মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ৪১

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০২১

প্রিয় সখী ও সখাগণ, এখানে কারা কারা বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের বিরুদ্ধে, তারা হাত তোলেন। ওরে বাবা, সবাই দেখি হাত তুলেছেন! তার মানে আপনারা চান না বুড়িগঙ্গা নদী দূষিত হোক। এর পানি স্বচ্ছ থাকুক, পরিষ্কার থাকুক, টলটলে থাককু, তাই তো? আচ্ছা, কারা কারা ভাষা দূষণের বিরুদ্ধে, তারা এবার হাত তোলেন। এই দেখেন, কেউ হাত তুলেছে, কেউ তোলেনি; কেউ আবার অর্ধেক তুলেছে। এই অবস্থা কেন? বুঝতে পেরেছি। ভাষা দূষণ ব্যাপারটা কী, তা আপনারা সম্ভবত বোঝেনই না।

প্রিয় সখা, ভাষা হচ্ছে নদীর মতো। মানুষের মুখে মুখে বয়ে চলেছে নিরবধি। নদীতে শুধু পানি থাকে না। ফেনা থাকে, কচুরিপানা থাকে, খড়কুটো থাকে, লাকড়ি থাকে, গাছগাছড়া থাকে। কখনো কখনো মরা-পচা পাখপাখালি-কুকুর-বিড়াল-গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগিও থাকে। থাকে কিনা বলেন? থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। না থাকলে জনপদ দূষিত হয়। জনপদ রক্ষায় নদী এসব দূষণকে সাগরে ভাসিয়ে নেয়। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। না থাকলে সেটা আবার কেমন নদী? সেটা তো মিথের সেই অমৃত সরোবর, যে সরোবরের জল পান করলে অমরত্ব পাওয়া যায়।

কিন্তু আপনি যদি নদীতে অবৈধ বাঁধ দেন, নদী ভরাট করে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন, শিল্প-কারখানার সমস্ত বর্জ্য নদীতে ফেলেন, তাহলে নদী দূষিত হয়। দূষিত হতে হতে নদী মরে যায়। যেমন মরে গেছে তের শত নদীর বহু বহু নদী। নদী মরে গেলে কী হয় জানেন? উজানি ঢল আদিমাতা সাগরে গমণের পথ খুঁজে পায় না। তখন বন্যা হয়, প্লাবন হয়। সেই প্লাবনে জনপদের ঘর-গেরস্থালি ভেসে যায়। ফসলাদি, মাছ আর গবাদি পশুরা ভেসে যায়।

প্রিয় সখা, আপনার-আমার একটা আলাদা রূপ আছে না? যেমন আমার পাশে বসেছেন রমেশ ভাই, বাঁ পাশে হাজেরা আপা, পেছনে বসেছেন কালাম ভাই, সামনে আপনারা সখী ও সখারা সবাই। আমাদের একজনের চেহারার সঙ্গে আরেকজনের চেহারার কি মিল আছে? নাই। আমাদের প্রত্যেকের চেহারার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট আছে, আলদা আলাদ রূপ আছে, তাই না? ঠিক তেমনি বাংলা ভাষার একটা রূপ আছে, একটা বৈশিষ্ট আছে, একটা কাঠামো আছে। এই এই শব্দগুলো দেখে আমরা বুঝতে পারি এটাই হচ্ছে বাংলা ভাষা। যেমন বুঝতে পারি আরবি ভাষার শব্দগুলো দেখে, বা ইংরেজি-ফার্সি-আরবি-হিন্দি-উর্দু-তুর্কি ভাষার শব্দগুলো দেখে।

পেছন থেকে এক সখা প্রশ্ন করলেন, ‘বাংলা ভাষায় তো প্রচুর আরবি-ফার্সি-উর্দু-হিন্দি-তুর্কি-পুর্তগিজ, ইংরেজি ও সংস্কৃতি শব্দ ঢুকেছে। আপনি কি সেগুলো বাদ দেবেন?’ জি না সখা, বাদ দেব না। কেন বাদ দেব না জানেন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ কারা কারা পড়েছেন হাত তোলেন? বাহ, অনেকেই দেখি পড়েছেন। খুশি হলাম। ‘পদ্মানদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া কোথায় উপনিবেশ গড়ে তোলে? ময়নাদ্বীপে। কেতুপুর বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে যেসব মানুষ ময়নাদ্বীপে গেল তারা কিন্তু ময়নাদীপের ‘পরবাসী’ হয়েই গেল। কিন্তু এক বছর, দু-বছর, দশ বছর, কুড়ি বছর ময়নাদ্বীপে থাকার পর, তারা কিন্তু আর ‘পরবাসী’ থাকে না, তারা সেখানকার স্থায়ী বসিন্দা হয়ে যায়।

বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? আচ্ছা আরেকটা উদহারণ দিই। আপনারা ফেনী অঞ্চলে গেছেন কখনো? ফেনীর উত্তর অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর ভাগ আছে। যেমন দাঁদরাইল্লা, চাটিগ্রামী, হন্দুইপ্পা। যারা প্রচীন দাঁদরা অঞ্চলের অধিবাসী ছিল তারা দাঁদরাইল্লা, যারা চট্টগ্রাম থেকে এসেছে তারা চাটিগ্রামী, আর যারা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সন্দ্বীপ থেকে এসেছে তাদেরকে বলা হয় হন্দুইপ্পা। কিন্তু মোটাদাগে তারা সবাই বাঙালি। যেখান থেকেই আসুক না কেন, তারা এখন ফেনীর উত্তরাঞ্চলের স্থায়ী বসিন্দা। তাদেরকে এখন কেউ ‘পরবাসী’ বা ‘বাদাইম্মা’ বলে না। আগে কিন্তু বলতো। এখন স্থায়ী গেছে, তাই বলে না।

একদা এই বাংলায় ইরান-তুরান-আফগানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব মানুষ এসে বসতি পত্তন করেছিল, তারা এখন এই বাংলারই মানুষ। তাদেরকে এখন আমরা ‘অবাঙালি’ বলি না, ‘পরবাসী’ বলি না। তারা বাঙালিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। একইভাবে যেসব বিদেশি শব্দ বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে, কিংবা মিশেছে, কিংবা আমরা আমদানি করেছি, সেসব শব্দ এখন আর বিদেশি শব্দ নয়, সেগুলো দেশি শব্দই। তারা নিজেদের অস্তিত্ব বাংলা শব্দে বিলীন করে দিয়েছে, বাংলা শব্দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে, মিশে গেছে। শীব আর পার্বতীকে যেমন আলদা করা যায় না, তেমনি এই শব্দগুলোকেও আলাদা করা যাবে না। যেমন গেলাস, একাডেমি, চেয়ার, মোবাইল, টেলিফোন, বাবা, আম্মা, সেমিনার, মাইক, প্যান্ডেল...এরকম বিস্তর শব্দ। গুনে শেষ করা যাবে না। এরা ময়নাদ্বীপে এসেছিল। এসে স্থায়ী হয়ে গেছে। এদেরকে এখন আর ‘পরবাসী’ বা ‘বাদাইম্মা’ বলে দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না। দেওয়াটা অন্যায়, মূর্খতা।

প্রিয় সখা ও সখীগণ, এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে এখনও যদি বাংলা ভাষায় নতুন নতুন বিদেশি শব্দ ঢোকে সমস্যা কোথায়? না, কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো ভাষার শব্দই ঢুকতে পারে। বাংলা ভাষা এক অবরাতি মাঠ। এই মাঠে সকল শস্যই ফলে। বাংলা ভাষা এক বিস্তৃত নদী। এই নদীতে শুধু হিমালয়ের বরফগলা জল আসে না, আসামের জলও আসে, ত্রিপুরার জলও আসে। আবার উত্তর-ভারতের ‘পানি’ও ঢুকে পড়ে মাঝেমধ্যে। বাঙালি গ্রহণকারী জাতি। পৃথিবীর সকল ইতিবাচক জিনিসকে তারা গ্রহণ করে।

তবে খেয়াল রাখবেন, গ্রহণ করতে হলে কিন্তু বর্জনও করতে হয়। যেমন ধরুন, আপনাদের কার কার ফেসবুক আইডি আছে হাত তোলেন। ও বাবা, সবার আছে দেখছি! কোণার দিকে এক সখা হাত তোলেননি। তার মনে হয় আইডি নাই। তিনি মুরুব্বি মানুষ, না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাদের যাদের আইডি আছে, আপনাদের একেক জনের বন্ধুসংখ্যা কত? সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার, তাই তো? আপনারা পৃথিবীর নানা দেশের মানুষকে ফেসবুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এখন আপনি রাশিয়ার একজনকে বন্ধু হিসেবে নিতে চান। কিন্তু আপনার বন্ধুসংখ্যা পাঁচ হাজার পূর্ণ। নতুন কাউকে নিতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? কোনো এক বন্ধুকে আনফ্রেন্ড করে দিতে হবে, তাই না? এটাকেই বলে বর্জন। কথা কিলিয়ার? [ক্লিয়ার নয় কিন্তু, কিলিয়ার] এই বর্জনটা না করলে আপনি নতুন বন্ধু নিতে পারবেন না।

