
মাহবুব মোর্শেদ
মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘মানুষ আসলে কেন লেখে’
প্রকাশিত : আগস্ট ০২, ২০২১
আমি কেন লিখি, আপাত অর্থে খুব নিষ্পাপ একটা প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তরটা আমাকে জানতে হবে। আমার লেখার কী দরকার সেটাও জানা থাকতে হবে।
আমাদের ছোটবেলায় পত্রিকাগুলো `কেন লিখি` জাতীয় সংখ্যা বের করতো। তাতে দেশ-বিদেশের লেখকরা কেন লেখেন তা প্রবন্ধ আকারে বলতেন। আমি ওই লেখাগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ার পরেও এবং অনেকদিন নিজে লিখেও ঠিক বুঝতে পারিনি, লেখক আসলে কেন লেখেন।
এতদিন পর সেগুলো ভাবতে বসলাম। আগে পড়া লেখাগুলোতে লেখকরা আসলে কী বলেছিলেন, মনে করার চেষ্টা করলাম। লেখকরা আসলে কেন লেখেন?
কোনো কোনো লেখকের কাছে লেখা আত্মপ্রকাশের একটা মাধ্যম। লেখা ছাড়া আর কোনোভাবেই লেখক নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না ৷ সমাজের কাছে নিজেকে বোঝাতে পারছেন না ৷ ফলে তিনি লেখাকেই আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন ৷ নিজের ভাবনা, যা তিনি বলতে পারেন না, একে দেখাতে পারেন না, অন্যভাবে প্রকাশ করতে পারেন না, তা লিখে প্রকাশ করছেন। জানাচ্ছেন। তাদের কাছে মনে হয় লেখা যদি না থাকে তাহলে তারা নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। নিজেকে আর ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। সমাজের সামনে, বৃহত্তর সমষ্টি সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবেন না।
আরেকদল লেখক মনে করেন, লেখা তাদের প্রবৃত্তির অংশ। এই বিশ্বজগৎ পরিপার্শ্ব সমাজ-সংসার সংস্কৃতি তাদের সামনে কখনও কবিতা কখনও গল্প কখনও উপন্যাস কখনও গদ্য আকারে হাজির হয় ৷ বিষয়গুলো তাদের কাছে যেভাবে হাজির হয় সেগুলোকে সেভাবে প্রকাশ করা তাদের কাছে আবশ্যক মনে হয়। তাদের কিছু বলার আছে৷ এই বলার আকাঙ্ক্ষাটাই তাদের প্রবৃত্তি। একসময় হয়তো তারা জানতেন না, লিখে নিজেকে প্রকাশ করা যায়! কিন্তু ধীরে ধীরে তারা এটা আবিষ্কার করে ফেলেন এবং এতে স্বচ্ছন্দ অনুভব করেন। ধীরে ধীরে লেখার সাথে অভ্যস্ততা লেখাকে তাদের প্রবৃত্তির অংশ করে দেয়।
কোনো কোনো গল্পকারের কাছে গল্প বলা বা স্টোরি টেলিং সবচেয়ে বড় ঘটনা৷ তারা নিজের গল্প বলেন, অন্যের গল্প বলেন। চলতে ফিরতে যে গল্প পাওয়া যায় সে গল্পগুলো সংগ্রহ করে সেগুলোকে উপন্যাস আকারে প্রকাশ করেন। বলতে গেলে সমস্ত কিছুই তাদের কাছে গল্প হিসেবে হাজির হয়। এই স্টোরি বলার জন্য তারা লেখাকে অবলম্বন হিসেবে বেছে নেন।
অনেকের কাছেই লেখা খ্যাতি অর্জনের উপায়। লিখে নাম কামানো যাবে, সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করা যাবে এসব তাদের মাথায় থাকে। অনেক লেখক একথা অকপটে বলেছেনও। আবার কেউ কেউ হয়তো খ্যাতির জন্য লেখেন, কিন্তু মুখে বলেন সমাজসেবার জন্য, মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি কলম ধরেছেন।
আমাদের চেনা পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই লেখেন সমাজ পরিবর্তনের জন্য। তাদের কাছে মনে হয়, লেখার মধ্যদিয়ে তারা সমাজের রূপান্তর ঘটাবেন। যে সমাজটা আছে সেই সমাজ ভাঙচুর করে নতুন সমাজ জন্ম দেবেন। অনেকের কাছে লেখা বিপ্লবের অবলম্বন।
ল্যাটিন আমেরিকার উপন্যাসিক ইসাবেল আয়েন্দে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি শুধু তার মায়ের জন্য লেখেন। লেখার সময় পাঠক হিসেবে শুধু মায়ের কথাই মনে হয় তার। কোনো কোনো লেখকের একজন পাঠকের জন্য লেখেন। কোনো কোনো লেখক হাজার হাজার পাঠকের জন্য লেখেন। কেউ হয়তো প্রেমিকাকে খুশি করার জন্য শুধু তার জন্যই লেখেন। কেউ হয়তো অমরত্ব প্রত্যাশী। নিজের মৃত্যুর পর লেখা তাকে অমর করে রাখবে, সেই প্রত্যাশা মনের গহীনে থাকে বলে তিনি লিখে চলেছেন। আশা যে, তার মৃত্যুর পর এই লেখাগুলো কেউ পড়বে, তাকে নিয়ে আলোচনা করবে, তিনি পাঠকের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
কেউ লেখেন অজানা পাঠকের উদ্দেশ্যে, যাকে তিনি জানেন না চেনেন না। কিন্তু সেই পাঠক কোনো এক একাকী নির্জন নিঃসঙ্গ সময়ে তার বইটা খুলে তার গল্পটা তার কবিতাটা পড়তে থাকবেন, তাকে মনে করবেন। এই যে অজানা অচেনা মানুষটির সামনে নিজেকে মেলে ধরা, এই বিশিষ্ট ঘটনাটা ঘটানোর জন্যই কেউ কেউ লেখেন। কেউ হয়তো লেখেন ইচ্ছা পূরণের জন্য। একজন লেখক বলেছিলেন, তিনি যা হতে পারেননি, যা হতে চেয়েছেন তা-ই তিনি লেখার মধ্যদিয়ে পূরণ করতে চান। লেখা তার ইচ্ছা পূরণের মাধ্যম।
কেউ হয়তো লেখার মধ্য দিয়ে কল্পনার, রূপকথার এক অজানা জগতে চলে যেতে চান। কল্পনার মধ্যে ভ্রমণ করতে চান। কেউ কেউ টাকা কামানোর জন্য লেখেন। অনেক লেখক অকপটে স্বীকার করেছেন, তারা টাকা কামানোর জন্য লেখেন। লিখলে বই বিক্রি হয়, পত্রিকা থেকে টাকা দেয়। তাই পেট চালানোর জন্য, বড়লোক হওয়ার জন্য, সচ্ছল জীবন যাপনের জন্য তারা লেখেন।
লেখার পেছনে এমন হাজারো কারণ থাকতে পারে। প্রত্যেকের জন্য লেখার আলাদা কারণ, আলাদা অনুপ্রেরণা, আলাদা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু একজন লেখক যখন এই প্রশ্ন তোলেন যে, যিনি লিখবেন তিনি জানবেন, কেন লেখেন, তখন লেখককে আসলে ওই প্রশ্নের মুখোমুখি ফেলে দেয়া হয় যা তিনি জানেন না। হয়তো তার অবচেতন জানে, তার ব্যক্তিগত ইতিহাস জানে। তার বেড়ে ওঠার সময় কোনো একটা ঘটনার অভিঘাত তাকে লেখক হিসেবে তৈরি করে দেয় কিংবা তার ব্যক্তিত্বের ধরনের মধ্যে তার আত্মপ্রকাশের সমস্যার মধ্যে কিংবা কোনো সংকট তাকে লেখক হিসেবে তৈরি করে দেয়।
একজন লেখক আমাকে বলেছিলেন, তিনি তার বাস্তব থেকে পালাতে চান। এর অবলম্বন হিসেবে, পালানোর উপায় হিসেবে তিনি লেখাকে বেছে নিয়েছেন। কোনো কোনো লেখক জীবনের সংকটময় সময়ে লেখা শুরু করেছেন। এখন আমি কি করতে পারি? আমার তো করার কিছু নাই? এই সময়ে তিনি হয়তো লেখা শুরু করেছেন আর লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। হয়তো ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
কেউ কেউ বিষণ্ণতা থেকে উত্তরণের জন্য লেখাকে বেছে নেন। যখনই বিষণ্ণ হন তখন লেখার মধ্যে ডুবে যান, লেখার চরিত্রগুলো, ঘটনাবলি, গল্প নির্মাণ তাকে নিজস্ব বিষণ্ণতা থেকে বের করে নিয়ে আসে। তিনি অন্য এক জগতের মধ্যে ঢুকে যান। তার জন্য লেখাটা একটা শুশ্রুষা, একটা হিলিং।
সত্যি কথা হলো, আজকের দুনিয়ায় যত মানুষ লেখে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ লেখে না। যারা লেখে না তারা কি অপরাধ করে? এইসব সমস্যা সমাধানের অন্য উপায় নিশ্চয়ই তাদের আছে। তারা হয়তো পড়ে, সিনেমা দেখে, ভ্রমণ করে, বন্ধুদের সাথে কথা বলে, চ্যাট করে, ফেসবুকে আড্ডা দেয়, স্ট্যাটাস দেয়। মনোবিদদের শরণাপন্ন হয় কিম্বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যায়, কনসার্ট দেখে, শপিং করে। নানা উপায়ে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে, সমাজের মধ্যে নিজের অবস্থান জানান দেয়। লেখার বাইরে হাজারটা শিল্পচর্চা করে।
এখন আমরা যদি বলি, লেখককে জানতে হবে কেন তিনি লেখেন ৷ তাহলে ওই প্রশ্নের মধ্যে, ওই বলার মধ্যে এক ধরনের জবরদস্তি প্রকাশ পায়। যেন লেখক একটা অত্যাচারের কাজ করছেন। তার লেখার কথা ছিল না অথচ তিনি অযাচিতভাবে লিখছেন। লিখে লিখে আবর্জনা সৃষ্টি করছেন। ভালো লিখতে পারছেন না। তাকে থামানো উচিত। এমন একটা প্রশ্ন মুখের উপর ছুড়ে দিতে পারলে তারা হয়তো উত্তর দিতে না পেরে থেমে যাবে। কিন্তু আমরা একটা প্রশ্ন করি না, এই দুনিয়ায় এত হাজার হাজার কাজ থাকতে একজন মানুষ কেন লিখতে যাবে? নিশ্চয়ই তাকে কোনো না কোনো ভূত কামড় দিয়েছে।
আড্ডা-গুলতানি না মেরে, আর দশজন মানুষের মতো অফিস বাসা ফ্যামিলির শান্তির পথে না গিয়ে, অনিশ্চিত লেখালেখির জীবন মানুষ কেন অবলম্বন করে! লেখালেখি করতে এসে কেন অনর্থক নানান রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়? নানা উপদলে ভাগ হয়ে যায়, নানা মতবাদে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! টাকা বানানোর পথে না গিয়ে, ভালো থাকার পথে না গিয়ে, স্রেফ খ্যাতির জন্য লেখালিখির মতো একটা কষ্টকর প্রকাশ মাধ্যম মানুষ বেছে নেয়? মানুষ আসলে কেন লেখে?
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী