রাহমান চৌধুরীর কলাম ‘বাঙালির উৎসব নিয়ে কিছু কথা’

প্রকাশিত : মে ০৫, ২০২২

কিছুদিন ধরে একটা কথার খুব প্রচার চলছে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। কথাটা কতটা সঠিক? সব সুন্দর  সুন্দর কথা সবসময় সত্য হয় না। কথাটা হতে পারে, ধর্ম যার যার নিজের ব্যাপার। উৎসবটা ধনীদের। মুসলমানরা বহু আগে থেকেই বিশ্বাস করে, ধর্ম যার যার। তাদের ধর্মগ্রন্থেই কথাটা আছে, লা কুম দীনু কুম...। সকল ধর্মের নিজ অনুষঙ্গ আছে, উৎসব আছে। কিন্তু উৎসবগুলো করা হয়েছে ধনীদের জন্য, যাদের তা পালন করার সামর্থ্য আছে। হায়রে বেচারা দরিদ্র মানুষেরা, নিজেদের জাতে তুলতে উৎসবে অংশ নেয়ার চেষ্টা করে মাত্র।

ধরা যাক বাংলাদেশের মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া একজন ধর্মহীন মানুষ, যিনি ঈদ নিয়ে মাথা ঘামান না। কিন্তু তার বাসার গৃহকর্মী ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে চাইলে তিনি যৌক্তিকভাবে তা গ্রাহ্য করেন। কারণ মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন। তিনি নিজে ধর্ম পালন না করলেও অন্যদের ধর্মবিশ্বাসকে সম্মান দেখান। তিনি মনে করেন না, সকলকে তার মতো ধর্মহীন হতেই হবে। ধর্মহীন সেই মানুষটি বিবাহকে মনে করেন একটা চুক্তি। মনে করেন বিবাহ মূলত একটি ভদ্রগোছের হিসেবি লেনদেন মাত্র। কখনো কখনো সেটার ভয়াবহ অভদ্র রূপটাও প্রকট হয়ে ওঠে। তিনি বিবাহ নামক হিসেবী লেনদেনে জড়াননি। ফলে যখন ধর্মীয় ঈদ উৎসব আসে, তখন তার রান্না করে দেয়ার লোকটি বাড়ি চলে গেলে তাকে দু’চার বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। ঈদের দিন তার নিজের কাছে বিশেষ কোনো দিন নয়, সেকারণে দিনটিতে অনেক সময় ঘুমিয়ে বই পাঠ করে কাটিয়ে দেন। সারাদিন সত্যিকারের খাওয়া দাওয়া হয় না। তিনি ইচ্ছা করলে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাসায় গিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। নিশ্চই তিনি ধর্মহীন বলে তাকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা না খাইয়ে রাখবেন না। বরং একটু বেশিই আদর যত্ন করবেন।

তিনি যেখানে থাকেন সেই ভবনের আর একটি ঘরে একজন স্বনামধন্য হিন্দু ভদ্রলোক থাকেন। ঈদের দিন তার মুসলমান বন্ধুরা তার জন্য খাবার পাঠান। তিনি উৎসবের আনন্দ নিয়ে আরো দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে সেসব খাবার ভাগ করে খান। ব্যাপারটার ভিতরে সৌন্দর্য আছে, সম্প্রীতি আছে। কিন্তু সম্প্রীতির নামে মূলত যেটা আছে সেটা হলো, অর্থনৈতিক সম্পর্ক। মার্কসের ভাষায় শ্রেণিসম্পর্ক। সহজ ভাষায় এই সম্পর্কের ভিতরে আছে এক ভদ্রলোকের প্রতি আর এক ভদ্রলোকের উদারতা। যদিও বলা হচ্ছে উৎসব সবার, কিন্তু ভদ্রলোকরা সবার প্রতি এ উদারতা দেখান না।  ভদ্রলাকটি হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, নাস্তিক হোক, ধর্মহীন হোক আর এক মুসলমান ভদ্রলোকের ঈদের দিনে তার প্রতি সম্মান দেখানো বা আতিথ্য প্রদর্শনে আপত্তি  থাকবে না। কিন্তু মুসলমান ভদ্রলোকটি কি আর এক দরিদ্র মুসলমানের প্রতি সেই সমান উদারতা দেখাবেন বা দরিদ্র বিধর্মীর প্রতি? নাকি তাদেরকে তার বাড়িতে ঢুকতে দেবেন? ভিক্ষুকদের জন্য ঈদের দিন কি তার দরজা খোলা থাকবে? তাহলে ধর্ম যার যার উৎসব সবার হলো কী করে? এটা কি একটা ভাওতাবাজি সস্তা শ্লোগান নয়?

দ্বিতীয়ত আমরা প্রায় বলে থাকি, পহেলা বৈশাখ হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ কথার পেছনে কি আদৌ কোনো যুক্তি আছে? বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। নাস্তিক বা ধর্মহীন বাদ দিয়ে ধনী দরিদ্র সবার ক্ষেত্রেই এটা সত্য। পহেলা বৈশাখ তার ধারে কাছে নেই। ভিন্ন দিকে বাংলাদেশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ। সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটিও এই উৎসবে আত্মীয় স্বজনকে কিছু উপহার দিতে চেষ্টা করেন, নিজেরা ভালোমন্দ খান। মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে যান নিজগ্রামে। নিজগ্রামের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে মিলে উৎসবটি পালন করার জন্য পথযাত্রায় বহু ত্যাগ স্বীকার করেন। ঈদের উৎসব খুব সাধারণ এবং গরিব মানুষরা পালন করার চেষ্টা করেন, সবাই হয়তো পারেন না। পহেলা বৈশাখ উৎসব তার ধারে কাছেও নেই। যদিও দরিদ্র মানুষদের কাছে এ উৎসব পালন করা একটা সান্ত্বনা মাত্র। ধনীদের অনুকরণ করেই তারা এটা করে থাকেন। অনেকে সেটুকু করার সামর্থ্য রাখেন না। ঈদের দিনেও বেঁচে থাকার জন্য কায়িক পরিশ্রম করেন। কিন্তু ধনী আর দরিদ্র দুপক্ষের উৎসব পালন করার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে।

কিন্তু মানসিকভাবে বৃহত্তর মুসলিম সমাজ ঈদ আর বৃহত্তর হিন্দু সমাজ দুর্গাপূজা পালন করেন নিজ নিজ ধর্মের অনুষঙ্গ হিসেবে। সকলেই দিনটিকে উৎসব পালনের দিন হিসেবেই ধরে নেন। ফলে এ কথাটি সত্যি যে, দুই বাংলার কোথাও পহেলা বৈশাখ বড় উৎসব নয় ঈদ বা পূজার তুলনায়। কিন্তু আমরা অনেকে নিজেকে প্রগতিশীল প্রমাণ করার জন্য চিৎকার করে বলে থাকি, পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। পহেলা বৈশাখ পাহাগি মানুষদের কাছে বড় উৎসব হলেও বাঙালির জীবনে নয়। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিচার করলে পহেলা বৈশাখ খুব দ্রুত সাধারণ বাঙালির কাছে মানসিকভাবে গ্রহণযোগ্য উৎসব হবে না। গত দুশো সোয়া দুশো বছর ধরে প্রধানত বাংলার হিন্দু জমিদারদের উৎসব ছিল এটা। সেই উৎসবের ভিন্ন দিকটি ছিল, বাংলার কৃষক বা দরিদ্র মানুষকে অসম্মান করা আর শোষণ করার সঙ্গে ভয়াবহভাবে সম্পর্কিত।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক