রশীদ হায়দার

রশীদ হায়দার

রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘রশীদ হায়দারের কাছে আমার ঋণ’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৪, ২০২০

বলছি ১৯৯৪ সালের কথা। বাংলা একাডেমী সে বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার ‘মহাবিদ্রোহ ও সম্রাট বাহাদুর শাহ’ বইটা প্রকাশ করবে। নাটকটা প্রকাশ নিয়ে ছোট একটা প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার পর বাংলা একাডেমীর তৎকালীন উপ-পরিচালক পরবর্তীতে পরিচালক ফরহাদ খানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর হয়। ফরহাদ ভাই খুবই চমৎকার মানুষ ছিলেন, হঠাৎ একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘রাহমান মহাবিদ্রোহ ছাড়া আপনি কি আর কোনো নাটক লেখেননি’? জানতে চাইলাম, কেন? বললেন, ‘কেন আবার, পড়তে চাই।’ আমি তখন আমার বছর চারেক আগের লেখা ‘ক্রীড়নক’ নাটকটা ফরহাদ ভাইকে পড়তে দেই। ফরহাদ ভাই নাটক পাঠ করে আমাকে একদিন বললেন, মহাবিদ্রোহ বই আকারে বের হবার কাজ চলছে, সময় লাগবে। চতুর্থ তলায় রশীদ হায়দার বসেন, তিনি উত্তরাধিকার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। তাঁকে আপনার ‘ক্রীড়নক’ নাটকটা দিয়ে বলেন, উত্তরাধিকারে ছাপাবার জন্য। রশীদ ভাইর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা ছিল না। যখন পাণ্ডুলিপিটা ওনাকে দিলাম, তিনি বললেন, ‘না না, নাটকের কোনো পাণ্ডুলিপি আমি গ্রহণ করবো না। ইতিমধ্যে উত্তরাধিকারের এ সংখ্যায় একটা নাটক দিয়েছি, সেটা ছাপা হবে। আরো বহু নাটক এসেছে উত্তরাধিকার পত্রিকার জন্য। আপনার পাণ্ডুলিপি আমি গ্রহণ করতে পারবো না।’

বললাম, ‘পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করবেন না, সেকথা বলারই অধিকার নেই আপনার। সম্পাদক হিসেবে আপনার কাজ পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করা, পাঠ করা। ভালো না লাগলে দ্বিধাহীনভাবে ফেলে দেয়া। কিন্তু নাটকটা পাঠ না করেই বলছেন, পাণ্ডুলিপি  রাখবেন না, সেটা কী কথা।’ খুব ধাক্কা খেলেন রশীদ ভাই আমার কথা শুনে। নিশ্চয় আমি অযৌক্তিক কিছু বলিনি। তিনি পুরো মাত্রায় বুঝলেন, কথাটা বলা ঠিক হয়নি। দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনার পাণ্ডুলিপি রেখে যান।’ বললাম, ‘পাণ্ডুলিপি রেখে যাচ্ছি কিন্তু আপনি পড়বেন তো?’ তিনি বললেন, ‘কেন মনে হলো, আপনার, আমি পড়বো না?’ বললাম, ‘আপনার প্রথম বাক্য শুনে।’ তিনি বললেন, ‘আপনি কি জানেন আমার কাছে কত লেখা আসে, সেগুলি আমাকেই পড়তে হয়।’ বললাম, ‘আমি জানি একজন সম্পাদকের উপর নানান রকম চাপ থাকে। খারাপ ভালো অনেক লেখা পড়তে হয়। কখনো কখনো প্রচুর বিরক্তির লেখাতেও চোখ বুলিয়ে যেতে হয়। হয়তো আমার লেখাটা পাঠ করেও আপনার খুব বিরক্ত লাগবে। কয়েক পৃষ্ঠা পাঠ করে বিরক্ত লাগলে ছিড়ে ফেলবেন। কিছু মনে করবো না। কিন্তু আপনি পাঠ করবেন, সে কথাটা আমাকে দেন।’ তিনি কথা দিলেন, তিনি পাঠ করবেন। তিনি তারপর চা খেতে বললেন আমাকে। বললাম, ‘চা খাবো না, চা খুব একটা খাই না। বরং বলেন, কদিন পরে আসবো জানতে লেখাটা সম্পর্কে?’ তিনি বললেন, ‘এক সপ্তাহ পর’।

