রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকদিন’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২১

বইটা হাতে নিয়ে সৌমিত্র বাবু চলে যাবার পর নব্যেন্দুদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চালাকিটা একেবারেই শেখেননি। দেখছি আমার মতোই আপনিও সহজেই মানুষকে শত্রু বানাতে পারেন। সৌমিত্র যে একজন ভালো অভিনেতা তা সরাসরি স্বীকার করলে কী সমস্যা হতো? বললেই পারতেন আপনার অভিনয় ভালো লাগে। হাসিখুশি বন্ধুত্বপূর্ণ আড্ডার ভিতরে তার মনটাই খারাপ করে দিলেন আপনি।
রসিকতা করে বললাম, নব্যেন্দুদা দেখছি কলকাতার পক্ষ নিয়ে ঢাকার প্রতি আক্রমণ চালাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, কলকাতা কলকাতা ভাই ভাই।
নব্যেন্দুদা হেসে বললেন, মশায়, আপনি তো দুদিন পর ঢাকায় কেটে পড়বেন। সবাইকে নিয়ে আমাকে কলকাতায় থাকতে হবে। কাল সকালে আমার ছবির সুটিং, বুঝতে পারছেন? আর আজ রাতে আপনি সৌমিত্রকে যা খুশি বলে মন খারাপ করে দিলেন।

নব্যেন্দুদার হাতে চাপ দিয়ে বললাম, সারেণ্ডার নব্যেন্দুদা। ঠিক আছে, দেখবেন কাল তার মনটা আমি ভালো করে দেব।
নব্যেন্দুদা জানতে চাইলেন, ঠিক বলছেন তো?
বললাম, শতভাগ। তবে মিথ্যা কিছু বলবো না। কারণ মঞ্চে আমি তার নাটকের অভিনয় দেখেছি। সেটা নিয়ে তো কথা বলার সুযোগ আজ পেলাম না। তিনি তার ছবির অভিনয় নিয়েই জানতে চেয়েছিলেন। আমি কিন্তু তাকে একবারও খারাপ বা দুর্বল অভিনেতা বলিনি। বা বলিনি তিনি শক্তিমান অভিনেতা। অভিনয়কে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন্ চোখে দেখি, সেটা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কথা বলেছি আমি ছবিগুলির ত্রুটি নিয়ে। ধরা যাক হীরক রাজার দেশে, সেখানে সৌমিত্র বাবুর অভিনয় নিয়ে কথা বলার সময় সেই ছবিটার সঙ্গে তার অভিনীত চরিত্রের অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেছি। অভিনেতাদের আমি তারকা হিসেবে দেখি না, অভিনেতা হিসেবে দেখি। অভিনীত চরিত্রকে বিচার না করে সত্যিকারের অভিনয় বিচার করা যায় না। শাইলক চরিত্রের ভিতর দিয়ে শেক্সপিয়ার কী বলতে চেয়েছেন সেটা ধরা গেলেই, লরেন্স অলিভারের শাইলক চরিত্রে অভিনয়টা কেন বড় মাপের সেটা মূল্যায়ন করা যায়। হীরক রাজার সব চরিত্র আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও, বিদ্যালয় পণ্ডিতের চরিত্রটা সেই ছবির মূল কাঠামোর সঙ্গে বাস্তবানুগ মনে হয়নি। অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র বাবু হয়তো প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। পুরো ছবির অভিনয়টা যেখানে নাটকীয় এবং প্রহসনমূলক, সেখানে তার চরিত্রটা বাস্তববাদী কেন?

নব্যেন্দুদা বললেন, ঠিক আছে ছবি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন মেনে নিচ্ছি। কিন্তু সৌমিত্র যে খুব বড় মাপের অভিনেতা, বিশেষ করে কিছু কিছু চরিত্রের জন্য সেটা কি মানছেন?
বললাম, না। মানছি না। আমার আপত্তি সেখানেই, কিছু কিছু চরিত্রের জন্য তিনি মানানসই কথাটাতেই আমার যতো আপত্তি।
নব্যেন্দুদা বললেন, সৌমিত্র যে বড় মাপের অভিনেতা তাহলে কি আপনি কিছুতেই সেটা মানবেন না?
বললাম, নব্যেন্দুদা, আপনি আমাকে সৌমিত্র বাবুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন কেন? চট করে কারো অভিনয়ের ভালোমন্দ সম্পর্কে এক কথায় মন্তব্য করা যায় না। বিশেষ করে সৌমিত্র বাবুদের মতো জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে। খুব শিশু বয়স থেকে আমি দিলীপ কুমারের অভিনয়ের ভয়াবহ প্রশংসা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। নিজের আত্মীয়স্বজনদের মুখেই। ফলে তিনি আমার কাছে ছিলেন বিরাট এক কিংবদন্তী। কিন্তু তার ছবি দেখার সুযোগ তখন আমাদের ছিল না। কারণ ভারত পাকিস্তান তখন আলাদা দেশ। পঁয়ষট্টির পর ভারতের ছবি পাকিস্তানে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি মনের মধ্যে বহুকাল দিলীপ কুমারের অভিনয় দেখার ইচ্ছাই লালন করেছি। খুবই আকাঙ্ক্ষিত ছিল তার অভিনয় দেখাটা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম যখন তার অভিনয় দেখলাম, মানে দেখার সুযোগ হলো; খুব হতাশ হয়েছিলাম।

নব্যেন্দুদা যেন একটা ধাক্কা খেলেন। খুব জোরে হাসি দিয়ে বললেন, দিলীপ কুমারের জনপ্রিয়তার পরিমাণটা কত ব্যাপক, আপনি কি তা জানেন? একটা যুগ তিনি জনপ্রিয়তার ভিতর দিয়ে পার করেছেন। আপনি তো বাচ্চা ছেলে।
বললাম, দিলীপ কুমারের পরে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা ছিল সম্ভবত রাজেশ খান্না, কিন্তু আপনি কি বলবেন, তিনি বড় মাপের অভিনেতা?
নব্যেন্দুদা বললেন, ছাড়ুন আমার কথা, আগে আপনার বক্তব্যটা শুনি।
বললাম, কথাটা হলো, দিলীপ কুমার কত বড় অভিনেতা এর মাপকাঠিটি কী হবে? তিনি যেসব গল্পে অভিনয় করেছেন বা তৎকালে সকলে যেসব গল্পে অভিনয় করতেন তার সবটাই ছিল উচ্চকিত। পরিচালকদের বাছাই করা গল্পটা উচ্চকিত হলে তার অভিনয়টা উচ্চকিত হতে বাধ্য। ফলে দিলীপ কুমারের অভিনয়টা ছিল উচ্চকিত, স্টাইলিশ অভিনয়। ক্ষমা করবেন নরেব্যন্দুদা, বলা ভালো স্থূল অভিনয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা কোনো অভিনয় করেননি। বিহেভ করেছেন। ভালো মানুষের কতগুলি সূত্রবদ্ধ ধারণা সৃষ্টি করে চলে গেছেন। নায়ক মানেই চূড়ান্ত ভালো মানুষ, সেইরকম সব অবাস্তব চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক হৃদয় জয় করেছেন। কিন্তু বাস্তব জগতে কোনো মানুষ সম্পূর্ণ ভালো বা মন্দ হয় না। তখনকার গল্পগুলিই ছিল সূত্রবদ্ধ, ফলে অভিনয় সূত্রবদ্ধ হতে বাধ্য। যান্ত্রিক হতে বাধ্য। সব ছবিতে সুচিত্রা সেনের একই রকম হাসির ভঙ্গি! সব ছবিতে সুচিত্রা সেন, দিলীপ কুমার, উত্তম কুমারদের বিহেভ বা কিছু ম্যানারিজম দেখেছি। দর্শকরা তাতেই খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু আপনি নব্যেন্দু সেন কি তাতে সন্তুষ্ট হবেন?

