কী?
এক কালো যমুনার জল সর্বলোকে খায়
কালো মেঘের ছায়ায় বসে শরীর জুড়োয়।
পরের রমণী দেখে অমন কেন কর
পালের গাভী বেচে বিয়ে না কেন কর।
বিয়ে তো করিব রাধে বিয়ে তো করিব
তোমার মত সুন্দর রাধে কোথায় গিয়ে পাব?
আমার মতো সুন্দর রাধে কানাই যদি চাও
গলায় কলসী বেঁধে যমুনাতে যাও।
কে বা দেবে কলসী রাধে কে বা দেবে দড়ি
তুমি রাধে হও যমুনা আমি ডুবে মরি।
এই কথা বলিয়ে রাধে সোজা চলে যায়
কানুর হাতের বাঁশি তখন সর্প হয়ে ধায়।
ডান পায়ে জড়ায়ে সর্প দংশিল বাম পায়
মলাম মলাম রব করিয়ে ঢলে পড়ল রাই।
এই সর্পের বিষ যে জন ভালো করিতে পারে
এই রূপ যৌবন আমি দান করিব তারে।
কানাই উঠিয়া বলে মহামন্ত্র জানি
বার চার পাঁচ ঝাড়লে পরে বিষ হইবে পানি।
একবার ঝাড়িতে বিষ রাধা কইল কথা
কী না সাপের বিষরে বাবা ধরল বুকের ছাতা।
আর একবার ঝাড়িতে বিষ হয়ে গেল পানি।
রাধাকৃষ্ণের যুগলমিলন বল শিবের ধ্বনি।

এ গানটির সঙ্গে সরলপুর ব্যান্ডের গানটি মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। সরলপুরের গানটি নেটে পাওয়া যাবে। চাইলে যে কেউ মিলিয়ে দেখতে পারেন। সংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়া তার একটি ভিডিও বক্তব্যে এবং কবি মুহাম্মদ ফরিদ হাসান তার একটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন, এ ঐতিহ্যবাহী গানটির কয়েকটি লাইন অন্যভাবে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’য়ও রয়েছে। (দ্বিজ কানাইয়ের ‘মহুয়া পালা’ দ্রষ্টব্য।) পল্লী গীতিকায়ও ঢুকেছে কয়েকটি লাইন। (বাংলার লোক সাহিত্য দ্বিতীয় খণ্ড দ্রষ্টব্য।) সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সরলপুর ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, ভোকালিস্ট ও গিটারিস্ট তারিকুল ইসলাম তপনের গানটির উৎস হচ্ছে  বাংলার ‘বাঙলার গ্রাম্যছড়া’ বা ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান। গানটির ভাব, সুর ঠিক রেখে দু-একটি লাইন ও শব্দ এদিক-ওদিক করে খানিকটা নতুন করে লিখেছেন তিনি। কেউ বলতে পারেন, জনাব তপন গানটিকে বিকৃত করেছেন। কিন্তু আমি তা বলব না। আমি একে বিনির্মাণ বলতে চাই। এই বিনির্মাণ সুন্দর। এই বিনির্মাণকে আমি বাংলা সংগীতের রেনেসাঁস বলছি। বাংলা সংগীতের খনির বিশাল। সেই বিশাল খনি থেকে এ ধরনের গান নিয়ে নতুন কালের নতুন শ্রোতাদের জন্য নতুন বিন্যাসে বিনির্মাণ করে পরিবেশন করলে বাংলা গান আরো শক্তিশালী হবে, গানের প্রতি শ্রোতাদের আগ্রহ আরো বাড়বে। সুস্থ সমাজের জন্য সংগীত অপরিহার্য। তারিকুল ইসলাম তপন বাংলা গানের খনি থেকে ‘যুবতী রাধে’ গানটি নিয়ে বিনির্মাণ করে একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই নিজেকে এই গানের গীতিকার ও সুরকার বলে দাবি করতে পারেন না এবং নিজের নামে এ গানের কপিরাইট নিতে পারেন না। কপিরাইট অফিসই-বা কোন যুক্তিতে তাকে গানটির কপিরাইট দিল, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

তারিকুল ইসলাম তপন বিনির্মিত ‘যুবতী রাধে’ গানটি হবহু লিরিকে ‘সর্বত মঙ্গলে রাধে’ শিরোনামে গেয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন ও চঞ্চল চৌধুরী। সরলপুরের চেয়ে আইপিডিসির এ গানটি নানা অর্থেই নান্দনিক। মেহের আফরোজ শাওনের গায়কীর ঢং এতই অসাধারণ যে, যেন খোদ রাধা লীলা করতে করতে গানটি গাইছেন। কোরাসও চমৎকার।