রশীদ ভাইর কাছে পাণ্ডুলিপিটা রেখে চলে এলাম বাসায়। ফরহাদ খান যে পাঠিয়েছেন, সেটা আর রশীদ ভাইকে বললাম না। ভাবলাম দেখি, নিজস্ব গতিতে কী ঘটে। ঠিক সাত দিন পর বাংলা একাডেমীতে গিয়ে আবার উপস্থিত হলাম সরাসরি রশীদ ভাইয়ের কক্ষে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় মনে মনে ধারণা করে নিয়েছিলাম, গিয়ে শুনবো নাটকটি পাঠ করার সময় তিনি পাননি। রশীদ ভাই আমাকে দেখে বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি প্রথমেই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, ‘চা দিতে বলি?’ রশীদ ভাইর আন্তরিকতা দেখে ধরে নিলাম, পাণ্ডুলিপি পাঠ করা হয়নি, ফলে আমাকে চা খাইয়ে কিছুটা খুশি করতে চাচ্ছেন। বললাম, ‘চা খাবো না। পাণ্ডুলিপিটা কি পাঠ করতে পেরেছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘চা আজ আপনাকে অবশ্যই খেতে হবে। আমি চা আনাচ্ছি। আপনি ততক্ষণে আর একটা কাজ সেরে আসেন। আপনি আমাদের প্রেসের আফজাল সাহেবকে নিশ্চয় চেনেন? আপনি একটু তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ব্যাপারটা জরুরি। তারপর একসঙ্গে চা খাবো।’ প্রেসের আফজাল ভাইকে খুব ভালো করে চিনতাম। সেরকম মানুষ এখন আর খুব একটা পাওয়া যাবে না। খেলাঘর করতেন, থাকতেন মানিকগঞ্জে। প্রেসের কাজ শেষ করে খেলাঘরের কাজে যোগ দিয়ে তারপর মানিকগঞ্জ ফিরতেন রাতে বাসে করে। বাংলা একাডেমী প্রেস থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র ছাপানোর ব্যাপারে আফজাল ভাইয়ের কাছ থেকে কত রকম সহযোগিতা পেয়েছি। মাঝে মধ্যে এখনো প্রায় আফজাল ভাইর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

যখন আফজাল ভাইর সঙ্গে সেদিন দেখা করতে প্রেসে গেলাম আফজাল ভাই নিজের চেয়ারে নেই। সামান্য পরেই ফিরলেন। আফজাল ভাইর কাছে গেলেই চা খেতে হতো। সেদিন আর খাইনি রশীদ ভাইর দোহাই দিয়ে। আফজাল ভাইর কাছে জানতে চাইলাম, ‘রশীদ ভাই বললেন আপনি নাকি খুঁজছেন আমাকে?’ আফজাল ভাই একটু হেসে বললেন, ‘রশীদ ভাই বলেছেন! বুঝতে পেরেছি। তিনি একজনকে কিছু একটা জরুরি ভিত্তিতে আনতে নির্দেশ দিলেন। যখন সেটা নিয়ে আসা হলো, বুঝতে পারলাম একফর্মা ছাপানো কাগজ। আফজাল ভাই আমার চোখের সামনে মেলে ধরলেন কাগজটা। বললেন দেখেন। দেখি আমার ‘ক্রীড়নক’ নাটকের ছাপানো অংশ বিশেষ। নিজেই এবার আমি বিস্মিত। আফজাল ভাই বললেন, ‘কী হয়েছে বলেন তো? উত্তরাধিকারের এ সংখ্যার জন্য একটা নাটক ছাপা হয়ে গিয়েছিল। সেটা বাদ দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আপনার নাটকটা ছাপাতে বলেছেন। পত্রিকা প্রকাশ সেজন্য দুতিন দিন পিছিয়ে গেল।’ নিজের চোখকে বা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আফজাল ভাই আর যা যা বলেছিলেন, তা আর লিখছি না। প্রথমবার জীবনে মনে হলো, যদি সত্যি পরিশ্রম করে আন্তরিকভাবে কিছু লিখে থাকি তার পুরো সম্মানটাই যেন আমাকে দিলেন রশীদ ভাই। জীবনে লেখালেখির জন্য আর কখনো কোনো সম্মান না পেলেও, এই ঘটনাটা আমাকে সারা জীবন লিখতে আর লেখার ব্যাপারে সৎ আন্তরিক থাকতে প্রেরণা জোগাবে। কথাটা আহমদ ছফা ভাই প্রায় বলতেন, ‘রাহমান, লেখকের মর্যাদা খাটো করবেন না। সবসময় লেখক হিসেবে মাথা উঁচু করে হাঁটবেন।’ যদিও তখন পর্যন্ত কখনো আমি নিজেকে লেখক ভাবতাম না, মনে করতাম সখ করেই যা কিছু লিখছি বা ভিতর থেকে লেখার তাড়নায়। নিজেকে এখনো আমি লেখক ভাবি না, হয়তো সামান্য একজন গবেষক মাত্র।     

