রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকদিন’

পর্ব ১

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩১, ২০২১

দু’হাজার তিন সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘটনাচক্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি দিন তিনেক ঘনিষ্ঠভাবে সময় পার করেছিলাম। ঘটনাটার মাসখানেক আগে চলচ্চিত্র পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকা-কলকাতার দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে টেলিভিশনের জন্য একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় তার পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেজন্য তার ঢাকায় আসা। তিনি আমার বহুদিনের পরিচিত, ফলে ঢাকায় যখন তার সঙ্গে দেখা করলাম আর তিনি জানতে পারলেন আমি খুব শীঘ্র নির্দিষ্ট একটি তারিখে কলকাতা যাচ্ছি, তিনি আমাকে বললেন, আমি যেন কলাকাতায় কয়েকদিন তাকে সময় দেই।

কলকাতায় সেবার আমি সল্টলেকে নৃপেন্দ্র সাহা মানে আমাদের প্রয়াত নৃপেনদায় বাসায় উঠেছি। নৃপেনদার বাসা থেকে সামান্য হাঁটাপথ দূরেই থাকে শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায় আর ডা. ধূর্জটি মুখোপাধ্যায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। শ্রীলেখা নব্যেন্দুদার ‘পরশুরামের কুঠার’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিল সম্ভবত উনিশ শো নিরানব্বই সালে। কলকাতায় গিয়ে যখন পরদিন সন্ধ্যায় শ্রীলেখাদের বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলাম, ধূর্জটি বললো, নব্যেন্দুদার ওখানে গিয়েছিলে? নব্যেন্দুদা তোমার খবর জানতে চেয়েছিলেন। বললাম, কালকে যাব। আজ সারাদিন ভারত ভ্রমণের জন্য ট্রেনের টিকেট কেটেছি নৃপেনদার সঙ্গে।

ধূর্জটি বললেন, নব্যেন্দুদা টেলিভিশনের জন্য ছবি বানাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে। কথাটা তোমাকে বলেছে?
বললাম, হ্যাঁ, ইঙ্গিত দিয়েছে।
পরদিন যখন নব্যেন্দুদার সঙ্গে দেখা করি, তিনি বললেন রবীন্দ্রনাথের ‘মুসলমানীর গল্প’ চলচ্চিত্র হিসেবে দুই বাংলার টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করা হবে। তিনিই তার পরিচালক। পরদিন থেকে তার সুটিং, আমাকে কয়েকদিন তার সঙ্গে থাকতে হবে। বললাম, আমি কদিন পর ভ্রমণে বের হবো।
তিনি সবকিছু শুনে বললেন, কলকাতা ছাড়ার আগে পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকবেন। আপনার প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় সঙ্গে নেন। আমি গাড়ি দিচ্ছি, সল্টলেক থেকে আপনার ব্যাগ নিয়ে চলে আসেন।

সেদিন রাতে আমার শ্রীলেখাদের বাসায় খাবার কথা। সেটা আর হলো না। তিনি তার সঙ্গে একপ্রকার জোর করেই আমাকে সুটিংয়ে নিয়ে চললেন। নব্যেন্দুদার বাসায় দুপুরের পর বাংলাদেশের তুহিন বড়ুয়া, বিজরী বরকতউল্লাহসহ আরো কয়েকজনকে দেখলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম, তুহিন বড়ুয়া আর বিজরী বাংলাদেশ পক্ষের প্রতিনিধি আর বিজরী মুসলমানির গল্পের প্রধান চরিত্র ‘কমলা’র ভূমিকায় অভিনয় করবে। বিজরীর মামা অধ্যাপক ইফতেখারুল আউয়াল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন, বিজরীর খালা হলি আমার সঙ্গেই ইতিহাস বিভাগে পড়তো, হলি অবশ্য পড়াশুনা শেষ না করে বিদেশে চলে যায়। ভিন্ন দিকে আমার বন্ধু নূরুল হুদা আবুল মনসুর পরবর্তী সময়ে বিজরীর শিক্ষক ছিলেন। ফলে বিজরীর সঙ্গে আমার সেভাবেই পরিচয় হয় কলকাতায়, তুহিনের সঙ্গে দু-একবার আগে দেখা হয়েছে যখন ঢাকায় নব্যেন্দুদার সঙ্গে দেখা করতে যাই। বিজরী আর তুহিন আমাকে দেখে খুশিই হলো।

নব্যেন্দুদার কথা মতো তার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু একটা অঘটন ঘটে গেছে ততক্ষণে, যেখানে সুটিং হবার কথা ছিল সেখানে সুটিং করা যাচ্ছে না। ফলে নতুন স্পট খুজেঁ বের করতে হবে। ঠিক হলো বিকেলে হুগলির নিকটবর্তী খন্নানের জমিদার বাড়িটা দেখবে, পছন্দ হলে পরদিন থেকে সেখানেই সুটিং আরম্ভ হবে। স্পট বাছাইয়ের অগ্রগামী দল হিসেবে দুপুরের খাবার খেয়ে নব্যেন্দুদার সঙ্গে চিত্রগ্রাহক আর খোকনদাসহ আমরা চারজন বের হয়ে পড়লাম একটা জীপে করে। খন্নানের জমিদার বাড়ি পছন্দ হলো নব্যেন্দুদার। পুরানো দিনের বেশ বড় বাড়ি, দেড়শোর মতো কক্ষ আছে। যখন আমরা খন্নানে পৌঁছাই তখন প্রায় সন্ধ্যা। খোকন ভাই ছিলেন নব্যেন্দুদার সহকারী এবং চিত্রনাট্যকার, সকলকে বলা হলো পরদিন খন্নানেই সুটিং হবে; সকলে যেন সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে চলে আসে। জমিদার বাড়িতে অনেকগুলি কক্ষ থাকলেও, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার অভাবে ঠিক হলো আমরা চারজন সেদিন পাশের একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করবো।

নব্যেন্দুদার সে হোটেল পছন্দ হলো না, যদিও সে রাত্রিতে আমাদের সেখানে থাকতে হলো। কয়েকজন ব্যক্তি আর হোটেলের লোকরা জানালেন এখান থেকে দূরে ভালো একটি রিসোর্ট আছে, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। পরদিন থেকে আমাদের সেই রিসোর্টেই থাকার ব্যবস্থা করতে বলা হলো। রাত্রে হোটেলে নব্যেন্দুদা আর আমি খোকনদাসহ আড্ডায় বসেছি। চিত্রগ্রাহক বিহারের ছেলে, সদ্য কলকাতার সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র বিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে, খুব দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমাদের সঙ্গেই আড্ডায় রয়েছে। নব্যেন্দুদা বললেন, রাহমান ভাই, আপনাকে কেন ধরে এনেছি জানেন?
বললাম, না।
তিনি বললেন, প্রধান কাজ হচ্ছে আপনার, সুটিং দেখবেন আমার কাজ ভালো না হলে মুখের উপর বলে দেবেন। ঠিক এর আগে যেমন আমার ছবির সমালোচনা করেছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ছবি শেষ করার আগে সুটিং দেখে কী করে বলবো? আর আমি এমন কোনো বিশেষজ্ঞ নই।
তিনি বললেন, আমার আপনাকে দরকার, বিশেষজ্ঞ দরকার নেই। আপনি সমালোচনা করলে আমার কাজটা আরো ভালো হবে এটা আমি বিশ্বাস করি। সেজন্য ঢাকাতেই আপনাকে বলেছিলাম, কলকাতায় এসে আমাকে সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে কথা না বলে সারা ভারতবর্ষ ঘুরবার জন্য ট্রেনের টিকেট কেটে বসে আছেন। যা হোক, সামনের দুদিন সুটিংয়ে যা আপনার কাছে সঠিক মনে হবে না, আমাকে বলবেন। বিশেষ করে মুসলমানদের সংস্কৃতি যা আমি ভালো জানি না, সেটার ত্রুটি ধরা পড়লে অবশ্যই আমাকে সচেতন করবেন।

রাতে আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন নাস্তা খেয়ে আবার খন্নানের জমিদার বাড়িতে। চিত্রগ্রাহকের নামটা এতদিনে ভুলে গেছি। সদ্য শিক্ষা সমাপন করেছে, তাই সে নতুন কিছু একটা করবার জন্য খুবই উদ্গ্রীব। খন্নানের জমিদার বাড়ির বিশালত্ব তার উৎসাহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নব্যেন্দুদা এই তরুণকে স্বাধীনতা দিয়েছে চিত্রগ্রহণের কাজে নিজের প্রতিভা প্রকাশ করার। নিজের মতো আলোর পরিকল্পনা করছে সে। সকালে তেমন কিছু করবার ছিল না, কারণ শিল্পী কলাকুশলীরা সকলে তখনো এসে পৌঁছাননি। নব্যেন্দুদা দোতলায় একটা টেলিভিশন মনিটরের সামনে বসে চিত্রগ্রাহকের কাজ দেখছিলেন, তার পরিকল্পনার কথা শুনছিলেন আর মাঝে মধ্যে আমার পরামর্শ চাইছিলেন। নব্যেন্দুদার এমন বিনয়ে আমি বরং খুব অপ্রস্তুত হচ্ছিলাম। ঠিক তখনি হঠাৎ দেখা গেল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে, তিনি একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে উপস্থিত। সৌমিত্র বাবু যে এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন আমি জানতাম না। তিনি এসে নব্যেন্দুদার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।

নব্যেন্দুদা তাকে বললেন, কাজ আরম্ভ হতে কিছুটা দেরি হবে, তুমি ততক্ষণ কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারো।
দুজনের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, দুজনে ভালো বন্ধু। নব্যেন্দুদা এরপর সৌমিত্র বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি সৌমিত্র বাবুকে বললেন, সৌমিত্র পরিচিত হও, ইনি রাহমান চৌধুরী, ঢাকা থেকে এসেছেন, আমার বন্ধু।

কিন্তু সৌমিত্র বাবুর আমার সঙ্গে পরিচিত হবার তেমন উৎসাহ ছিল না। তিনি নিতান্ত বাধ্য হয়ে যেন তার হাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। দুজনে হাত মেলালাম বটে কিন্তু যা আমরা করলাম তাকে ঠিক করমর্দন বলা যাবে না। দুপক্ষেরই আন্তরিকতার অভাব ছিল। সৌমিত্র বাবু তারপর চলে গেলেন। নব্যেন্দুদা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন যে, সৌমিত্র বাবু আমাকে ধর্তব্যে আনছিলেন না। ঘটনাটার জন্য নব্যেন্দুদা আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললাম, উনি তারকা মানুষ, কত লোক ওনার দিকে হাত বাড়ায়। ফলে তিনি সব সময় সবার সঙ্গে আন্তরিক হতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই নব্যেন্দুদা।

নব্যেন্দুদা বললেন, আমি যখন পরিচয় দিয়ে বললাম আপনি আমার বন্ধু, তখন তার এমন আচরণ ঠিক হয়নি।
বললাম, নব্যেন্দুদা বাদ দিন তো, আমি এসেছি আপনার সঙ্গে সময় কাটাতে।

দুপুরে নব্যেন্দুদা আর আমি একসঙ্গে জমিদার বাড়ির নিচ তলায় বসে সুটিংয়ের খাবারই খেলাম। দুজনে নানান রকম কথা বলতে বলতে দেখা গেল বিকেল হয়ে গেছে। সৌমিত্র বাবু সম্পূর্ণ মেক-আপ নিয়ে মুসলমান চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন দোতলার করিডোরের একপাশে। তিনি হাবিব খাঁর চরিত্রে অভিনয় করবেন। কিন্তু বৈদ্যুতিক বিভ্রাটের জন্য সুটিং আরম্ভ করা যাচ্ছে না। সৌমিত্র বাবুকে তখন তার পোশাক বা কস্টিউম আর শুশ্রুমণ্ডিত মেক-আপ নেয়া অবস্থায় খুব ব্যক্তিত্ববান লাগছিল। কিন্তু মুসলমানীর গল্পের হাবিব খাঁ চরিত্রের চেয়ে তাকে অনেক অভিজাত দেখাচ্ছিল। নব্যেন্দুদা শট নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল অনেক দেরি হবে। করিডোরে রাখা একটি চৌকির উপর বসে তখন আমি সুটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তরুণরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার কাছে অনেক বিষয় জানতে চাইছিল। বাংলাদেশ থেকে আরম্ভ করে আলোচনাটা মুঘল সাম্রাজ্য আর বিভিন্ন মুঘল সম্রাটের প্রসঙ্গ পর্যন্ত এসে গেল। সেখান থেকে বাঙালি মুসলমানের নানা প্রসঙ্গ, নানা সংস্কৃতি। সৌমিত্র বাবু সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের আলোচনা শুনছিলেন। কারণ সুটিং যে কখন শুরু হবে তার ঠিক নেই। যখন আমাদের আলোচনা বাঙালিমুসলমান, ভারতের মুসলিম শাসন ইত্যাদি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যাচ্ছিল, মনে হলো সৌমিত্র বাবুর তাতে কিছুটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তিনি একটু পরে হাবিব খাঁ নামক একজন মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করবেন, রবীন্দ্রনাথের মুসলমানীর গল্পের তিনিই প্রধান চরিত্র। সৌমিত্র বাবু অনেকক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার কিছুটা কাছে এলেন। তিনি নিকটে এসে আমার কাছেই জানতে চাইলেন, আমি কি আপনাদের আলোচনায় যোগ দিতে পারি?

