মুসলিম উম্মাহর কর্মপন্থা ও করণীয়

তারেকুজ্জামান তারেক

প্রকাশিত : জুন ২২, ২০২০

আমাদের দেশে একটি প্রবাদ বাক্য আছে, শক্তের ভক্ত নরমের যম। কথাটি পুরোপুরিই সত্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো জাতি ও সভ্যতা পাওয়া যাবে না, যারা শক্তি প্রয়োগ না করে শুধু আদর্শের বাণী শুনিয়ে অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি আনতে পেরেছে। আদর্শবিহীন শুধু শক্তির প্রয়োগ জুলুমের বিস্তৃতি ঘটায়, আর শক্তিবিহীন শুধু আদর্শের বাণী প্রচার নিষ্ফল ঘাম ছুটায়। উভয়ের মাঝে যথাযথ সমন্বয় না করে যারাই শান্তির আশা করেছে, সবাই-ই ব্যর্থতার চূড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করেছে। এজন্যই ইসলাম এ দুয়ের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ মিল ও সমন্বয় সাধন করেছে। যেখানে কঠোরতার প্রয়োজন, সেখানে কঠোরতার পূর্ণ রূপ দেখিয়েছে, আর যেখানে হৃদ্যতা ও সখ্যর দরকার, সেখানে দয়া ও মেহেরবানির সব দরজা খুলে দিয়েছে।

ইতিহাসে এর নজিরের অভাব নেই। কুরআনে এ দুটি গুণকে একটি বাক্যে ব্যক্ত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তাঁর সাথিরা কাফিরদের প্রতি কঠোর, আর নিজেদের মধ্যে পরস্পরে সহানুভূতিশীল। (সুরা আল ফাত্হ ২৯)

সুতরাং মুসলিম উম্মাহ যতদিন পর্যন্ত এ দুটি গুণ পুরোপুরি অর্জন করতে পারবে না, ততদিন তারা যত কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন, সফলতা ও বিজয়ের মুখ দেখবে না। বিজয় অর্জন করতে হলে অবশ্যই তাদেরকে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে এবং নিরলসভাবে সে পদ্ধতিতে কাজ করে যেতে হবে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ লোক গাফিল ও উদাসীন থাকলেও গুটিকয়েক মানুষ কিন্তু ঠিকই আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। শাখাগত দিক হিসেবে এসব মানুষ নানা দল-উপদলে বিভক্ত হলেও মৌলিকভাবে সবাই দুটি শ্রেণির মাঝেই সীমাবদ্ধ।

এক. যারা তথাকথিত শৃঙ্খলা বজায় রেখে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বহাল রেখে, মুসলিম ও কাফির সবাইকে সন্তুষ্ট রেখে নিজেদের অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করছে। যেমন, গণতান্ত্রিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টারা। এরা মনে করে, এভাবেই রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণ উপায়ে একদিন পুরো বিশ্বে ইসলামি হুকুমত কায়েম হবে। কিন্তু আফসোস ও হতাশার ব্যাপার হলো, এ পদ্ধতির সূচনাকাল আজ প্রায় শতবর্ষ হতে চলল, তথাপিও তারা পৃথিবীর কোথাও আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা আজ যাদের চোখের সামনে, তারা ভালো করেই জানে যে, এভাবে কোনোদিনই তারা সফল হতে পারবে না। ইতিহাস বলে, একটি আন্দোলন শুরুর প্রথম পঞ্চাশ বছরেই সাধারণত তার সফলতা বা ব্যর্থতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ইসলামি গণতন্ত্র নামের নিকৃষ্ট একটি পরিভাষার আলোকে গঠিত এ আন্দোলনের প্রায় শতাব্দীকাল পার হতে চলল, তারপরও সফলতার সামান্য ঝিলিকও কি কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে? বিবেকবানদের জন্য এতটুকুই কি যথেষ্ট নয়? উম্মাহর জন্য একশো বছর কি খুব কম সময় মনে হয়? এ থেকে কি ফিরে আসার সময় এখনো হয়নি? বিবেকবান ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের জন্য এর বেশি বিশদ বিবরণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

দুই. যারা পেঁচানো পথ পরিহার করে শরিয়ার সরল ও অনুসৃত পদ্ধতি কিতালকে গ্রহণ করেছে। এরা মনে করে, আদর্শের বাণী অন্তরে লালনের পাশাপাশি শক্তি প্রয়োগের বিকল্প নেই। কেননা, পৃথিবীতে যেমন আল্লাহর মুখলিস বান্দারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন চায়, ঠিক তেমনই শয়তানের অনুসারীরা পৃথিবীতে শয়তানের আইন কামনা করে। এমতাবস্থায় দুটি দলের মাঝে যুদ্ধ অনিবার্য। অতএব নিশ্চিত যুদ্ধকে সামনে রেখে কোনো বুদ্ধিমান লোক শুধু আদর্শের প্রচারকে যথেষ্ট মনে করতে পারে না। এজন্য চাই এমন বিনাশী শক্তি, যা শয়তানের সকল চক্রান্ত সমূলে উৎখাত করে দেবে। এ দর্শনকে মূল বানিয়ে তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছেন। আর এটাই সঠিক ও নিখুঁত পদ্ধতি। কেননা, আদর্শবিহীন শুধু শক্তির প্রয়োগ জুলুম হলেও আদর্শের বাণী বক্ষে ধারণ করে শক্তি অর্জন ও প্রয়োগ শুধু বৈধই নয়; বরং সর্বোত্তম কাজ ও ক্ষেত্রবিশেষে আবশ্যকও বটে। যেমনিভাবে একজন মা তার শিশু সন্তানের অসন্তুষ্টি ও কান্না সত্ত্বেও জোর করে তাকে খানা বা ওষুধ খাইয়ে দেয়। এটা বাহ্যিক দৃষ্টিতে জুলুম হলেও প্রকৃত অর্থে এটাই তার জন্য কল্যাণকামনা। আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য কিতালের মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিও ঠিক অনুরূপই।

তবে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি যেহেতু খুবই সেন্সিটিভ ও দায়িত্বপূর্ণ একটি কাজ, তাই এতে পূর্ণ সতর্কতা কাম্য। এতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিঘ্ন ঘটলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যেমনটি ইরাক ও সিরিয়া অঞ্চলের কিছু মানুষের কর্মকাণ্ডে পরিলক্ষিত হয়েছে। শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে তারা অনেক সীমালঙ্ঘনও করে ফেলেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন ও সঠিক পথে পরিচালিত করুন। তবে এর বিপরীত বড় একটি জামাত রয়েছে, যারা মাশাআল্লাহ আদর্শ ও শক্তির ভারসাম্য ঠিক রেখে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আল্লাহ তাদের কাজে আরও বারাকাহ দান করুন এবং সব ধরনের বিচ্যুতি থেকে তাদের রক্ষা করুন।