ফিরে এলাম রশীদ ভাইর কক্ষে। রশীদ ভাইর কক্ষে প্রথম দিন যেরকম চৌকস ছিলাম, ফিরে এসে তখন আমার মুখে আর কোনো কথা নেই। রশীদ ভাইকে অমি তাকিয়ে দেখছি। মাত্র সাতদিন আগে লেখাটা রেখে গিয়েছিলাম। চা দেয়া হলো আমার সামনে। রশীদ ভাই বললেন, ‘রাহমান, আপনাকে একটা অনুরোধ করবো?’ বললাম, ‘জ্বী বলেন।’ তিনি বললেন, ‘কখনো লেখা বন্ধ করবেন না। লিখতে হবে।’ বললাম,‘নিশ্চয় রশীদ ভাই।’ বললেন, ‘সেদিন আপনি আমার উপর রুষ্ট হয়েছিলেন আপনার পাণ্ডুলিপি রাখতে চাইনি বলে। যদি দেখতেন কেমন পাণ্ডুলিপি আসে আমার কাছে তাহলে হয়তো আর রাগ করতেন না। ভালোই হয়েছে সেদিন আপনার রুষ্ট হওয়াতে। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আপনার নাটকটা ছাপাতে পারলাম। মনে রাখবেন, আপনাকে আমি সামান্য সুবিধা দেইনি। আমার বিবেচনায় সম্পাদক হিসেবে যা সঠিক মনে হয়েছে, আমি ঠিক তাই করেছি।’  

বাংলা একাডেমীর ফরহাদ ভাই, রশীদ ভাইর সঙ্গে এভাবে আমার সুসম্পর্ক হয়ে যায়। প্রয়াত ওবায়দুল ইসলাম ভাইর সঙ্গে পরবর্তীতে সুসম্পর্ক হয় লেখালেখি দিয়েই। বাংলা একাডেমী আমার প্রথম তিনটা বই প্রকাশ করে। বশীর আল হেলাল আমার ‘মহাবিদ্রোহ ও সম্রাট বাহাদুর শাহ’ নাটক প্রকাশে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, পরে ফরহাদ খান। ক্রীড়নক আমার প্রকাশিত প্রথম নাটক ১৯৯৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে। পরবর্তীতে বই আকারে বের হয় বাংলা একাডেমী থেকেই। লেখালেখির ব্যাপারে একদা বাংলা একাডেমীর কাছ থেকে যে সম্মান পেয়েছিলাম তা কখনো ভুলবো না। বাংলা একাডেমীর তখনকার চেহারা ছিল ভিন্ন। পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমাকে জীবনের প্রথম দিনগুলিতে কখনো কারো পিছনে হাঁটতে হয়নি। পরেও কখনো না। বাংলা একাডেমীর কাছে সেকারণে আমার ঋণ স্বীকার করবার আছে। যখন লেখাগুলি প্রথম ছাপা হয় বাংলা একাডেমীর কর্তারা বা পরিচালকরা ব্যক্তিগতভাবে কেউ আমাকে চিনতেন না। স্বাভাবিক নিয়মেই আমার লেখাগুলি ছাপা হয়েছিল। লেখালেখি বা বই প্রকাশের পর তাঁদের সঙ্গে অনেকেরই আমার ব্যক্তিগত পরিচয় গড়ে ওঠে।

