মাহির ফয়সাল শুভর কলাম ‘দুই বাংলার বাঙালি সংস্কৃতি’

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২০

ইতিহাস ও ধর্ম বাঙালি সংস্কৃতিকে দ্বি-বিভক্ত করে ফেলেছে। ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় সেকারণেই বাঙালি সংস্কৃতির মাথা কলকাতায়, কিন্তু পা রয়ে গেছে বাংলাদেশে। পা নিয়ে বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি গতিশীল বটে, তবে গতিপথ ঠিক নেই। কারণ মাথাবিহীন বাংলাদেশি বাঙালি সংস্কৃতি চলার পথে ভালো-মন্দ যা-ই পায়, সেটাকেই আঁকড়ে ধরে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির সংকরায়ণ ঘটছে। প্রতিনিয়ত যেখানে বাঙালিয়ানার মাত্রাটাই কমে আসছে এবং যার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিহ্নপ্রায়।

আমরা মুণ্ডুহীন বাংলাদেশি বাঙালিরা গতিপথ পাল্টিয়ে এতটাই পশ্চিমামুখী হয়ে পড়েছি যে, নিজেদের জাতীয় পোশাক লুঙিতেও আমাদের সংকোচবোধ আসে। আবার, ভাষার জন্য এখানে প্রাণ বলিদান দেয়া হয়েছে বটে, অথচ ভাষার বিকৃতি এখানেই বেশি। অন্যদিকে পা-বিহীন কলকাতার দিকে নজর দিতে গেলে দেখা যাবে, তাদের অবস্থা অচল বৃদ্ধের মতো যারা প্রতিনিয়ত নস্টালজিয়াতে ভোগে। পা না থাকায় কলকাতার বাঙালি সংস্কৃতি স্থিতিশীল, অথচ প্রায় সম্ভাবনাহীন।

কলকাতার বাঙালি সংস্কৃতি অনেকটাই সংকীর্ণ। কারণ এখানে বাঙালি সংস্কৃতির সংজ্ঞায়নের প্রায় পুরোটো জুড়েই হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি। সংকরায়ণকে অস্বীকৃতি জানালেও সংকরায়ণ এড়ানো অসম্ভব। কারণ কি? কারণ অতি সহজ। সময়ের চাহিদা। নাহ, বিষয়টা এমনও নয় যে, নিজের সংস্কৃতির পুরোটা বিকিয়ে দিয়ে পুরোপুরি সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে নিজের সংস্কৃতিকে আধুনিক প্রমাণ করবার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে। তবে সময়ের চাহিদায় আধুনিকায়নের স্বার্থে একটু আধটু সংকরায়ণ হলে তো তাতে দোষের কিছু নেই। নতুনত্ব গ্রহণ না করতে পারলে সময়ের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখা বেশ কষ্টকর।

বাঙালি সংস্কৃতি কোথায় বেশি শোভামণ্ডিত এবং নিরাপদ? কলকাতায় নাকি বাংলাদেশে? এই প্রশ্নের একপাক্ষিক উত্তর বের করা বেশ কঠিন, তাতে আমরা যতই কসরত করি না কেন। মাথা ও পায়ের উপমাটা এজন্যই বেশ কার্যকর হয়তোবা। মাথাবিহীন বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি এতটাই উদারপন্থী (প্রধানত পশ্চিমামুখী) যে, এখানে বাঙালি সংস্কৃতি সংকরায়ণের পরিক্রমায় এবং আকর্ষণীয় আধুনিকতার মোহে পড়ে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রায় পুরোপুরিভাবেই। এ আধুনিকতা কি বাংলাদেশি বাঙালিদের মননে ও চিন্তাধারার উন্নয়নে আদৌও কোনো ভূমিকা রেখেছে?

তবে আশার কথা এই যে, বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির গৌরবান্বিত ইতিহাস কলকাতার তুলনায় কম হলেও, আমাদের এখনও ভবিষ্যত আছে। আর কলকাতা! এখানে রয়েছে পা-বিহীন খোঁড়া অতীত আভিজাত্যের দম্ভ; নতুনত্বকে প্রায় পূর্ণ অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে যার ফলে এই সংকীর্ণমনতা বাঙালি সংস্কৃতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জন্য একধরণের বাধাই বটে। কলকাতার বাঙালি সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বেশি থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ হয়তোবা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। ভাষা বাঙালি হলেও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা এবং তা তুলে ধরার সুযোগ সেখানে কম। কারণ পশ্চিমবঙ্গ শুধুমাত্র একটি রাজ্য।

যেখানে কিনা বাংলাদেশে বাংলাই আমাদের জাতীয়তা। সুতরাং বিস্তর এই পরিসরকে বাঙালি সংস্কৃতির স্বার্থে আমরা সঠিকভাবে কতটা ব্যবহার করতে পারি, সেটাই দেখবার বিষয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এক্সেপ্টেন্স দরকার পরিমিত মাত্রায়। মাত্রা বেশি হলে নিজেকেই হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে, বাঙালি সংস্কৃতিকে এরকম একটি প্যারামিটার ধরেই হয়তো এগোনো প্রয়োজন টিকে থাকবার জন্য।