নব্যেন্দুদা বললেন, না, তা হবো না। কিন্তু তারা দর্শকের মন জয় করেছে। সত্যি করে বলেন তো, আপনার মতে তাদের অভিনয়ের মূল সঙ্কটটা কী ছিল?
বললাম, সব সময় তারা সুচিত্রা, দিলীপ আর উত্তমই থাকছেন; অভিনীত চরিত্র হবার চেষ্টাটা পর্যন্ত করছেন না, করতে হচ্ছে না। কারণ চরিত্রগুলিই ছকে বাঁধা। দর্শকরা তখন সেটাই গ্রহণ করছে। সূত্রবদ্ধ ছবি দেখেই দর্শকরা মুগ্ধ। যদি একটা ছবি দেখেন, সূত্রবদ্ধ বাকি সব ছবিই দেখা হয়ে যায়। ঠিক একই রকম অভিনয় আর কিছু ভঙ্গি। প্রতি ছবিতে একই রকম হাসি আর কান্না এবং একই রকম সংলাপ প্রক্ষেপণ। কিন্তু তার জন্য শুধুমাত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দোষ দিয়ে লাভ কী? ধরা যাক, পথের পাঁচালীর কানু ভৌমিক বা করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়। নিজেদের প্রতিভার সঙ্গে গল্পের কাঠামো মিলেমিশে তারা সার্থক অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। গল্পটা স্বাভাবিক, ফলে অভিনয় স্বাভাবিক। সত্যজিৎ রায়ের, মানে পরিচালকের সেখানে গভীর একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তেমন পরিচালকের তেমন স্বাভাবিক গল্পে দিলীপ কুমার অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন কি? নাকি বারবার তিনি কৃত্রিম গল্পের কৃত্রিম চরিত্রে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন? পরবর্তী সময় নাসিরউদ্দীন শাহ, ওমপুরী, ফারুক শেখ, শাবানা আজমী, স্মিতা পাতিল প্রমুখ যে সুযোগটা পেয়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনী, সাঈদ মির্জাদের মতো পরিচালকদের হাতে, দিলীপ কুমার কি তার সময়ে তা পেয়েছিলেন? ফলে একজন অভিনেতা কী রকম গল্পের কী রকম চরিত্রে অভিনয় করছেন, তার অভিনয়ের দক্ষতা বিচারের আগে সেটা বিচার করে দেখাটা জরুরি।

নব্যেন্দুদা বললেন, সৌমিত্র বাবু সম্পর্কে বলেন। তিনি যখন চলচ্চিত্রে এসেছেন বাংলা চলচ্চিত্রে তখন স্বাভাবিক অভিনয় কমবেশি এসে গেছে। ফলে তার অন্যান্য ছবিগুলির অভিনয় সম্পর্কে বলেন।
বললাম, ওনার সব ছবি আমি দেখিনি, সেজন্য এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু মন্তব্য করার অধিকার আমার নেই। সব ছবিগুলি দেখলে কোনির মতো মুগ্ধ হবার কারণ আরো বহুবার ঘটতে পারতো।

সৌমিত্র বাবুর ব্যক্তিগত অভিনয়ের প্রসঙ্গটা আমি আসলে তখন আলোচনায় এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নব্যেন্দুদা আমাকে ছাড়বেন না। নব্যেন্দুদা বললেন, রাহমান সাহেব, যে কয়টা ছবি আপনি দেখেছেন তার মধ্যে সৌমিত্রর অভিনয় সম্পর্কে মন্তব্য করেন। খুব গুরুত্বের সঙ্গেই আপনার মন্তব্য শুনতে চাই, কারণ আপনি অভিনয় নিয়ে কিছু একটা বই লিখবেন বলেছেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নব্যেন্দুদার চাপে পড়ে বললাম, ঠিক আছে, সৌমিত্র বাবু সম্পর্কে বলতে চাই। তিনি উচ্চকিত অভিনয় করেননি। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রে একই ধরনের অভিনয় করে গেছেন বা করতে হয়েছে। সৌমিত্র বাবু হচ্ছেন ভালো মানুষের, দায়িত্বশীল মানুষের প্রতীক। কারণ পরিচালকরা তাকে ভালো একজন মানুষের চরিত্রে সর্বদা অভিনয় করার সুযোগ দিয়েছেন। ফলে ওনার বিশেষ কিছু করার ছিল না, ভালো মানুষ সাজা ছাড়া। ফলে তিনি আমার কাছে তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দিনের পর দিন বিরক্তিকর এক ভালো মানুষ হয়ে উঠেছেন। কারণ ভালো মানুষ হওয়ার দায়িত্বটা আপনারা চলচ্চিত্রকাররা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। কথাটা বলার জন্য সৌমিত্র বাবু এখানে উপস্থিত থাকলে নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করতেন। নিশ্চয় আমি কী বলতে চাই আপনি বুঝতে পেরেছেন।

নব্যেন্দুদা বললেন, কিছুটা তো বুঝতেই পেরেছি। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থাকে। নিশ্চয় অভিনেতার দক্ষতা বলে কিছু আছে। যাক, আপনি আপনার বক্তব্যটা আগে সম্পূর্ণ করুন।
বললাম, পরিচালকরা সবাই সৌমিত্র বাবুকে একটি ভালো মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। ঠিক যেমন আপনি আপনার মুসলমানীর গল্পে তাকে ভালো মানুষের চরিত্রটাই দিয়েছেন। সবাই মিলে আপনারা তা করতে করতে তাকে টাইপ একটা চরিত্রের পরিমণ্ডলে নিয়ে এসেছেন। সকলেই যেন আপনারা বিশ্বাস করেন, সৌমিত্র শুধু ভালো মানুষের চরিত্রেই অভিনয় করতে পারেন। আমি নিজে একদিন ঠিক সেভাবেই তাকে আবিষ্কার করি। কিন্তু উৎপল দত্ত নানারকম ভালো মন্দ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নাসিরউদ্দীন শাহ, ওমপুরী, শাবানা আজমীদের বেলায় দেখেন; মহান মানুষ থেকে বেশ্যার দালাল সব চরিত্রে তাদের দেখা গেছে। নব্যেন্দুদা, আপনি সৌমিত্র বাবুকে একটি আদর্শ চরিত্রে অভিনয় করবার জন্যই তো এখানে ডেকেছেন। ফলে তিনি নতুন কী করবেন? তিনি বারবার নিজেকে ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে ‘নীতিবান মানুষ’ হিসেবে বা ঘরের নিরীহ ভদ্র ছেলেটি রূপে দর্শকদের সামনে হাজির করতে বাধ্য হয়েছেন। সেজন্যই হঠাৎ ঘরে বাইরে ছবিতে তিনি নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে সফল হতে পারেননি। তিনি আজ মুসলমানীর গল্পে বয়স্ক একটি চরিত্রে খুব স্বল্প সময় অভিনয় করেছেন, সেখানেও তিনি ভালো মানুষ। মহৎ এক ব্যক্তিত্ব। তবু আজ আমার তাকে খানিকটা ভালো লেগেছে। কারণ প্রথমবার তাকে আমি মুসলিম চরিত্রে, মানে নিজের পরিমণ্ডলের বাইরে ভিন্ন এক ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে প্রবেশ করতে দেখলাম, তিনিও চেষ্টা করলেন মুসলমান চরিত্রটি হয়ে উঠতে। মানে কিছুটা হলেও তার জন্য নতুনত্ব রয়েছে এ চরিত্রে। যা কিছু এতক্ষণ ধরে বলছি, সেটা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি অভিনয় সম্পর্কে। আমার সঙ্গে আপনাদের এক মত হতে হবে, মিলতে হবে তা নয়।

নব্যেন্দুদা বললেন, কিন্তু আপনি কি জানেন, ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি বহুজনের মনে শক্তভাবে গেঁথে আছেন।
বললাম, হতে পারে। সেটা সাধারণ দর্শকদের বিবেচনার একটা দিক। কখনো সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে তারা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বিচার করতে যাননি। কিন্তু যদি আমার কথা বলেন, সত্যজিতের ফেলুদা কখনো আমার কাছে উন্নতমানের রচনা বলে মনে হয়নি। ফলে এক্ষেত্রে সৌমিত্র বাবুর অভিনয় সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে বাধ্য। সত্যজিতের ফেলুদা কখনো আমার কাছে ধারালো বা তীক্ষ্ণ চরিত্র নয়। চরিত্রটি দ্বন্দ্ববহুল চরিত্র নয়, ফলে ফেলুদা চরিত্রের অভিনয় দেখার ইচ্ছাটাই তেমন আমার ছিল না। কিন্তু সোনার কেল্লা ছবিটা আমি দেখেছি। মুগ্ধ হবার কারণ ছিল না, মুগ্ধ হইওনি। বক্তব্যটা পুরো ছবিটার ব্যাপারে, সৌমিত্র বাবুর অভিনয় সেখানে প্রধান প্রশ্ন নয়। বলতে পারেন, সত্যজিতের ফেলুদার চেয়ে প্রফেসর শঙ্কু বরং আমার কাছে প্রিয়। সত্যি বলতে অভিনীত চরিত্রটিকে আমি আগে মূল্যায়ন করি, অভিনেতাকে বিচার করে দেখার আগে। প্রতিটা ছবিতে অনেক চরিত্র থাকে, কিন্তু মানুষ কিছু কিছু চরিত্রের অভিনয় দেখে কেন মুগ্ধ হয়? কারণ চরিত্রটার বিশালত্ব তাকে বেশি মুগ্ধ করে। মহাভারত আর মহাভারতের চরিত্রগুলি দ্বন্দ্ববহুল বলে তা আমাদের আকর্ষণ করে। পিটার ব্রুকের নির্দেশিত মহাভারতের অভিনয় দেখার জন্য তাই মানুষ দিনের পর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। মহাভারতে পুতপবিত্র ভালো মানুষ বলে কিছু নেই। সকলেই দোষ আর গুণের সমাহার। বাস্তব জগতেও তাই। বাস্তব জগতে ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটি বলে কিছু নেই। নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনীদের গল্পের প্রধান চরিত্রের মতো সম্পূর্ণ ভব্য-সংস্কৃতিবান মানুষ বলে কিছু নেই। বাস্তব জগতে আলাদাভাবে নায়ক-নায়িকা বা খলনায়ক বলে কিছু নেই। বাস্তব জগতে যিনি একজনের কাছে নায়ক, ভিন্ন জনের কাছে তিনিই খলনায়ক।

নব্যেন্দুদা বললেন, বুঝলাম আপনার চিন্তাভাবনা। আমি অনেকটাই আপনার সঙ্গে একমত।
নব্যেন্দুদাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, যা আমি বললাম, সেটা আমার পুরো ভাবনার একটি খণ্ডিত দিক। ফলে এই খণ্ডিত আলোচনা থেকে আমাকে ভুল বুঝবার কারণ থাকতে পারে। অভিনয় নিয়ে আমার আরো নানা প্রশ্ন আর কথা আছে। তবে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা আপনাকে বলে রাখি, মনোমুগ্ধকর অভিনয় সম্পর্কে আমরা ধারণা তৈরি হয়েছে আকাশবাণীর নাটক শুনে। চলচ্চিত্র দেখে নয়। শুধু কণ্ঠস্বর শুনে, সংলাপ বলার ভঙ্গি থেকে ছেলেবেলায় চরিত্রগুলিকে অবলীলায় এঁকে নিতে পারতাম। অথচ চলচ্চিত্রে অনেক সময় চরিত্রগুলির অভিনয় দেখে আর শুনেও তা পারি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মহৎ অভিনয়ের জন্য দরকার মহৎ সাহিত্য বা সৃষ্টিশীল রচনা, আর ভিন্ন দিকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের বাস্তব জগৎ সম্পর্কে গভীর বোধ থাকতে হয়। দর্শকের সামনে কণ্ঠস্বর নিয়ে, শরীরের ভাবভঙ্গি নিয়ে অর্থবোধকভাবে বিচিত্র প্রকারে খেলতে জানতে হয়। বাস্তবের মধ্যে থেকে বাস্তবকে ভেঙে বাস্তব অভিনয় করা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ অভিনয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘পেপার চেজ’ ছবিতে জন হাউসম্যানের অভিনয় হলো তার উদাহরণ।

নব্যেন্দুদা এরপর কথা বলা শুরু করলেন। দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকলাম। তিনি বললেন, চলচ্চিত্রের জগৎটা আসলে কী। সত্যি বলতে এটা হলো আফিমের জগৎ। কিছু মানুষ চলচ্চিত্র দেখার নেশায় বুদ হয়ে থাকে। বছরের পর বছর চলচ্চিত্র দেখে কিন্তু কেন দেখে বলতে পারবে না। অন্তত এই গোটা ভারতবর্ষে। ধর্মের মতো বিশ্বাস নিয়ে বা নেশাখোর মানুষের মতোই মানুষ চলচ্চিত্র দেখে, না দেখলে তাদের চলে না। মানুষ চলচ্চিত্র দেখে এবং কিছু নায়ক নায়িকাকে পূজা করতে শেখে। সম্পূর্ণ অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে এই পূজা চলে। নায়ক নায়িকাদের কিছুদিনের জন্য দেবতার আসনে বসিয়ে দেয়। ভারতের বাইরে দেখেন, কমবেশি এটা আছে। না হলে এলভিস প্রিসলির জন্য মানুষ আত্মহত্যা করবে কেন? কারণ প্রিসলি তাদের কাছে দেবতার তূল্য। সেই দেবতাকে দেখার জন্য তারা মঞ্চে আসে, চলচ্চিত্র দেখে। বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য নয়। চলচ্চিত্রকারের যুক্তিবোধ তারা দেখতে আসে না। দর্শকদের দোষ দিচ্ছি না। হ্যাঁ, দায়টা আমাদের। আমরা আমাদেরর দায়িত্ব পালন করিনি। কারণ চলচ্চিত্র বাণিজ্য করতে পারে। মুনাফার জন্য আমরা তারকা নামক দেবতা এবং দেবীদের সৃষ্টি করেছি। আপনার সঙ্গে আমি একমত। ফলে যখন কেউ ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে উন্নত মানের বা বক্তব্য প্রধান ছবি করতে চান, তারা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যান। সেই ঝুঁকি কমিয়ে ফেলতে তারাও তারকাদের সঙ্গে রাখেন। মনে করেন, তারকারা থাকলে ছবিটা মুনাফা করবে। কিন্তু এর ফলে সমস্যা তো হয়ই। কখনো তারকারা সেই পরিচালকের প্রতি সম্মান দেখান, কখনো পুরোটা দেখাতে পারেন না। না পারার একটা কারণ, একই সময়ে তাদের আরো বহু ছবিতে কাজ করতে হয়। ফলে বিশেষ ছবিটার প্রতি পুরো মনোযোগ দিতে পারেন না। চাইলেও চরিত্রটি সৃষ্টি করবার সময়টি পান না।

কিছুটা থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, সত্যজিতের পথের পাঁচালীর আপনি ব্যাপক প্রশংসা করেন। খেয়াল করে দেখেন, সে ছবিতে একজনও তারকা নেই এবং সত্যজিৎ বাবুর প্রথম ছবি। ছবিটার অভিনয়ের মান সে কারণে রক্ষা করা গেছে। যদি তৎকালীন চলচ্চিত্রের তারকাদের নিয়ে ছবিটা করতে চাইতেন, পারতেন না। সত্যজিৎ বাবুর যা বাজেট ছিল ছবিটা করার জন্য, তিনি চাইলেও তখন তারকাদের পেতেন না। সত্যজিৎ বাবু তখন অখ্যাত পরিচালক, তারকারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়তো আসতেন না। সত্যজিৎ বাবু গ্লামার বাদ দিয়ে যা চাইতেন তা তারা দিতে পারতেন কি না বা দিতে চাইতেন কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। ফলে সেটা শাপে বর হয়েছে সত্যজিৎ বাবুর জন্য, তিনি তারকাদের সঙ্গে নেননি। কিন্তু তিনি ছিলেন ঝুঁকির মধ্যে। তিনি যদি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা না পেতেন, কী জানি সত্যজিৎ রায় সত্যজিৎ রায় হতে পারতেন কি না। যখন সত্যজিৎ বাবু শ্রেষ্ঠ পরিচালকের স্বীকৃতি পেলেন, পরবর্তী জীবনে আবার তার হাত দিয়েই তারকা সৃষ্টি হয়েছে। সত্যি বলতে তারকা প্রথা ভাঙার লড়াইটা আমরা করিনি। করা সম্ভব ছিল কিনা, জানি না। রাহমান সাহেব, তারকা ছাড়া আমি অনেক কাজ করেছি। তারকা ছাড়া বড় বড় কাজ করা যায়। কিন্তু তারকা নয় বলে যাকে আপনি সঙ্গে নিলেন, তিনিই যখন প্রতিষ্ঠা পাবেন, নাম করবেন, কয়দিন পর তিনিও তারকা হয়ে যাবেন। এটা চলচ্চিত্র জগতের একটা চক্র। শ্রীলেখাকে নিয়ে আমি কাজ করেছি। শ্রীলেখা এর আগে ছবিতে কাজ করেনি। কিন্তু যখন আমার ছবিতে কাজ করলো, আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছে। নিজের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছে। পরশুরামের কুঠার ছবিতে অভিনয় করার জন্য সারা ভারতে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার পেয়েছে। শ্রীলেখা তো আপনার বন্ধু, সে কিন্তু তারকা হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। শ্রীলেখার কাছ থেকে জেনে নেবেন, কেন সেটা ঘটেনি। সরকারি অনুদানে আমি ‘সংস্কার’ নামে নতুন যে ছবিটি করবো, তাতে কিন্তু আমি তারকাদের নিতে চাইছি না। রাহমান সাহেব, আপনার কথাগুলি আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। সব কথাগুলির সঙ্গে আমি একমত কি দ্বিমত সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু আপনি যে সমালোচনা করার ক্ষমতা রাখেন, সত্য উচ্চারণ করতে চান বা ভিন্ন চিন্তা করেন, সেটাই আমাদের জগতে জরুরি। যারা যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করেন তাদের সকলকে আমি সম্মান করি। প্রচুর সমালোচনা করেছেন আপনি আমার বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু তাতে আপনার সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব নষ্ট করিনি। আমি চাই, আপনি কথা বলবেন, সত্যিটা সব সময় বলবেন।  

নব্যেন্দুদার সঙ্গে সেই দিনের দীর্ঘ আলোচনার সব কথা আজ মনে নেই। সবকিছু যেভাবে বললাম, হুবহু সেভাবে ঘটেনি। মনে আছে রাত পৌনে একটায় সেদিন নব্যেন্দুদার কক্ষ ছেড়ে আমার ঘরে ঘুমাতে এসেছিলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ ঘুমাতে পারিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের বিরাট এক অংশ সৌমিত্র বাবুর সঙ্গে সামান্য সময় কাটাতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করেন। কিন্তু আমি কিনা তার সঙ্গে অভিনয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছি। যিনি কি না বাংলা সিনেমার অভিনয় জগতের এক দিকপাল। রাত্রে সৌমিত্র বাবু নিজ কক্ষে চলে যাবার সময় যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে বিদায় নিয়েছিলেন। তবু মনে হয়েছিল, সত্যি আমি কি সৌমিত্র বাবুকে আহত করেছি? কাল থেকে আমাদের সম্পর্কটা কি তিক্ত থাকবে? যদিও জানি নব্যেন্দুদা একটা আপোসরফা করার চেষ্টা করবেন। নিজেকেই বকা দিলাম, চলতি পথে কী দরকার ছিল মাত্র পরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে তার অভিনয় নিয়ে বিতর্ক উপস্থাপন করা। তারপর এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পরদিন সকালে যখন আমরা বের হবো, তখন বিজরী, তুহিন, শিলা আর অন্যদের সঙ্গে দেখা। সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো। সকলে তারা এই রিসোর্টেই থাকছে। বিজরী আর তুহিন জানতে চাইলো আমার এখানে থাকার কষ্ট হচ্ছে কিনা। বিজরী আর তুহিন বড়ুয়া খুবই আন্তরিক ছিল আমার সঙ্গে। সারাদিন সুটিংয়ের জায়গায় দেখা হচ্ছে। নানা রকম কথা হচ্ছে। কিন্তু রিসোর্টে ফিরবার পর নব্যেন্দুদা আমাদের তিনজন ছাড়া আর কাউকে কখনো তার কক্ষে ডাকছেন না। নব্যেন্দুদার গাড়িতে সুনির্দিষ্টভাবে সঙ্গী হিসেবে আমরা তিনজনই যাতায়াত করছি। বিজরী, তুহিন আর অন্যদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা গাড়ি। পরদিন সকালে সুর্টিং স্পটে ঠিক রওয়ানা হবার আগেই সৌমিত্র বাবু এসে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলাম খুব সময় মেনে চলেন। তিনি সুশৃঙ্খল মানুষ, গতকাল রাতেই টের পেয়েছিলাম। নিজেই এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলাম। তিনিও খুব বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠে আমার কাছে জানতে চাইলেন, কাল রাতে কতক্ষণ চলেছিল আপনাদের আড্ডা?
বললাম, আপনি আসর ভেঙে চলে যাবার পর আর আড্ডা জমেনি। যদিও আমরা আরো চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট ছিলাম।
তিনি হেসে জানতে চাইলেন, কী করলেন অত রাত অব্দি?
বললাম, নব্যেন্দুদাকে সময় দেয়া হলো আর সঙ্গে হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক শিকার করলাম।
তিনিও আমার সাবলীল রসিকতায় খুশি হলেন। যাক, আমরা আবার বন্ধু হয়ে উঠলাম। চলবে