বললাম, অবশ্যই।
আমি সামান্য সরে গিয়ে ওনাকে চৌকিতে বসার ব্যবস্থা করে দিলাম। তিনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সৌমিত্র বাবু বসলেন। তিনি অলোচনায় অংশ গ্রহণ করার ভিতর দিয়ে আমাদের আলোচনা নানান মাত্রা পেল। কিছুক্ষণ পর আলোচনার ভিতরে মহাভারত ও গীতাসহ নানা প্রসঙ্গ চলে এলো। বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা চলছিল তখন। সৌমিত্র বাবু হঠাৎ খেলা দেখার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন। নব্যেন্দুদাকে বললেন, নব্যেন্দু, তোমার সুটিং আরম্ভ হতে মনে হয় দেরি হবে, আমি কিছুক্ষণ নিচে গিয়ে ক্রিকেটের স্কোরটা দেখে আসি।

নিচের তলায় মূল ভবনের ঠিক বাইরে নিরাপত্তা রক্ষীর বাসায় টেলিভিশন ছিল। নিরাপত্তা রক্ষী আগেই সৌমিত্র বাবুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি চাইলে তার বাসায় ক্রিকেট খেলা দেখতে পারবেন। সৌমিত্র বাবু আমাকে বললেন, চলুন, নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখে আসি। খেলা দেখার আগ্রহ আছে তো আপনার?
বললাম, সুযোগ থাকলে ক্রিকেট খেলাটা দেখি।

দুজনে আমরা নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ ক্রিকেট খেলা দেখলাম। সুটিংয়ের কারণে আবার ফিরে এলাম। রাত হয়ে যাওয়াতে সেদিন মাত্র ছোট ছোট দুটো শট নেয়া হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর বিজরী বরকতউল্লাহর। শটটা নেয়া হয়েছিল জমিদার ভবনের দোতলা থেকে নিচে যে সিঁড়িটা নেমে গেছে, সেখানে। সম্ভবত কয়েকটা এমন সিঁড়ি ছিল ভবনে। শট নেয়ার সময়ে নব্যেন্দুদা আমাকে কাছে ডেকে মনিটরে চোখ রাখতে বললেন। শট নেয়ার পর জানতে চাইলেন, কী ঠিক আছে? আমি জানতে চাইলাম, মনে হচ্ছে গল্পটাকে আপনি ভিন্নভাবে সাজাচ্ছেন?

তিনি বললেন, ঠিক তাই। আপনার এ ব্যাপারে কী মন্তব্য?
বললাম, সৌমিত্র বাবুর মেক-আপ আর পোশাকক দেখে বুঝতে পারছিলাম, গল্পটা আপনি নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চান। নতুনভাবে সাজাচ্ছেন যখন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কিন্তু সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।
 
নব্যেন্দুদা বললেন, আপনি আমার মনের কথাটাই বলেছেন। গল্পের ভিতরটাতে আমার চোখ, মূল বক্তব্য ঠিক রেখে ভিন্ন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে চাই।

সুটিং শেষে আমরা রিসোর্টে ফিরছি। নব্যেন্দুদার গাড়িতে আমরা চারজন। নব্যেন্দুদা সামনের আসনে বসেছেন চালকের পাশে। পিছনে সৌমিত্র বাবু, চিত্রগ্রাহক এবং আমি। সৌমিত্র বাবুর পাশেই মাঝখানের আসনে আমি বসেছি। গাড়িটা মূলত সুটিংয়ের জন্য ভাড়া করা ফোর হুইলের একটা জীপ। গাড়ি কিছুক্ষণ চলার পর নব্যেন্দুদা সৌমিত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, সৌমিত্র ‘সিগনেচার’ চলবে নাকি? সৌমিত্র বাবু মনে করলেন নব্যেন্দুদা জানতে চাচ্ছেন, তিনি স্বাক্ষর করে পারিশ্রমিকের চেকটা নিয়েছেন কিনা। সৌমিত্র বাবু তাই বললেন, সিগনেচার আমি করে দিয়েছি তো অনেক আগেই।

নব্যেন্দুদা বললেন, সে সিগনেচার নয়, আমার বন্ধুর সম্মানে আমি একটা বড় ‘সিগনেচার’ কিনেছি। রিসোর্টে গিয়ে তুমি কি আমাদের সঙ্গ দেবে?
সিগনেচার একটা হুইস্কির নাম। সৌমিত্র বাবু এবার কথাটা বুঝতে পারলেন। বললেন, নয় কেন? অবশ্যই।
 
গাড়ির ভিতরে সৌমিত্র বাবু আমাকে অনেক ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের গাড়িবাড়ি ও পণ্যদ্রব্যের মূল্য সম্পর্কে। রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটার মতো হয়ে গেল। সকলে আমরা হাতমুখ ধুয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নব্যেন্দুদার কক্ষে উপস্থিত হলাম। নব্যেন্দুদাকে বিরাট এক আলিশান কক্ষ দেয়া হয়েছে। কয়েকজন বসে আড্ডা দেবার সবরকম ব্যবস্থা আছে সেখানে। চলবে