মোজাম্মেল হকের উপন্যাসিকা ‘প্রস্থান’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০২১

কিছুদিন পর মাকে ব্যবসার কাজে সহায়তা করতে ওর এক মামাতো ভাইকে বাড়িতে রেখে সজীব বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বাড়িতে একা থাকলে হামিদাকে অনুসরণ করে জয়নাল। সেদিন দুপুরে স্নান শেষে হামিদা উঠানে বসে চুল শুকাচ্ছিল। জয়নাল তা  লক্ষ্য করে। বাড়িতে কেউ নেই। আয়নাল স্কুল থেকে ফিরেনি, ছেলেটাও দোকানে। এসব নিশ্চিত হয়ে জয়নাল হামিদার কাছে আসে। ভাসুরকে কাছে আসতে দেখে হামিদা শাড়ি টেনে একটু সামলে বসে। এসময় জয়নাল সদ্য স্নান করা হামিদার শরীরে গভীরভাবে তাকায়। উত্তেজনা বোধ করে। হামিদার রূপের প্রশংসা করে। হামিদা জয়নালের মনোভাব বুঝতে পারে। জয়নালের দিকে ভালভাবে তাকিয়ে তার কামুক দৃষ্টি দেখে হামিদা নিজেকে রক্ষার কৌশল নেয়। জয়নালকে বসতে বলে উঠে দাঁড়ায়। হামিদার পিছু নেয় জয়নাল। হামিদা দরজা বন্ধ করতে পারে না। জয়নাল জোর করেই ঘরে ঢুকে হামিদাকে জাপ্টে ধরে। ওদের ধস্তাধস্তি হয়। হামিদার উদোম শরীরে হামলে পড়ে জয়নাল। জোর করে।

আয়নালের সাথে তোমার ফস্টিনস্টির খবর জানি না মনে করেছ।
হামিদা জয়নালের গালে কষে চড় বসায়। সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করে। জয়নাল আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। হামিদাকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে। হামিদা নিজেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণ পর হামিদাকে বিবস্ত্র রেখে জয়নাল বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। জয়নাল ফিরে গেলে হামিদা কোনোরকমে উঠে বসে। নানা কিছু ভেবে এই বিষয়টি নিয়ে চুপ করে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজেকে পরিচ্ছন্ন  করতে আবার স্নান করে আসে হামিদা।
        
গ্রামের বাজার এখন আগের চেয়েও বেশি জমজমাট। চিংড়ি চাষ আর ফল বাগানে মানুষের আয় বাড়ছে। রাস্তা নির্মাণ আর পল্লী বিদ্যুৎ আসায় সবকিছুতেই একটা পরিবর্তনের ছাপ। ঘরবাড়ি পাকা হচ্ছে। সব মিলে ব্যবসা বাণিজ্য বাড়ছে। এসব দেখে ব্যবসায় বেশ মনোযোগ দিয়েছে হামিদা। জয়নালের কাছে এমনভাবে অপদস্ত হবার পর নিজের শরীরের প্রতিই যেন ঘৃণা জন্মে যায় তার। মনে হয়, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ক্লেদ জমে আছে। এত করে ধুয়েও যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। আয়নালের কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছে। জয়নাল হামিদার অপমান ভুলতে পারে না। কিভাবে এই অপমানের শোধ নেয়া যায়, তা নিয়ে হাফিজ মেম্বরের সাথে পরামর্শ করে। হামিদাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নেয়া যায় কিনা সেসব নিয়েও হাফিজের সাথে কথা বলে জয়নাল। হাফিজ মেম্বর বলে, আয়নালের সাথে ভাবীর ফস্টিনস্টির খবরটা প্রচার করে দাও।

কিছুদিনের মধ্যেই আয়নালের সাথে হামিদার সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা শুরু হয়। রসালো গুঞ্জন ডালপালা ছড়ায়। সজীবের কানেও আসে। এসব ঘটনার পেছনে জয়নাল আর হাফিজের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে পেরে বাড়ি আসে সজীব। মায়ের সাথে কথা বলে। আয়নালের সাথে তার সম্পর্কের কথা এড়িয়ে যায় হামিদা। জয়নালের আচরণের কথা ছেলেকে জানায়। এই ঘটনার জের থেকেই ওরা এমন নোংরা খেলায় মেতেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না সজীবের। সবকিছু জেনে মায়ের সম্মানহানির জন্য দায়ী জয়নাল আর হাফিজ মেম্বরকে চরম শাস্তি দেবার পরিকল্পনা করে সজীব। পার্টির ক্যাডারদের সাথে কথা বলে। সবকিছু শুনে কিছুদিন ধৈর্য ধরে তা ভালভাবে জানার পরামর্শ দেয় পার্টি। এর মাঝে ঘটনার আরও অবনতি হয়। সামাজিক রীতিনীতির বাইরে গিয়ে আয়নাল আর হামিদার মাঝে যে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেজন্য দুজনের বিচারের দাবি ওঠে গ্রামে। নিজেদের লোক মারফত এসব কথা ছড়িয়ে, বিচারের দাবি উঠিয়ে হাফিজ মেম্বর এ নিয়ে সালিশ ডাকে।

আয়নাল ও হামিদা দুজনকেই সালিশে উপস্থিত হবার নোটিশ পাঠায়। আয়নাল এসবের ধার ধারে না। হাফিজ মেম্বরের ডাকে সালিশে উপস্থিত হবার বিষয়ে তার কোন আগ্রহ হয়নি। বিষয়টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে জানায় আয়নাল। চেয়ারম্যান আয়নাল মেম্বরকে এসব সালিশ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। স্থানীয় মসজিদের ইমামের উপস্থিতিতে আয়নাল আর হামিদাকে শাস্তি দেবার উদ্যোগ নেয় হাফিজ মেম্বর। সালিশে তদের এক ঘরে করে রাখার এমন রায়ে চরম অপদস্ত হয়ে আত্নহননের পথ বেছে নেয় হামিদা। থানা থেকে লোকজন এসে খোঁজখবর নেয়। রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় হাফিজ মেম্বরের সাথে কথা বলেই পুলিশ গ্রামের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হাফিজ মেম্বর আয়নালের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, যার জন্য ভাবীর এমন পরিণতি হল সেই মাস্টারকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দারোগা সাব, দেখবেন সব বের হয়ে যাবে।

আয়নালের সাথে কথা বলে কিছু তথ্য নেয় দারোগা। এরপর সজীবের সাথেও কথা বলে। সজীব তার মায়ের এই পরিণতির জন্য হাফিজ মেম্বর ও মৌলভীকে দায়ী করে। হাফিজ মেম্বর বলে, এসব কথায় কান দিবেন না, ওরাতো সালিশেই আসেনি, তাই সালিশকারীদের কোন দায় নেই।

চেয়ারম্যানের মধ্যস্ততায় আয়নালকে কিছু না বলেই পুলিশ মৃতদেহ নিয়ে যায়। এই ঘটনা সজীবকে বিপর্যস্ত করে। পার্টির উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে জয়নাল আর হাফিজ মেম্বরের চরম শাস্তির ব্যপারে সবাই একমত হয়। পরের সপ্তায় বাজারের উত্তর পশ্চিম কোণায় দুজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামে কোনো শোকের ছায়া নেই। মানুষের মুখে মুখে তখন জয়নাল আর হাফিজ মেম্বরের নানা কুকীর্তির কথা শোনা যায়।