রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘ধর্মান্ধ হলেও এদের মোল্লা বলা অপরাধ’

প্রকাশিত : মে ২২, ২০২১

লুটপাটকারী, বিলাসী ও ভোগীদের মুখে ধর্মের কথা বেশি বেশি শোনা যায়। সবাই নয়, সেটাও সত্যি। সত্যিকারের আবার রকমের আছে। প্রচুর খাবার খেয়ে এরা না খাবার সংযম পালন করে। ধার্মিক হলেও এদের মোল্লা বলা নিষিদ্ধ। কারণ এরা ধর্ম পালন করলেও বাজার সংস্কৃতির সদস্য। ফলে ধর্মান্ধ হলেও এদের মোল্লা বলা অপরাধ। ধর্মান্ধ হলেও হবে না, মাদ্রাসার পোষাকের ধর্মান্ধ হলেই না তবে মোল্লা। ভিন্ন পোষাক আর টাকাওয়ালা মানুষ ধর্মান্ধ হলেও কি তাকে মোল্লা বলা যায়? কথাটা দরিদ্র মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত।

টাকার কুমির অভিজাতদের মোল্লা বলা অপরাধ। ধার্মিক তারা, ধর্মান্ধ হলেও বাজার সংস্কৃতির দালাল এরা, ভদ্রসমাজে এদের বাস। কখনো এদের রক্ষণশীল  বা মোল্লা বলা যাবে না। কাকে কী বলা যাবে সংস্কৃতিবান ভদ্রসমাজ ঠিক  করে দিয়েছে। সংস্কৃতিবানরা ধর্ম পালন করলে সেটা রক্ষণশীলতা নয়। সকলকেই সেটা বুঝতে হবে?

বাজার সংস্কৃতির সদস্য ধর্মান্ধ বা ধার্মিকরা ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সকল বিলাস  দ্রব্য কেনাকাটা করে ধর্ম উৎসবের নামে কিংবা সাংস্কৃতিক উৎসব এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নামে। সকল রকম বিলাস দ্রব্য ক্রয় বাজার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। লুটপাটের টাকাতে সে কেনাকাটা চলে। ধর্ম পালনকারী আর ধর্মপালনকারী নয় যে সংস্কৃতিসেবী, দুই ভাই বাজার সংস্কৃতির ধারক বাহক। দরকার মতো সকল লুটপাটের হোতা। দামি গাড়িতে এরাই এক ভাই কখনো উপাসনালয় আবার কখনো  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যায়। দুই ভাই বা দুই ভাইবোন তারা, ধর্ম মানে বা পালন করে একজন। কিন্তু আর একজন মানে কিংবা মানে না। দুজনেই ঠগবাজ বিলাসী, ভয়াবহ সংস্কৃতির ধারক বাহক।

দুই ভাইয়ের এক ভাই খুব ধর্ম  মানে অন্ধের মতো, কিন্তু তাকে মোল্লা বা পুরোহিত বললে ক্ষেপে যাবে। যিনি দামি গাড়িতে উপাসনালয় যান তিনি কি মোল্লা হতে পারেন? মোল্লা সেই দরিদ্র মানুষটি, যার টাকা পয়সা নেই কিংবা আভিজাত্য নেই। যদি আভিজাত্য থাকে হিজাব মাথায় দিলেও তিনি মোল্লা নন। কথা হলো, হিজাবটার দাম কত, মালিকের গাড়ি আছে কিনা । উপাসনালয় গিয়ে অন্ধের মতো কপাল ঠুকে কি কেউ মোল্লা হয়ে যায়? পকেটে কত টাকা আছে তার উপর নির্ভর করবে কে মোল্লা আর কে মোল্লা নয়। পকেটে বহু টাকা আছে, আভিজাত্য আছে সে যতোই ধর্মান্ধ বা অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী হোক মোল্লা হতেই পারে না। মাদ্রাসায় পড়া ছেলেটি কেবল মোল্লা বা ধর্মান্ধ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আভিজাত্য রক্ষা করা মানুষটি কট্টর ভাবে ধর্ম পালন করলেও; না সে রক্ষণশীল, না সে গোঁড়া।  স্মরণ রাখতে হবে বাজার সংস্কৃতির দুই ভাই। দুজনের একজন ধর্মান্ধ হলেও ধর্মান্ধ নয় ভদ্রসমাজের চোখে। ভিন্ন দিকে আর এক ভাইটি দল অন্ধ বা হাজার বছরের সংস্কৃতির অন্ধ ভক্ত। কিন্তু ধর্মান্ধ বা রক্ষণশীল  সে নয় ভদ্রসমাজের কাছে। কিন্তু রক্ষণশীলতার অর্থ  যে ভয়াবহ অতীতমুখী; পুরানো ধ্যান ধারণা সংস্কৃতি পাল্টাতে চায় না। তিনি নিজেই নিয়ম করেছেন, তিনি ইতিহাস অন্ধ, তবুও রক্ষণশীল নন। কারণ নিজ দাপটে ইতিহাস তিনিই রচনা করেন। বাজার সংস্কৃতির তিনি সভ্য। সারা বিশ্ব সভ্যতা তিনি চালান। তিনি মনে করেন,  ধর্ম যার যার উৎসব সবার।

ধার্মিক ক্ষমতাবান ভাইয়ের সঙ্গে তার বিরোধ নেই। মাদ্রাসা পড়া ধার্মিক লোকটার সঙ্গে তার সব বিরোধ। নিজে তিনি ধর্ম পালন করেন না, উৎসব পালন করার জন্য বিলাস দ্রব্য কেনাকাটা করেন মাত্র। ধর্ম উৎসবের পোলাও কোর্মা খান সকল মতের আর সকল ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য, কিন্তু বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতের সঙ্গে সামান্য সমন্বয় নয়। কারণ তিনি চেতনাধারী। ধর্মের মতো বছরের পর তিনি এক চেতনা ধারণ করেন, বা সুবিধা মতো সরকার বদলের  সঙ্গে চেতনা পাল্টান। মাদ্রাসার দ্বারা হত্যাকাণ্ডে সরব, বাজার সংস্কৃতির হাতে হত্যাকাণ্ডের সময় নীরব।

ধর্ম পালনের, নারী ধর্ষণের যত দোষ মাদ্রাসা পড়া দরিদ্র মোল্লার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম ধর্ষণের উৎসব পালনের সময় তিনি প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পান না। মহান এসব সংস্কৃতিবান মানুষরা ঠগবাজ হতে পারে, প্রমোদবালার স্রষ্টা বা দালাল হতে পারে, রাষ্ট্রীয় হত্যার দোসর হতে পারে, টাকা পাচারকারী হতে পারে, দুইটা মহাযুদ্ধের কারণ হতে পারে, বিদেশি রাষ্ট্রের দালাল হতে পারে, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। কিছুতেই তারা মোল্লা নয়। বাজার সংস্কৃতির সভ্য তারা। বাজার সংস্কৃতির স্বার্থে অন্যের দেশ দখল তাদের চোখে অপরাধ নয়। সকলে তারা মহান এবং তথাকথিত উদারনৈতিক চেতনাধারী। নিজের চেতনা আর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সকল রক্তপাতের তারা সমর্থক। সবার আগে তারা টাকা আর ভোগের অঙ্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।