মেমসাহেব উপন্যাসের প্রচ্ছদ হেঁটে যাচ্ছে

পর্ব ১৪

প্রকাশিত : মে ০৬, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ১৪ পর্ব।

৩০ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার
শুক্রবারে ইচ্ছে করেই অনেক বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকি। ঘুম যে হয়, তা নয়। অনেক সকালেই ঘুম ভেঙে যায়, তারপরও চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকি। মনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করে। সারা সপ্তাহ সকালে না ঘুমাতে পারার প্রতিশোধ। মনে মনে বলি, দ্যাখ শালা শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহস্পতি দ্যাখ! কীভাবে সকালে ঘুমাতে হয় দ্যাখ।

প্রতিশোধ পর্ব শেষ করে বেলা এগারোটা নাগাদ বিছানা ছাড়ি। ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে ভাবি, সকালের দিকেই যা একটু টাটকা সবজি টবজি পাওয়া যায়। যাই, বাজার থেকে একটু ঘুরে আসি। এত গরম পড়েছে! এত রোদ! চোখ মেলে তাকানোই দুষ্কর। গত বছরও প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। `পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা` টাইপের নিউজ ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। এ বছর এখনো এ ধরনের নিউজ চোখে পড়েনি। তবে দুই এক দিনের মধ্যেই পড়বে বলে মনে হচ্ছে। সঙ্গে `গলে যাচ্ছে হিমালয়ের বরফ, ডুবে যাবে দক্ষিণ এশিয়া` টাইপের নিউজও থাকবে।

এ ধরনের বরফগলা খবর দেখলেই আমার মনে পড়ে, ‘যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ একদিন গলেও যায়, তবুও তুমি আমার’ গানটা। মান্না দে কী দরদ দিয়েই না গেয়েছেন। আমি গানটা গুনগুন করে গাইতে গাইতে বাজারের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি এক ত্রিশোর্ধ নারী এই ভয়ংকর রোদের মধ্যে কলাপাতা রঙের ফিনফিনে শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছেন। তার চুল খোলা, হাওয়ার মৃদু দুলছে। কপালের উপর থেকে মাঝে মাঝেই দু’এক গোছা উড়ে এসে চোখের উপর পড়ছে। তিনি হাত দিয়ে অবাধ্য চুলগুলোকে পেছনে সরিয়ে দিচ্ছেন। তার অন্যহাতে একটা মেলে ধরা ছাতা। ফর্সা টকটুকে এক রমণী গায়ে কলাপাতা জড়িয়ে ধীর লয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, দেখে মনে হচ্ছে যেন নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব উপন্যাসের প্রচ্ছদ হেঁটে যাচ্ছে।

এখনকার শহুরে নারীরা কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ ছাড়া সাধারণত শাড়ি পরেন না। বিয়ে, বৌভাত কিংবা পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন এসব দিনে ঢাকার মেয়েদেরকে শাড়ি পড়তে দেখা যায়। ভদ্রমহিলা কি কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন? অনুষ্ঠানে অ্যাটেন্ড করার মতো ভারি মেকাপ নেই তার মুখে। খুব আটপৌরে সাজগোজ। অতি সাধারণ। কোথায় যাচ্ছেন কে জানে!

আমার মনে পড়ল, অনেক বছর আগে এক জাপানি  তরুণীকে নিয়ে ফিচার লিখেছিলাম প্রথম আলোয়। তার নাম ছিল কাজুউ কাতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে পড়তে এসেছিল। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারত। কাজুউ বলেছিল, শাড়ি তার কাছে ভীষণ বিস্ময়কর এক পোশাক। এত লম্বা একটা কাপড় কী করে মানুষ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পরে থাকে সে বুঝতে পারে না। তার কাছে অপার রহস্যময় মনে হয়। সে আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিল, তার ভীষণ ইচ্ছে করে শাড়ি পরতে কিন্তু হঠাৎ খুলে পড়ে যায় কিনা এই ভয়ে সে কখনো শাড়ি পরেনি।

কাজুউ এখন কোথায় আছে, কে জানে। নিশ্চয় জাপানে ফিরে গেছে। অথবা এ দেশেরই কোনো যুবককে বিয়ে করে থেকে গেছে। শিখে গেছে শাড়ি পরা। মানুষের জীবন বৈচিত্র্যে ভরা। এসব ঘটা অসম্ভব কিছুই নয়। বাজার থেকে ফিরে গোসল সেরে আবারও ঘুম দিলাম। বিকেলের দিকে ফরহাদ ফোন দিলো। বাইরে ইফতার করতে চায়। বললাম, এই ঠা ঠা রোদের মধ্যে বেরুতে পারব না। ফোন রেখে আবার ঘুম দিলাম।

সন্ধ্যার পর সঞ্জু ফোন দিল। এবার বের হওয়াই যায়। রোদ টোদ নেই। বের হয়ে ফরহাদকে ফোন দিলাম, বের হবি নাকি? সে বিকেলবেলার প্রতিশোধ নিলো। যেহেতু বিকেলে তার আহ্বানে আমি সাড়া দেইনি তাই সন্ধ্যার পর আমার আহ্বানে সে সাড়া দিবে না। প্রতিশোধ আর কি!

মিনিট কুড়ি পর সঞ্জু এলো উত্তরা মোটরসের নিচে। আড্ডা দিলাম প্রায় রাত সাড়ে ৯টা অব্দি। কী আড্ডা দিলাম? সেই তো এক রাজা রানি রাজ্যপাট, রাক্ষস খোক্ষস দৈত্য দনোর গল্প। চলবে