রশীদ ভাইর কাছে আজ বিশেষভাবে ঋণ স্বীকার করছি উত্তরাধিকার পত্রিকায় ‘ক্রীড়নক’ নাটকটি প্রকাশের জন্য। কারণ সেদিনের সেই ঘটনাটি আমার মনে আগের চেয়ে আরো বেশি আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছিল যে, লেখালেখির ক্ষেত্রে মান বজায় রাখতে পারলে তা প্রকাশ করা নিয়ে খুব একটা সঙ্কটে পড়তে হবে না। বাংলা একাডেমীর সেসময়ের কিছু কিছু মানুষের কারণেই সে রকম আত্মবিশ্বাসটা গড়ে ওঠে। না হলে লেখা হয়তো ছেড়েই দিতাম। ‘মহাবিদ্রোহ ও সম্রাট বাহাদুর শাহ’ এবং ‘ক্রীড়নক’ দুটি নাটকই এর আগে একটি নাট্য পত্রিকায় দিয়েছিলাম ছাপাবার জন্য, পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদক বছরের পর বছর আমাকে বলেছেন তাঁর পড়ার সময় হয়নি। যখন বই আকারে ‘মহাবিদ্রোহ ও সম্রাট বাহাদুর শাহ’ ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়, সেই সম্পাদকই আমাকে ডেকে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘সরাসরি বই না ছাপিয়ে আপনি বই বের করার আগে নাটকটা আমার পত্রিকার জন্য দিতে পারতেন’। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, সম্পাদক পাণ্ডুলিপিটি পড়েননি তো বটেই, হয়তো যত্ন করে রেখেও দেননি। মুখ চেনা ছাড়া শুধু যোগ্যতায় এদেশে কিছুই হতে চায় না। কারণ তখন লেখক হিসেবে আমার পরিচয় ছিল না, প্রকাশিত বই ছিল না। বাংলা একাডেমী আমার বই প্রকাশ করার পরেই আমার গুরুত্ব যেন বেড়ে গেল তাঁদের কাছে। পরে অবশ্য সে পত্রিকায় আমার বেশ কয়েকটি নাটক আর লেখা ছাপা হয়েছে। রশীদ ভাইর কাছে আজ এত আন্তরিকতার সঙ্গে কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি পাঠক তা এখন নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছেন।

