যানজট হয় প্রাইভেট গাড়িগুলোর কারণে

পর্ব ১৭

প্রকাশিত : মে ০৯, ২০২১

কথাসাহিত্যিক মারুফ ইসলাম ‘দহনদিনের লিপি’ শিরোনামে আত্মজীবনীর মতো করে গদ্য লিখছেন ছাড়পত্রে। আজ প্রকাশিত হলো ১৭ পর্ব

৩ মে ২০২১ সোমবার
মৃত ঘুঘুর মতো পেট উল্টে পড়ে আছে বিকেলটা। একটু ঘোলাটে, আবছায়া। এমন বিকেলের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অনেক কিছু চোখে পড়ল। অনেক কিছু ঘোলা হয়ে গেল ফেডেড দৃশ্যের মতো। আমি তখন আহসানিয়া মিশনের উল্টোদিকের ফুটপাতে। এইখানে একটা মোড় আছে। সেই মোড়ে ভ্যানের উপর তরমুজ সাজিয়ে বসেছে একজন। হঠাৎ এক পুলিশের মোটরবাইক ক্যাঁক করে থামলো সেই ভ্যানগাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে না নেমেই পুলিশ মহোদয় জিজ্ঞেস করল, তোরে এখানে কে বসতে বলছে? তরমুজঅলা কার যেন নাম বলল। হেঁটে যেতে যেতে খুব একটা শুনতে পেলাম না। হাঁটার গতি একটু কমালে হয়তো শোনা যেত। কিংবা থেমে গেলে। আমার কোনোটাই করতে ইচ্ছে করল না। আমি হেঁটে গেলাম স্বাভাবিক গতিতে। ফলে আবছা দৃশ্যের মতো আবছা হয়ে গেল শব্দটা।

আরও দূর হেঁটে হেঁটে একটা কুকুর পাওয়া গেল ফুটাপাতে। চার পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, লাখ টাকার চেয়ে দামি ঘুম। দেখে শরীরে জ্বালা ধরে গেল। আমি মানুষ, তবু কুকুরের সুখ সহ্য হয় না আমার। ফুটপাতের উপর থেকে ছোট্ট একটা ইটের খোয়া তুলে ছুঁড়ে দিলাম কুকুরটার গায়ে। `ওঠ শালা হারামজাদা! এত ঘুম কিসের? হাঁট আমার সাথে!` মনে মনে বললাম। আর ঢিলটা এত ছোট যে নিদ্রামগ্ন কুকুরটা কিছুই টের পেল না। সে বেঘোরে ঘুমাতে থাকল।

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যে এত চিল্লাচিল্লি করি এখানে সেখানে, ফেসবুকে, টক শোতে, চায়ের দোকানে, আড্ডায় তা ওই ছোট্ট ঢিল ছাড়া আর কিছু নয়। যারা ঘুমুচ্ছে তাদের শরীরে আঘাত করে কি করে না, তারা কিছুই টের পায় না। তো, ঘুমুচ্ছে যারা, ঘুমে থাক তারা। সুখেরও ঘুম, সুখে হোক সারা।

আমি হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন আবাহনী মাঠের কোণায় এসে পড়েছি। হঠাৎ মনে পড়ল, আমি এখানে কেন? কোথায় যেন যাচ্ছি? মাথা ঝিম ঝিম করতে শুরু করল। তারপর চকিতে মনে পড়ল, আমার তো হাসপাতালে যাওয়ার কথা।

আবার উল্টোপথে হাঁটা দিলাম সাত মসজিদ রোডের ফুটপাত ধরে। এই রোডে অসম্ভব যানজট। তুষারের মতো জমে আছে রাস্তাটা। সন্ধ্যা দৈতের থাবার মতো থপ থপ করে এগিয়ে আসছে। খানিকবাদে ইফতার। সবারই সম্ভবত ঘরে ফেরার তাড়া। অথবা রেস্টুরেন্টে ফেরার। যত গাড়ি দেখছি, সবই প্রাইভেট। পাবলিক বাসের হেলপারের ভাষায়, প্যালাস্টিক! আমার মনে হলো এরা কেউ ঘরে ফিরছে না, বরং ঘর থেকে বেরিয়েছে খানিক আগে। যাচ্ছে যার যার পছন্দের রেস্টুরেন্টে ইফতার করতে। এবং একইসঙ্গে উপলব্দি হলো, ঢাকার যানজট আসলে পাবলিক বাসের কারণে হয় না। যানজট হয় প্রাইভেট গাড়িগুলোর কারণে। লকডাউনের ভেতর প্রতিদিন এইসব যানজট সে কথাই প্রমাণ করছে।

রাতে বাসায় ফিরে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, বন্ধু শোভন কতগুলো নিউজ লিংক দিয়ে রেখেছে ইনবক্সে। একটা লিংক খুলেই আমার চক্ষু চড়কগাছ! হায় ঈশ্বর! এ কি হেরিনু! বিট কয়েন ব্যবসায়ী হিসেবে র‌্যাব একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, এবং সেই একজন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কালীন বন্ধু, একসঙ্গে, একই বিভাগে, একই সেশনে পাঁচটা বছর আমরা একই ক্লাসরুমে বসে পড়ালেখা করেছি। সেই সুমন! আমাদের বন্ধু সুমন! কীভাবে? মাবুদ! ভাবা যায়?

কাপড়চোপড় চেঞ্জ করা ভুলে, ফ্রেশ হওয়া ভুলে, ভাত খাওয়া ভুলে, ঝিম ধরে বসে থাকলাম কতক্ষণ। চলবে