সখী, ভাষাও তেমনি। কোনো কোনো শব্দ যদি বর্জন করতে না পারেন, তবে নতুন শব্দ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু সেই বর্জন কি জোর করে করবেন? জবরদস্তিমূলকভাবে করবেন? গ্রহণও কি জোর করে করবেন? না, জবরদস্তি করলেই সমস্যা এসে সামনে দাঁড়ায়। যেসব শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা ভাষায় ঢুকবে, আপনি সেগুলোকে অনায়াসে গ্রহণ করবেন। কিন্তু ইচ্ছে করে কতগুলো বিদেশি শব্দকে বাংলা ভাষায় আমদানি করে বলবেন, ‘ভাষা হচ্ছে নদীর মতো, ভাষাতে যে কোনো শব্দ ঢুকতেই পারে, তাতে সমস্যার কিছু দেখি না।’ এমনটা যদি বলেন, তাহলেই আপনার সাথে আমার দ্বন্দ্ব আছে। এমনটা যদি আপনি করতে থাকেন, তাহলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বাংলা ভাষার রূপ বলতে, স্বকীয়তা বলতে আর কিছু থাকবে না। দখল হয়ে যাবে, যেমন দখল হয়ে যায় নদী। বাংলা ভাষা মরে যাবে, যেমন মরে যায় নদী। পৃথিবীর বহু ভাষা কিন্তু মরে গেছে, মরে যাচ্ছে। আপনি চান বাংলা ভাষাও মরে যাক?

প্রিয় সখা, আরেকটা উদাহরণ দিই, শোনেন। এই উদাহারণে আপনারা আবার আমাকে বর্ণবাদী, রোহিঙ্গা-বিদ্বেষী, রেসিস্ট বলবেন না যেন। কক্সবাজার অঞ্চলে মায়ানমারের প্রচুর রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, আপনারা তো জানেন। তাতে কী হয়েছে জানেন? স্থানীয় বাঙালি বা অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর যারা আছেন তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে গেছে। তাদের আয়-রোজগারের বিস্তর পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন তাদের অস্তিত্ব নিয়ে বিপন্নতায় ভুগছে। এখন কী করতে হবে? রোহিঙ্গাদের সসম্মানে তাদের নিজেদের দেশ মায়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে হবে।

যেমন আমরা ফেরৎ পাঠিয়েছিলাম পর্তুগিজদেরকে, মগ-ফিরিঙ্গি, তুর্কি, আফগান, বৃটিশ ও পাকিস্তানিদেরকে। কেন ফেরত পাঠিয়েছিলাম? কারণ এই দেশ আমার, আমাদের। আমাদের দেশে বিদেশিরা এসে কেন শাসন-শোষণ করবে? আমাদের ভূমি আমরাই শাসন করব। কিন্তু, আগেই বলেছি, যেসব বিদেশি এখানে এসে আমাদের সঙ্গে মিশে গেছে, একাত্ম হয়ে গেছে, তাদেরকে আমরা ফেরৎ পাঠাইনি। কারণ তারা আমাদেরই হয়ে গেছে। একইভাবে বিদেশি শব্দকে যদি বাংলা ভাষায় বেশি পরিমাণে ঠাঁই দেন, আমদানি করেন, তখন এ ভাষার শ্রী নষ্ঠ হয়ে যাবে। এই ভাষায় বিদেশি ভাষার আধিপত্য প্রাতিষ্ঠা পাবে। বিদেশি শব্দরাই এ ভাষাকে শাসন করবে। তা কি আপনারা চান? কে কে চান হাত তোলেন। এ কি! এবার দেখি কেউ হাত তুলছে না। তার মানে ভাষা দূষণ কী জিনিস, তা আপনারা বুঝে গেছেন।

আরেকটা কথা, বাংলা ভাষাকে এত গরিব, এত শক্তিহীন, এত শ্রীহীন, এত নাজুক ভাবার কোনো কারণ নেই। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’টা পড়ে দেখবেন সময় পেলে। বুঝবেন বাংলা শব্দভাণ্ডার কত সমৃদ্ধ। পারলে রাজশেখ বসুর ‘রামায়ণ’ আর কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘মহাভারতটা’ও পড়ে দেখবেন। তখন বুঝবেন বাংলা ভাষা কত ধনী।

ওদিকে এক সখা আমার দিকে চোখ পাকাচ্ছেন। কেন চোখ পাকাচ্ছেন বুঝতে পেরেছি। আপনার উদ্দেশে বলি, শোনেন। আপনি আপনার এসব গুপ্তধন দেখেন না, দেখেন পরের ধন। কারণ আপনি পরের ধনে পোদ্দারি করতে ভালোবাসেন। আর আপনার ভেতরে আছে ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা। আপনি শাসিত হতে হতে...হতে হতে...হতে হতে ভুলেই গেছেন যে, আপনারও একটা অস্তিত্ব আছে, স্বকীয়তা আছে, বৈশিষ্ট আছে। সখা, নিজের কোমরের উপরে দাঁড়ান। আপনি ভাবছেন আপনার মেরুদণ্ডটা দুর্বল। আসলে কিন্তু দুর্বল না। একবার উঠে দাঁড়ান। হাঁটা শুরু করুন। দেখবেন আর লাঠির সহায়তা লাগছে না।

আমার বক্তৃতা শেষ। সখী ও সখাগণ, আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ভালোবাসা। চলবে