যখন ক্রীড়নক বই হিসেবে প্রকাশ হবে বিপত্তি দেখা দিয়েছিল। বাংলা একাডেমীর যে কোনো বই প্রকাশে দুজন বিশেষজ্ঞের ইতিবাচক মন্তব্য দরকার হয়। ক্রীড়নক-এর ছাপানো পাণ্ডুলিপি দুজনের কাছে পাঠানো হলো। বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো পাণ্ডুলিপিতে কখনো লেখকের নাম বলা থাকে না। সাঈদ আহমেদ ছিলেন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একজন, তিনি একমাসের মধ্যে তাঁর ইতিবাচক মন্তব্য পাঠান। বিশেষজ্ঞদের দ্বিতীয় জন কিছুই জানালেন ছয়মাস পর্যন্ত। বাংলা একাডেমী থেকে ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যখন তাঁকে ফোন করা হলে, তিনি ফোনে বাংলা একাডেমীর কাছে জানতে চাইলেন, গ্রীসের এই নাটকটির মূল লেখক কে? বাংলা একাডেমী তাঁকে জানিয়ে দিল যে এটা কোনো গ্রীক নাটকের অনুবাদ নয়, এটা মূল রচনা। তিনি তখন নাকি বলে ছিলেন, আমি নাটকটার বহু কিছুই বুঝতে পারছি না। বিশেষজ্ঞ নিজে একজন নাট্যকার হিসেবে সকল মহলে পরিচিত। ফরহাদ ভাই আমার কাছে ঘটনাটা বিবৃত করে বললেন, আমি যেন নাটকটা সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ভূমিকা লিখে দেই। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কাদেরকে বিশেযজ্ঞ বানিয়েছেন যে নাটকটাই বুঝতে পারছেন না? আপনার নিজেরা কি পড়ে বুঝতে পারেননি?’ ফরহাদ ভাই বললেন, ‘বিদ্রোহ রাখেন, আপনি দুদিনের মধ্যে আমাকে একটা ভূমিকা লিখে দেন।’ ফরহাদ ভাই আমার বড় ভাই তুল্য, কথা না বাড়িয়ে দুদিনের মধ্যেই আমি ভূমিকা লিখে পাঠালাম। কিন্তু তারপর পাঁচ বছরেও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিটি তাঁর মন্তব্য পাঠালেন না। বাংলা একাডেমী একের পর এক চিঠি পাঠিয়ে গেল, বিশেষজ্ঞ নীরব। কিছুই বলছেন না তিনি। বাংলা একাডেমীর কর্তৃপক্ষ এ রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বাধ্য হয়ে আমার কাছে একদিন বিশেষজ্ঞের নামটা প্রকাশ করে দিলেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তখন লেখক সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো মাসের শেষ বৃহস্পতিবার, রাতের খাবার সহ। আমি নিমন্ত্রিত থাকতাম। হঠাৎ সেখানে সেই বিশেষজ্ঞের দেখা পেলাম। ভাবলাম ওনাকে জিজ্ঞেস করি কেন আমার নাটক-সম্পর্কিত মন্ত্যবটি তিনি পাঠাচ্ছেন না। দুজনেই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অতিথি। সেজন্য ভাবলাম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আগে জিজ্ঞেস করি ওনার সঙ্গে এখানে বসে আলোচনা করাটা ঠিক হবে কি না। স্যার সব শুনে বললেন, কাল বিকালে আমার বাসায় আসো। আমিই ওনাকে ফোন করবো। পরদিন ইস্কাটন গার্ডেনে স্যারের বাসায় গেলাম। স্যারের সঙ্গে ফোনে বিশেষজ্ঞের দীর্ঘ আলাপ হলো। বিশেষজ্ঞ বললেন, এটা কি নাটক, নাকি কবিতা, নাকি প্রবন্ধ আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। স্যার বললেন, যাই হোক বহু বছর হয়ে গেছে, আপনি আপনার মন্তব্য পাঠিয়ে দিন। হা বা না যেটা আপনার মনে হয় তাই বলবেন। কিন্তু আপনি মন্তব্য না করলে বইটা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বাংলা একাডেমী। শুনলাম প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে বাংলা বইটার প্রকাশ আটকে আছে। সেই ঘটনার কদিন পর বিশেষজ্ঞ বাংলা একাডেমীকে পত্র মারফত জানালেন, তিনি নাটকটি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে অপারগ। শুধু এটুকুই লিখলেন। বিশেষজ্ঞের এটুকু জানাতে পাঁচ বছর লেগে গেল, তাও একজন জনের টেলিফোন পাবার পর। ফলে নাটকের যে বইটি ১৯৯৫ বা ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হবার কথা তা ১৯৯৯ সালে এসেও প্রকাশ করা গেল না।

বাংলা একাডেমী এরপর জিয়া হায়দারকে পাণ্ডুলিপি পাঠালেন, তার মতামতের জন্য। তিনি প্রথম ফোনে জানতে চাইলেন, নাটকটির মূল লেখক কে আর প্রাচীন গ্রীসের কোন নাটকের অনুবাদ এটা? বাংলা একাডেমী থেকে জানানো হলো, এটা মৌলিক রচনা। তিনি তার মাসখানেকের মধ্যেই তার ইতিবচক মন্তব্য জানিয়ে দিলেন। ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে নাটকটি ছাপা হলো বাংলা একাডেমী থেকে। রশীদ ভাই সহ বাংলা একাডেমীর সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে পুরো ঘটনা সহ নাটকটা প্রকাশের জন্য আমার ঋণ স্বীকার করছি।