রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘এতিম আবার এতিম হয় কী করে’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০২২

বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোকদের অস্থিরতা আর খবর বিকৃত করার কিংবা ভুল খবর পরিবেশন করার স্বভাব ধরা পড়বে নানাভাবে। যদি একজন নামিদামি মানুষ কঠিন রোগে চিকিৎসা নিতে আরম্ভ করলো, তো সে খবর ভালোভাবে না জেনেই উড়ো খবর শুনে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করতে সামান্য দ্বিধা করবে না তারা। বহুবার এমন ঘটেছে দু’তিন বছরে। মৃত্যু না হতেই মানুষের মৃত্য ঘোষণা করা হয়েছে। কারো মৃত্যুর খবর প্রচার করার জন্য খুব অস্থির হয়ে যায় এসব ভদ্রলোকরা, যেন এটা খুব বড় একটা কৃতিত্বের কাজ। সেইরকম কৃতিত্ব দেখাতে একজন জীবিত মানুষকে কে কত আগে মৃত বলে প্রচার করবে তার জন্য যেন হুড়োহুড়ি চলে।

দ্বিতীয়ত, নামিদামি বা জনপ্রিয় একজন মানুষ মারা গেলে তার নামের সঙ্গে কে কত বেশি বিশেষণ লাগাতে পারে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। সারাজীবন যে মানুষটি সাধারণ জনগণের কোনো কাজে লাগেনি, নিজেই শুধু জাতির কাছ থেকে সবরকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে, তার মৃত্যুর পর অনেকে বলে বসবে, তার মৃত্যুতে জাতি এতিম হয়ে গেল। সত্যি বলতে, কারো মৃত্যুতে চাটুকারিতা ছাড়া একটা শোকবার্তা সঠিকভাবে লিখতে পারে না অনেকে।

খুব লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নিজ পক্ষের বা দলের এরকম নামিদামি কেউ প্রয়াত হলে প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই বিশেষণ ব্যবহার করে থাকে তারা। বাতিঘর নিভে গেল এমন মন্তব্য করা হয়ে থাকে অনেকের মৃত্যুর পর। যদি একজন মানুষের মৃত্যুতে জাতি এতিম হয়, জাতির বাতিঘর নিভে যায় সেটা আদৌ কোনো জাতি কিনা? জাতি অনেক বড় ব্যাপার, একজনের মৃত্যুতে কি একটা জাতির বাতিঘর নিভতে পারে? বা একটা মানুষের মৃত্যুতে কি একটা জাতি এতিম হয়ে যেতে পারে? তাহলে সেটা জাতি বলেই বিবেচিত হতে পারে না। জাতি কি প্রতিবারই কারো মৃত্যুতে এতিম হতে পারে? এতিম আবার এতিম হয় কী করে?

ভদ্রলোকদের শোকবার্তায় প্রত্যেকের মৃত্যুতে আবার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। যে মানুষটি আশি বছর পার করে দিনের পর দিন অসুস্থতার কারণে মারা গেল, মারা যাবার আগে কাজ করবার সামর্থ্য ছিল না, তার মৃত্যুতে কি ক্ষতি হলো? নাকি মানুষ মরবে না? কিংবা যারা অধিক বয়স পর্যন্ত ক্ষমতার প্রভাবে বড় বড় পদ ধরে রাখে, অথচ জাতিকে কিছুই দেবার শক্তি রাখে না, তাদের মৃত্যুতে জাতির কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকে? বরং তারা জাতির বোঝাস্বরূপ। যেখানে প্রচুর মানুষ বেকার, সেখানে এরকমভাবে পদ আক্রে থাকা অপরাধ।

খুব ভালোভাবেই আমি একজনকে জানি, যিনি বহু সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও প্রায় নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন কিছু টাকা পাচ্ছেন বলে। তিনি মারা গেলে জাতির কী ক্ষতি হতে পারে? কেউ কি হিসেব করে দেখেছেন, এসব মানুষ মারা গেলে জাতির সত্যিই ক্ষতি হয় কিনা? বহু সংখ্যক বেকারের দেশে যারা সম্পদ থাকতে টাকার পেছনে ছুটে বেড়ান, টাকার জন্য পদ ধরে রাখেন তারা আসলে অপরাধী।

কখনো কখনো দু’একটা অকাল মৃত্যুতে জাতির বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়, কিন্তু সেটা সব ক্ষেত্রে সত্য নয়। ফলে লিখবার সুবিধা থাকলেই চাটুকারিতা লিখতে হবে এমন নয়, লিখবার মতো কথা থাকলেই লিখতে হবে। না হলে পৃষ্ঠা ভরাবার মতো উল্টোপাল্টা লেখার দরকার কী?

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক