হীরক রাজা দেশে চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

হীরক রাজা দেশে চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকদিন’

পর্ব ২

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১

রিসোর্টে নব্যেন্দুদার কক্ষে চারজন আমরা আড্ডায় বসেছি, কথাবার্তা হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে সৌমিত্র বাবু একটা হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। বহুক্ষণ ধরে আমাদের পরিচয় বা কথাবার্তা হলো কিন্তু আমি একবারও তার চলচ্চিত্র বা অভিনয় প্রসঙ্গে একটি কথাও বলিনি। সাধারণত তারকাদের সঙ্গে দেখা হলে ভক্তরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে নানান আপ্তবাক্য বলতে থাকে। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লক্ষ্য করেছেন, এ ব্যাপারে আমি পুরো সময়টা নির্বাক। যতক্ষণ কথাবার্তা বলেছি বা আমরা গল্প করেছি, সর্বক্ষণ দুজন ব্যক্তি হিসেবেই মতবিনিময় করেছি। তিনি এক সময়ে ধরেই নিয়েছিলেন, হয়তো আমি ছবিটবি দেখি না। রাতে আমাদের আড্ডার সঙ্গে পানাহার চলছিল নব্যেন্দুদার কক্ষে বসে।

নব্যেন্দুদার জন্য আমি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘ক্রীড়নক’ নামের আমার নাটকের একটা বই নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে দেব বলে। নব্যেন্দুদার হাতে সেটা দিলে তিনি বললেন, ‘থাক এখন, পরে দেখবো। আপনার আগের দুটো নাটকই কিন্তু আমি পড়েছি।’
বললাম, ‘জানি। আপনি আমাকে চিঠিতে লিখেছিলেন।’

বিভিন্ন রকম গল্প হচ্ছিলো আমাদের। নব্যেন্দুদা যখন ঢাকায় গিয়েছিলেন, তখন তাকে আমি একদিন দুপুরে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলাম। রামেন্দু মজুমদার, শিবলী সাদিকসহ আরো কয়েকজনকে আমন্ত্রণ করি সেদিন। নব্যেন্দুদা সেদিনের সেই আড্ডায় নিমন্ত্রিত রামেন্দুদা, শিবলী ভাই ওনাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন।

সৌমিত্র বাবু একসময়ে নব্যেন্দুদাকে বললেন, দীর্ঘ আলোচনা করে বুঝলাম, আপনার বন্ধু অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। মহাভারত নিয়ে তার আলোচনা আমার কাছে অন্যরকম লেগেছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের প্রতি কোনো আকর্ষণ আছে কিনা বুঝতে পারছি না।

নব্যেন্দুদা বললেন, বলো কি সৌমিত্র, চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি কম বেশি অনেক পড়াশুনা করেছেন। চলচ্চিত্র উৎসবেই তো আবার তার সঙ্গে বহু বছর পর আমার দেখা হলো। ১৯৮৩ সালে প্রথমবার কলকাতায় আসেন চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিনিধি হয়ে। তখনই আমার প্রথম পরিচয় রাহমান ভাইর সঙ্গে, তারপর সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছিলেন। আবার বহু বছর পর ঢাকার একটি চলচ্চিত্র উৎসবে খুঁজে পাই তাকে। চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ কিছু লেখা আছে তার। আমাদের খেয়ালী দস্তিদার, জোছন দস্তিদারের পরিবারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্টতা তার।

নব্যেন্দুদার কথা শেষ হলে সৌমিত্র বাবু বললেন, কিন্তু এতক্ষণ যে আমরা কথা বললাম, তিনি চলচ্চিত্রের আশেপাশে দিয়ে গেলেন না। সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন নিয়ে কথা বললেন।
নব্যেন্দুদা বললেন, কারণটা বলি তোমাকে, ভারতবর্ষের তো বটেই, বিশ্বের বেশির ভাগ চলচ্চিত্রকে উনি চলচ্চিত্র মনে করেন না। মনে করেন চলচ্চিত্রের নামে কিছু মাথামোটা লোকের দৌরাত্ম্য চলছে। চলচ্চিত্র জগতে চার্লি চ্যাপলিন তার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব।

সৌমিত্র বাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই নাকি? সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে তাহলে আপনার কী ধারণা?
বললাম, বাংলার শ্রেষ্ঠ ছবিটা এখন পর্যন্ত তার বানানো।
তিনি জানতে চাইলেন, কোনটা?
বললাম, তার প্রথম ছবি, পথের পাঁচালী। যদিও পরের দুটি ছবি আমার তেমন ভালো লাগেনি। ‘অপুর সংসার’ আর ‘অপরাজিত’। পথের পাঁচালী যিনি বানিয়েছেন, তিনি পরের ছবিতে আমাকে হতাশ করেছেন।
 
সম্ভবত সৌমিত্র বাবু এত স্পষ্টভাবে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে এমন মন্তব্য শুনবেন আশা করেননি। তিনি জানতে চাইলেন, মানিক বাবুর তাহলে মাত্র একটি ছবি আপনার ভালো লেগেছে, পথের পাঁচালী?

বললাম, না, তা কেন হবে? ‘সীমাবদ্ধ’ ভালো লেগেছে খুব। শতরঞ্জ কী খিলারি, আরো অনেক ছবি। শেষদিকের ছবি আগন্তুক। বাংলা ছবি সত্যজিৎ বাবুর হাত ধরেই চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্রের অভিনয় যে কী তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন ভারতের চলচ্চিত্রে। স্বাভাবিক অভিনয় তিনিই প্রথম বাংলা ছবিতে এনেছেন। তিনিই আবার চলচ্চিত্র অভিনয়ের ভিন্ন আঙ্গিক দেখিয়ে দিয়েছেন তার ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে। তিনি বিরাট প্রতিভা, সন্দেহ নেই।

সৌমিত্র বাবু জানতে চাইলেন, হিন্দি ছবি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটি কী।
বললাম, হিন্দি ছবি খুব কম দেখেছি। সত্তর দশকের আগের ছবি বলতে গেলে দেখাই হয়নি। পরবর্তীকালে শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনী, মুজাফফর আলী, সাঈদ আখতার মির্জাদের ছবিগুলি দেখেছি। বলতে গেলে হিন্দি ছবি এসব পরিচালকের হাত ধরেই সত্যিকার চলচ্চিত্র হতে পেরেছে। ঠিক তার আগে হিন্দি ছবির বিরাট বাজার ছিল, কিন্তু সত্যিকারের চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পেরেছে খুব কম ক্ষেত্রেই। বরং সঙ্গীত চর্চায় যথেষ্ট অবদান রয়েছে হিন্দি ছবির। ছবির চেয়ে ছবির গানগুলি বেশি আলোচিত। সামনের শত বছরে, ছবির চেয়ে সে গানগুলিই হয়তো বেশি আলোচিত হবে। ভারতের বহু সুরকার আর সঙ্গীত শিল্পীর জন্ম দিয়েছে বা তাদের প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ করে দিয়েছে হিন্দি ছবি।

নব্যেন্দুদা স্বীকার করলেন কথাটা সত্যি। সৌমিত্র বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কার বাংলা ছবি দেখেছেন?
বললাম, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার, তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন সহ বহুজনের দেখেছি। নব্যেন্দুদার কয়েকটা ছবি দেখেছি।

তিনি জানতে চাইলেন, তাদের বাইরে আর কারো ছবি দেখেননি?
বললাম, নিশ্চয় বহু ছবি দেখেছি আরো অনেকের, সবার নাম মনে পড়ছে না। আমাদের বাংলার নির্মিত অনেক চলচ্চিত্র দেখেছি।
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, বাংলার উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখেছেন কি?
বললাম, কয়েকটি ছবি দেখেছি, কিন্তু কখনোই সেসব ছবি আমাকে টানেনি। সুচিত্রা সেন আর বসন্ত চৌধুরীর ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিটা বহু আগে দেখেছিলাম, কম বয়সে তখন বেশ ভালো লেগেছিল। এখন কেমন লাগতো জানি না। তবে গানের একটা দৃশ্য আছে সে ছবিতে ‘এই রাত তোমার আমার’। দৃশ্যটা দেখে তখনই মুগ্ধ হয়েছিলাম, গানের এত সৃষ্টিশীল ব্যবহার কম ছবিতে দেখেছি। তবে সুচিত্রা উত্তমের ছবি আমাকে টানে না, মনে হয় খুব কৃত্রিম অভিনয়; খুব কৃত্রিম গল্প ছবিগুলির।
সৌমিত্র বাবু হেসে বললেন, কিন্তু সাবধান! কার সামনে কী বলছেন! আপনি কি জানেন আমি উত্তম কুমারের একজন খুব বড় ফ্যান?
বললাম, সেটা তো হতেই পারে। কিন্তু তার অভিনয় আমাকে কখনো টানেনি। মানুষ হিসেবে উত্তম কুমার চমৎকার ছিলেন বলেই জানি।

নব্যেন্দুদা জানতে চাইলেন, সত্যজিৎ রায়ের একটি ছবিতে উত্তম কুমার অভিনয় করেছেন সেটা কি আপনি দেখেছেন?
বললাম, দেখেছি। সেটাও আমাকে খুব টানেনি। কখনো কখনো মনে হয়েছে শক্তিমান অভিনেতা হতে পারতেন। কিন্তু তারকা খ্যাতি তাকে তা আর হতে দেয়নি। আসলে অভিনয়ের চেয়ে মূল সঙ্কটটা হলো ছবির বিষয়বস্তুর। পরিচালকরা বেশির ভাগ তাদের ছবিতে বিষয়বস্তুর চেয়ে তারকাদের খ্যাতি ব্যবহার করতে চান। দর্শকরাও সেজন্য হলে যান তারকাদের দেখতে, তারকারা তাই অভিনয়ে মন দেয়ার চেয়ে নিজেদের ইমেজ ধরে রাখতেই ব্যস্ত থাকেন। মূল লক্ষ্য সকলের নিজের নিজের ইমেজ ধরে রাখা, যে ইমেজটা তারা দর্শকের মনে গেঁথে দিয়েছেন। কখনো সেই ইমেজটা ভেঙে তারা অভিনয় করতে চান না। গড়পরতা প্রযোজক পরিচালকারা সেই ইমেজটাই ছবিতে বিক্রি করতে চান।

কিছুক্ষণ পর সৌমিত্র বাবু বললেন, নিশ্চয় আপনি আমার অভিনয় দেখেছেন, আমার অভিনয় সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
সৌমিত্র বাবুর কাছ থেকে এরকম সরাসরি প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আপনার অভিনীত অনেক ছবিই আমি দেখেছি। তার মধ্যে সাঁতারুকে নিয়ে সরোজ দের তৈরি ‘কোনি’ ছবিটা আমি নিজে তিনবার দেখেছি। বহুজনকে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছি। সে ছবিতে ক্ষিদ্দার চরিত্রে আপনার অভিনয় দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছি।

তিনি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তার মানে অপুর সংসারের অপু বা আমার অন্য অভিনয় আপনার ভালো লাগেনি?
বললাম, ঠিক এই ক্ষেত্রে বিরাট সংখ্যক দর্শকের সঙ্গে আমার মত একেবারেই মিলবে না। সাধারণত কখনো অভিনয়কে আমি ছবির বিষয়বস্তু থেকে আলাদা করে দেখি না। যদি আমাকে বলতে বলেন, বিনয়ের সঙ্গে সত্য কথাটাই বলবো। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মত এটা আমার, সত্যজিৎ বাবু অপুকে ঠিক মতো সৃষ্টি করতে পারেননি তার ‘অপুর সংসার’ ছবিতে। মতটা আমার ব্যক্তিগত। পথের পাঁচালীতে তিনি যা পেরেছেন, অপুর সংসার বা অপরাজিত ছবির ক্ষেত্রে তা পারেননি। পথের পাঁচালীর দুর্গা আর অপুর মতো জীবন্ত হয়ে ওঠেনি অপুর সংসারের অপু। পুনরায় বলছি মতটা আমার ব্যক্তিগত। সমালোচকরা বা সাংবাদিকরা কী বলেছেন সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। ছবিটা দেখে আমি সেভাবে খুশি হতে পারিনি। কিন্তু অপরাজিতের শেষ দৃশ্যটি তিনি অসম্ভব রকম সৃষ্টিশীল করে তুলেছিলেন। তিনি ছবির ভাষাটা খুবই রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু তারমানে এ নয় যে তিনি সবক্ষেত্রে সফল হবেন। কেউ কখনো তা হয় না। আমার প্রিয় চলচ্চিত্রকার চ্যাপলিন, শক্তিমান অভিনেতা। কিন্তু ‘মশিয়ে ভার্দু’ ছবিতে সঠিক অভিনয় করতে পারেননি। চিরায়ত ট্র্যাম্প চরিত্রটি সেখানে তার অভিনয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সৌমিত্র বাবু বললেন, বুঝলাম আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটি ভিন্ন। যাক আপনি স্বীকার করছেন, ‘কোনি’ ছবিতে আমি অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছি।
বললাম, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, হীরক রাজার দেশে ছবিতে আমি ছিলাম। সেখানে আমার অভিনয় সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
বললাম, চট করে উত্তর দেয়া কঠিন। বরং আপনার অভিনয়ের চেয়ে আপনার চরিত্রটি নিয়ে কথা বলি। সত্যজিৎ রায় আপনার চরিত্রটি ঠিক মতো সৃষ্টি করতে পারেননি।
তিনি চমকে গিয়ে বললেন, মানে? কী বলতে চাইছেন!
বললাম, খেয়াল করুন, পুরো ছবির বক্তব্য হচ্ছে প্রহসনধর্মী। সবাই সেখানে বিচিত্র ভঙ্গিতে অভিনয় করছে। সেটাই ছবির প্রাণ, ছন্দে বাঁধা সংলাপ। রাজদরবারের কথা বলছি। বিজ্ঞানীর কথা বলছি। সকলেই তারা বাস্তবতা ভাঙ্গছে। স্বাভাবিক অভিনয় করছে না। কারণ ছবির গল্পটাই স্বাভাবিক না, রূপক। কিন্তু ব্যাঙ্গাত্মক একটা প্রহসনের মধ্যে আপনার চরিত্রটি হয়ে দাঁড়ালো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মূল বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা রক্ষা হলো কি তাতে? ফলে আপনার অভিনয় আমার কাছে আর মূল বিষয় রইলো না, চলচ্চিত্রকারের বা গল্পকারের দ্বারা সৃষ্ট আপনার চরিত্রটাই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলো না। বিরাট এক প্রহসনের মধ্যে আপনার চরিত্রটা কেবলমাত্র হয়ে গেল স্বাভাবিক। সস্তা বিপ্লবী বানিয়ে দেয়া হলো আপনার চরিত্রটিকে। দু চারটা কথা বলে একদল শিশুকে নিয়ে রাতারাতি বিপ্লব করে ফেললেন আপনি। ছবির শেষ অংশ দেখার পরে দর্শক কী মনে করবে? রাজার পরিবর্তন বা পরাজয় কী আপনার মতো বিপ্লবীর জন্য, নাকি যন্তর মন্তরের জন্য? কার ভূমিকা প্রধান? ছবির বিষয়বস্তু এখানে এসে পথ হারিয়ে ফেলে। হীরক রাজার দেশে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি। কিন্তু আপনার চরিত্রটি কিছুতেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হতে পারে আমার সঙ্গে আপনাদের চিন্তা মিলবে না।

নব্যেন্দুদা বললেন, হীরক রাজার দেশে সম্পর্কে আপনার এ বক্তব্যটা গ্রহণযোগ্য। ছবির মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে সৌমিত্রর চরিত্রটি যায় না। অন্য সকল চরিত্রের সঙ্গে সৌমিত্রর চরিত্রটি বেমানান বা আলাদা। ব্যাপারটা আপনি বলার আগে আমার খেয়াল করা হয়নি। কিন্তু আপনি বলার পর মনে হচ্ছে, ঠিকই তো। সৌমিত্রের চরিত্রে এসে ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। রূপক থেকে সেখানে ন্যাচারালিস্টিক হয়ে গেছে অভিনয়। সৌমিত্র তুমি কি বলো?

কিছুক্ষণ সৌমিত্র বাবু চুপ করে থাকলেন। হতে পারে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি বললেন, রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে। ঠিক রাত বারোটার মধ্যে আমি শুয়ে পড়ি। আজ উঠি, কাল আবার কথা হবে।
নব্যেন্দুদা বললেন, সৌমিত্র একটু বসো। রাহমান সাহেব সম্পর্কে তোমাকে একটু বলি। উনি সম্প্রতি পিএইচডি করেছেন রাজনৈতিক নাটক নিয়ে। আমার সেই থিসিস কিছুটা পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমি সেখানে বহুকিছু নতুন কথা জানতে পেরেছি। মনে হয়, বই আকারে বের হলে যদি তুমি পাঠ করো, ভালো লাগবে। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, তার পরবর্তী বইটি লিখবেন অভিনয় নিয়ে। নিশ্চয় আমরা তার বইটি পড়বার জন্য অপেক্ষা করবো। ভাগ্যক্রমে তার ‘রাজনৈতিক নাট্য’ থিসিসের পরীক্ষক ছিল আমাদের দর্শন চৌধুরী। সেকারণেই তার থিসিস সম্পর্কে আমার বহু কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। আমি তার দু-দুটো নাটকও পড়েছি। তিনি আমার জন্য ঢাকা থেকে তার লেখা নতুন একটি নাটকের বই নিয়ে এসেছেন। রাহমান ভাই, বইটা আমাকে না দিয়ে সৌমিত্রকে দিন। সৌমিত্র আপনার লেখার সঙ্গে পরিচিত হোক। পরে আবার আমার জন্য আর একটা কপি নিয়ে আসবেন।

নব্যেন্দুদা তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বুঝতে পারলাম, নব্যেন্দুদা আমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মাঝখানে জাতিসংঘের ভূমিকা পালন করতে চাইছেন। তিনি পরিবেশটাকে হালকা করতে চান। সৌমিত্র বাবু নিশ্চয় আমার উপর রেগে গেছেন এমন ধারণা থেকেই নব্যেন্দুদা কথাগুলি বলছিলেন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, সৌমিত্র বাবু চুপচাপ থাকলেও স্বাভাবিক আছেন। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নাটক নিয়ে আমার পিএইচডি করা, বা অভিনয় নিয়ে বই লিখছি কথা দুটি সৌমিত্র বাবুকে কিছুটা চমকিত করেছে বলে মনে হলো। মিষ্টি হেসে আমি সৌমিত্র বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমার বক্তব্যে আহত হয়েছেন?

তিনি বললেন, না। তিনি একটু পরে আবার বললেন, স্বীকার করছি, আমার অভিনয় নিয়ে আপনার মতো বক্তব্য শুনে আমি অভ্যস্থ নই। তিনি তারপর বললেন, বিভিন্ন রকম মতামত আপনি দিয়েছেন। আমার তৃপ্তি এই যে, আমি মানিকদার অনেকগুলি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। দর্শক আমাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু আপনার সব বক্তব্য আমি শোনার চেষ্টা করেছি। কখনো কেউ আমাদের সামনে এভাবে করে বলেন না, সেটাও ঠিক। আপনার সঙ্গে আমার যে আলোচনা হলো, সেটা আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা স্বীকার করছি।

খুব বিনয়ের সঙ্গে তাকে বললাম, যাই হোক, আপনাকে কি আমার লেখা একটা নাটকের বই দিতে পারি?
তিনি বললেন, অবশ্যই।
আমার লেখা ‘ক্রীড়নক’ নাটকটা তাকে দিলাম। রাত তখন বারোটা বেজে গেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, নিজের কক্ষে চলে যাবার জন্য। নব্যেন্দুদা তাকে আরো একটু বসতে বললেন। তিনি বললেন, রাত বারোটার পর আমি আর জেগে থাকি না। বয়সের কথা ভেবে কিছু কিছু নিয়ম আমি মেনে চলি। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, কতদিন আর আপনি আছেন এখানে?

বললাম, আগামীকাল রাতটা থাকবো, তারপর দিন চলে যাব।
তিনি বললেন, কাল সকালে দেখা হচ্ছে আবার। কথাটা বলে তিনি চলে গেলেন আমার বইটা হাতে নিয়ে। চলবে