মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘এটা একপ্রকার খেলা’
প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০২০
দেশসুদ্ধ লকডাউন খুলে গেলেও আঞ্জু আপার বাসার লক খোলেনি। তিনি বাইরে থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে তালা ঝুলিয়ে ঘরের ভেতর বসে আছেন। কিছুতেই বেরোবেন না। বাইরে হলুদ রাধাচূড়া তরল আগুনের মতো ফুটে আছে, টুনটুনি-বুলবুলি কিচিরমিচির করছে শাখে শাখে, একটা শান্ত পুকুরের জলে হিজল ফুল ভেসে যাচ্ছে, মেঘ উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও, হঠাৎ ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল, বালকের দল নেমে পড়ল ফুটবল নিয়ে। এসব হৃদয়হরণী দৃশ্যের কিছুই দেখবেন না আঞ্জু আপা।
বললাম, ঠিক আছে। তুমি বের না হতে চাইলে না হও। আমি আসি তোমার বাসায়। গল্প গুজব করি। তালা খোলো, আপা।
আপা তাতেও রাজি না। বললেন, ভিডিও কল দে। ভিডিওতে গল্প গুজব করি। দেশটা যে ডিজিটাল হইল, তার সুফল তো ভোগ করা উচিত নাকি?
তথাস্তু বলে ভিডিও কল দিলাম।
আপা দেখি আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছেন। নাকের উপর বিচিত্র রঙের মেছতাটা নেই। গাল দুটো ফোলা ফোলা। নিটোল মুখ। টসটসে চোখ, বেতফলের মতো। কিন্তু ম্লান। জীবনানন্দের কবিতার মতো— বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ…
আমার মনে হলো, আপা কেঁদেছেন একটু আগে। কিন্তু কেন, সেটা জিজ্ঞেস করতে পারি না। সব প্রশ্ন সব সময় জিজ্ঞেস করা যায় না। আমাদের আব্বার পাঞ্জাবির পেছনটা কেন সব সময় কুচকে থাকত, কেন আমাদের আব্বা চারবার ছিঁড়ে যাওয়া স্যান্ডেলটা আবারও পঞ্চমবারের মতো মুচির কাছে নিয়ে যেতেন সেলাই করতে, আমাদের মা কেন সারা বছর দুইটা ত্যানার মতো শাড়িই পরে থাকতেন—এসব প্রশ্ন কোনোদিন করতে পারি না। করা যায় না।
আপাই কথা শুরু করলেন, দেখেছিস নাকি?
আমি বললাম, কী?
আপা বললেন, ফেসবুকে একটা হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখিসনি?
ও হ্যাঁ, দেখেছি। কেরালায় একটা হাতিকে আনারসের মধ্যে পটকা নাকি বাজি ঢুকিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলেছে! কী নৃশংস, দেখেছ আপা? মানুষের মনে এত হিংস্রতা! এত ঘৃণা!
আপা হাসলেন, ঘৃণা বা হিংস্রতা থেকে মানুষ এই কাজ করেছে বলে আমার মনে হয় না।
বলো কি আপা?
আঞ্জু আপা বললেন, শোন। পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রাণীই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করে। কাণ্ডজ্ঞানের আরেক নাম কমন সেন্স, বুঝেছিস? আমার ধারণা, মানুষের চেয়ে কম কমনসেন্সঅলা প্রাণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই যে একপাল মানুষ আনারসের মধ্যে পটকা ঢুকিয়ে হাতিটাকে খাইয়ে মেরে ফেলল, এটা স্রেফ কাণ্ডজ্ঞানহীনতা আর সীমাহীন কৌতূহল। তারা মনে করেছে, দেখি তো হাতিটা এই আনারস খায় কিনা? খেলেই বা কী হয় দেখি তো? পেটের মধ্যে কী পটকা ফুটবে? ফুটলেই বা কী হবে দেখি তো? এসব কাণ্ডজ্ঞানহীন কৌতূহলের কারণেই তারা এই কাজ করেছে। এটা এক ধরনের খেলাও।
আমি কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। এ কেমন কৌতূহল! এ কেমন খেলা! ছোটবেলায় পড়া একটা গল্প মনে পড়ল। কয়েকজন বালক একটা পুকুরে ঢিল ছুড়ছিল। সেখানে ছিল একটা ব্যাঙ। ঢিলগুলো গিয়ে লাগছিল ব্যাঙের শরীরে। বালকদের কাছে যা খেলা, ব্যাঙের কাছে তা-ই জীবন-মরণ।
আপা আবার কথা শুরু করলেন, মুশকিলটা কী জানিস? মুশকিল হচ্ছে, এই কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রাণীর সংখ্যাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। ছয়শো কোটি। ভাবতে পারিস? পৃথিবীর সমস্ত বাঘকে জড়ো করলেও ছয়শো কোটি হবে না। পৃথিবীর সমস্ত হরিণকে জড়ো করলেও ছয়শো কোটি হবে না। পৃথিবীর সমস্ত কুমিরকে এক জায়গায় জড়ো করলেও ছয়শো কোটি হবে না। পৃথিবীর কোনো প্রাণীই আসলে এত বিপুল নয়। কেবল মানব প্রজাতিই এত বিপুল, বিশাল। আরও মুশকিলের বিষয় হচ্ছে, এই স্বল্পবুদ্ধির কাণ্ডজ্ঞানহীন মনুষ্য প্রজাতি আবার নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে!
আমি আবারও কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল চোরকাঁটার ঝোপের মতো। বললাম, এখন রাখি আপা। আবার পরে কথা বলব।
