কিন্তু আইপিডিসি ঝামেলা বাঁধিয়েছে গানিটর কথা ও সুরকে ‘সংগৃহীত’ উল্লেখ করে। গানটির সুর যে সরলপুর ব্যান্ডের নয়, তাতে কোনো সংশয় নেই। এই সুর কীর্তনের সুর, বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুর। এ সুরের বিস্তর গান গ্রামবাংলায় শত শত বছর ধরে গীত হচ্ছে। ‘যুবতী রাধে’ গানটিও গ্রামবাংলায় গীত হচ্ছে। দশ-বারো বছর আগে মানিকগঞ্জ ও রাজশাহীতে পালার আসরে আমি এই গান গাইতে শুনেছি। পশ্চিম বাংলার নানা কীর্তনের আসরে গীত হচ্ছে। হয়ত পার্থ বড়ুয়া-শাওন-চঞ্চলও তাই ভেবেছেন যে, এটি তো ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান। তারা গানটির উৎস যাচাই করে দেখেননি। বলা যেতে পারে গানের কথাগুলো তারিকুল ইসলাম বিনির্মিত এবং সুর ঐতিহ্যবাহী। সেক্ষেত্রে আইপিডিসি যদি এভাবে উল্লেখ করত : “কথা বিনির্মাণ : তারিকুল ইসলাম তপন, সুর : সংগৃহীত”, তাহলে কোনো সমস্যাই হতো না, এত বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। কারণ আগেই বলেছি, এই ধারার গানের একক কোনো মালিকানা নেই। এর মালিক জনগণ, রাষ্ট্র। যে কোনো শিল্পী বা শিল্পীগোষ্ঠী নিজেদের মতো বিনির্মাণ করে এই ধরনের গান গাইতে পারবে।

কিন্তু একটা সমস্যা আছে। এখন তো আর আগের যুগ নেই। সংগীত আগের যুগে বাণিজ্য ছিল না। শিল্পীরা বাণিজ্যের উদ্দেশে গাইতেন না। তাদের সুরকে বিকৃত করলেও তারা কিছু মনে করতেন না। যেমন শাহ আবদুল করিমের কথা ধরা যাক। তাঁর অনেক গান বিকৃত সুরে গাওয়া হতো বা এখনো হয়। একবার প্রয়াত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য শাহ আবদুল করিমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়, আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না?’ উত্তরে শাহ করিম বললেন, ‘কথা বোঝা গেলেই হইল। আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই।’ কালিকাপ্রসাদ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘আপনার সৃষ্টি, আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে, আপনি কিছুই মনে করবেন না―এটা কোনো কথা, এটার কোনো অর্থ আছে!’ শাহ আবদুল করিম বললেন, ‘তুমি তো গান গাও, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে, কিন্তু গান শুনতে কোনো মানুষ আসেনি। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে। গাইতে পারবে?’ কালিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন, ‘না, পারব না।’ শাহ আবদুল করিম হেসে বললেন, ‘আমি পারব। কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই, সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক, নাম না থাকুক, সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই। সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি।’ কালিকাপ্রসাদ জানতে চাইলেন, ‘সেই আদর্শটা কী?’ শাহ আবদুল করিম আবার হেসে বললেন, ‘একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।’

কিন্তু সেদিন এখন আর নাই। সময় বদলে গেছে। শাহ আবদুল করিম যেমন বলেন : “করি যে ভাবনা/ সে দিন আর পাব না/ছিল বাসনা সুখি হইতাম/দিন হইতে দিন/আসে যে কঠিন/করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম।” শাহ আবদুল করিম বদলে যাওয়া সময়কে ঠিক ধরতে পেরেছিলেন। সেদিন আমরা হয়ত আর ফিরে পাব না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গানকে এখন আর কেউ আদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে নেয় না। গানও এখন বাণিজ্যিক পণ্য। এখন একটি গানে শুধু শিল্পসেবা থাকে না, বাণিজ্যও থাকে। বাণিজ্য থাকা দোষের কিছু নয়। ধরা যাক, আমি বাংলার সংগীতখনি থেকে একটি গান নিয়ে নতুন কালের নতুন শ্রোতাদের জন্য বিনির্মাণ করলাম, কিন্তু আপনি আমার বিনির্মিত গানটি হুবহু গাইলেন আমাকে কোনো ক্রেডিট না দিয়েই। তাতে তো আমি মেধাসত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হবো, বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এমন হলে তো আমি আর ঐতিহ্যবাহী গানগুলোর বিনির্মাণ করব না। না করলে ব্যাহত হবে বাংলা গানের রেনেসাঁস, বঞ্চিত হবে শ্রোতারা। তাহলে এই সমস্যা সমাধাণের উপায় কী?

উপায় হচ্ছে, যিনি এতিহ্যবাহী কোনো গানের বিনির্মাণ করবেন তিনিই গানটির কপিরাইট সনদ পাবেন। তবে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে নয়, বিনির্মাতা হিসেবে। সনদে উল্লেখ থাকবে এভাবে : “কথা : প্রচলিত এবং তারিকুল ইসলাম তপন বিনির্মিত। সুর : প্রচলিত।” যেহেতু এই ঐতিহ্যবাহী গানটি দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ, সেহেতু এই বিনির্মিত গানের লাভের একটি অংশ পাবে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক সংশ্লিষ্ট দপ্তর, আরেকটি অংশ পাবেন বিনির্মাতা। পরবর্তীকালে বিনির্মিত এ গানটি যদি হুবহু লিরিকে কেউ গাইতে চান, তাহলে বিনির্মাতার অনুমতি নিতে হবে, তার নাম উল্লেখ করতে হবে এবং মুনাফার একটি অংশ তাকে দিতে হবে। এছাড়া এ সমস্যা সমাধানের বিকল্প কোনো পথ নেই। সংগীতের বিকাশ হোক। সংস্কৃতির জয় হোক। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক