রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকদিন’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১

রিসোর্ট থেকে সুটিংয়ে যাবার জন্য সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। গতদিনের মতোই আমরা নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম। সকাল বেলা প্রধান সড়ক ধরে গাড়ি চলছে। দুদিকে গ্রাম আর ফসলের ক্ষেত। বাইরের দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর। মার্চের প্রথম সপ্তাহের শেষ কিংবা দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু। হঠাৎ সৌমিত্র বাবু কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। খুবই উপভোগ করছিলাম তাঁর আবৃত্তি। পরপর দুটা আবৃত্তি করে থেমে পড়লেন। বললাম তাঁকে, ‘থামলেন কেন, ভালোই তো লাগছিল।’ তিনি তারপর একটা ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করলেন। নিজেই বললেন, ‘আজ আর নয়। আগামীকাল সকালের যাত্রায় আবার শোনাবো। বুঝলেন, এরকম পরিবেশে আমার কণ্ঠে নিজে থেকেই কবিতা চলে আসে।’ গতকাল রাতের বিভিন্ন আলোচনার পর সৌমিত্র বাবুর এরকম আন্তরিকতায় আমি স্বস্তি বোধ করছিলাম। বিভিন্ন রকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন তিনি আমাকে। যখন আমরা খন্নানের জমিদার বাড়িতে গাড়ি থেকে নামতে যাবো তিনি বললেন, ‘গতকাল রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আপনার লেখা নাটকের দুটা দৃশ্য পড়ে ফেলেছি। বাকিটা এর মধ্যেই পড়বো। এ নিয়ে পরে কথা বলবো।’

সুটিংয়ে সেভাবে আর কথাবার্তা হলো না। মাঝে মধ্যে বসে একসঙ্গে চা কফি খেলাম। সন্ধ্যার পর সুটিং শেষে আবার ফিরলাম রিসোর্টে, গতদিনের মতো তারপর আড্ডা বসলো নব্যেন্দুদার কক্ষে। কিন্তু আড্ডার শুরুতেই সৌমিত্র বাবু আমাকে বললেন, ‘আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আমি একটা বিশেষ ব্যাপারে জানতে চাই। আপনাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার জানার খুব আগ্রহ। কিছু কিছু খণ্ডিতভাবে জানি। বিস্তারিত জানতে চাই। আপনি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এ ব্যাপারে অনেক ভালো বলতে পারবেন।’ তারপর নব্যেন্দুদাকে বললেন, ‘নব্যেন্দু, তোমার কি আপত্তি আছে শুনতে ওনাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে?’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘মোটেই না।’ দ্বিতীয় দিনের আড্ডায় আসলে আমি ছিলাম একমাত্র বক্তা। মুক্তিযুদ্ধ, তার আগের ঘটনা, পরবর্তী ঘটনা নানা বিষয়ে আমি বলে গেলাম। দুজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বিহারের তরুণ চিত্রগ্রাহক মনে হয় ততটা মনোযোগ দিতে পারেনি আগ্রহ না থাকার কারণে। যতক্ষণ আমি বলছিলাম, দুজনেই দীর্ঘ সময় ধরে শুনে গেলেন। সৌমিত্র বাবু যেন কথাগুলি খুবই আগ্রহের সঙ্গে শুনছিলেন। বিভিন্ন দিক থেকে আমি মুক্তিযুদ্ধ আর তার নানা প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম পঁচাত্তর সালের নির্মম হত্যাকাণ্ড সহ। তিনি খুব একটা কথা না বলে দীর্ঘ দেড়ঘন্টা ধরে আমার বক্তব্য শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। যখন আমি কথা শেষ করলাম তিনি বললেন, বহুদিন ধরে আমার বিশেষ একটা আগ্রহ ছিল আপনাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার। সে ইচ্ছাটা আপনি পূরণ করলেন। এর আগে অবশ্য এমনভাবে সুযোগও আসেনি।’

নব্যেন্দুদা বললেন, ‘রাহমান সাহেব অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। চমৎকার একটা চিত্র দিলেন আপনি আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে। আমি এর আগে আপনার লেখা নাটক পড়েছি আপনাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সৌমিত্র, সত্যি তুমি একটা খুব ভালো কাজ করেছো রাহমান সাহেবকে এ ব্যাপারে বলতে বলে। রাহমান সাহেবের কথাগুলি শুনতে শুনতে আমি কী ভেবেছি জানো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি পরের ছবিটা বানাতে পারি কি না।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘দারুণ হবে তাহলে। ওনার ক্রীড়নক নাটকটা ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা। সবটা পড়া হয়নি। কিন্তু রূপক হিসেবে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে। তিনি যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোমাকে মূল বিষয়বস্তু রচনায় সাহায্য করেন খুবই ভালো হবে।’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘বিষয়বস্তু যদি দুই বাংলাকে যুক্ত করে লেখা যায় আরো ভালো হয়। মুক্তিযুদ্ধে দুই বাংলার যে বন্ধন, এমন কি ত্রিপুরার সঙ্গে যে সম্পর্ক সেটা থাকলে সকলেই তাতে আগ্রহী হবে। দুই বাংলা মিলে বড় একটা কাজ করা যাবে। সৌমিত্র, তুমি কি মনের করছো।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘খুব সুন্দর পরিকল্পনা। কাজটা করার জন্য তুমি একটু একটু করে প্রস্তুতি নাও।’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘সংস্কার ছবির কাজ শেষ হলে পর তাহলে আমি রাহমান সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে একটা ছবি বানাবো, এটাই ফাইনাল। সংস্কারের পরের গল্প আমি পেয়ে গেছি।’

বিহারের চিত্রগ্রাহক ছেলেটা কখনো খুব একটা কথা বলে না, যদিও পুরো সময় আড্ডায় বসে থাকে। সে বলে বসলো, ‘স্যার আপনাদের এ কাজটার সঙ্গে দয়া করে আমাকেও রাখবেন।’ সৌমিত্র বাবু নব্যেন্দুদাকে বললেন, ‘নব্যেন্দু, যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে আমাদের এখানে তেমন কোনো ছবি হয়নি। বাইরে দেখো, যুদ্ধ নিয়ে কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কতো বড় বড় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যুদ্ধ নিয়ে কতো ক্লাসিক ফিল্ম হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম, ভারত সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমি তো মনে করি খুব বড় মাপের কাজ হতে পারে, সত্যি যদি তুমি ছবিটা করতে চাও।’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘দেখলে সৌমিত্র আড্ডায় বসলে কতো চিন্তা বের হয়। একটু আগেও আমরা কেউ এমনটা ভাবিনি। সৌমিত্র কৃতিত্ব কিন্তু তোমার। প্রসঙ্গটা তুমি উত্থাপন করেছো। হঠাৎ কী মনে করে তুমি এ প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলে?’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘কাল রাতে ওনার বইটায় চোখ বুলাতে গিয়ে কথাটা মনে হয়েছিল।’  

বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে সৌমিত্র বাবু আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি কালকেই চলে যাচ্ছেন এখান থেকে? বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘থেকে যান আরো কয়েকটা দিন। খুব ভালো লাগছে আপনার সঙ্গে বসে এভাবে আড্ডা দিতে।’ বললাম, কয়েকটা দিন থাকা সম্ভব না। মুম্বাই, আজন্তা ইলোরা সহ আমি ভারতের কয়েকটা রাজ্য ঘুরতে যাবো। টিকেট করা হয়ে গেছে। বড় জোর কাল রাতটা থাকতে পারি। তিনি বললেন, তবে তাই থাকেন। বললাম, ‘থাকবো। কিন্তু শেষের কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাতে হবে।’ তিনি জানতে চাইলেন, ‘সত্যিই কি আপনি আমার আবৃত্তি পছন্দ করেন?’ মিষ্টি হেসে বললাম, ‘খণ্ডিত আপনাকে নয়, অখণ্ড আপনাকেই পছন্দ করি। মঞ্চে আমি কিন্তু আপনার অভিনয় দেখেছি।’ সৌমিত্র বাবু হেসে বললেন, ‘নিশ্চয় বলবেন সে অভিনয় পছন্দ করেননি।’ বললাম, ‘না তা বলবো না। তবে একটা প্রশ্ন আছে, আপনার সঙ্গে সুন্দর হৃদ্য সম্পর্ক তৈরি করার শর্ত কি আগে এটা স্বীকার করে নেওয়া যে, আপনি একজন বড় মাপের অভিনেতা?’ তিনি বললেন, ‘মোটেই তা নয়। কিন্তু প্রশংসা শুনতে বেশ লাগে। নব্যেন্দু কী বলো?’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘ঠিক। ভালো কাজের স্বীকৃতি চাই, সমালোচনাও চাই। রাহমান সাহেব আপনি কি একমত?’ বললাম, ‘হ্যাঁ। কথাটা তাহলে আপনাদেরকে বলেই ফেলি, ‘সমাপ্তি’ ছবির সেই সৌমিত্র বাবু আমার স্মৃতির মধ্যে এখনো রয়ে গেছেন। চশমা চোখে সেই হাসি, সব কিছু। আপনি এবং অপর্ণা সেন। মনে রাখবেন, দুজনেই আপনারা খুব ভালোভাবে আমার স্মৃতিতে আছেন সমাপ্তি ছবিটি দেখার পর থেকে।’

হঠাৎ বিহারের চিত্রগ্রাহক তরুণ আমার দিকে ইঙ্গিত করে সৌমিত্র বাবুকে বলে বসলো, ‘স্যার, কাল রাতে উনি পরে যা যা বলেছেন, আমার মনে হয় আপনার পক্ষেই বলেছেন। বুঝলাম, স্যার অভিনয় নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করেন।’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘হ্যাঁ অনেকটা তাই সৌমিত্র। তিনি আসলে আমাদের পরিচালকদের বহু ভাবনাকে আক্রমণ করেছেন। তিনি মনে করেন, অভিনেতাদের ঠিক মতো অনেকেই কাজে লাগাতে পারেননি। ফলে বহু প্রতিভা বিকশিত হতে পারেনি।’ বিশেষ কৌতুহল নিয়ে সৌমিত্র বাবু সরাসরি এবার আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘নিজে কি আপনি কখনো মঞ্চে বা কোথাও অভিনয় করেছেন?’ বললাম, ‘মঞ্চে করেছি দু-একবার। সখের বশে, সেগুলি কিছুই হয়নি। বুঝলেন বলা সহজ, করা কঠিন।’ কথাটা শুনে সৌমিত্র বাবু তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে হাসলেন। বললেন, ‘আপনার লেখা নাটকটা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে আপনি কমবেশি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত।’ বললাম, ‘যদি আমার শরীরিক উচ্চতা আর একটু বেশি হতো, তাহলে পারি আর না পারি হয়তো অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে ফেলতাম।’ ঠিক আগের ভঙ্গিতে হেসে তিনি বললেন, ‘বাহ! চমৎকার বললেন।’

পরিবেশটা তখন সবটাই আন্তরিকতায় পূর্ণ, সৌমিত্র বাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কাল সকালে তাহলে শেষের কবিতা? ঠিক আছে?’ তিনি বললেন, ‘কাল নয় পরশু সকালে, বিদায়ের দিনেই শেষের কবিতা শোনাবো। সেই সঙ্গে আপনাকে আমি আর একটা কথা বলবো।’ বললাম, ‘জ্বী বলুন।’ তিনি তাঁর অভিনীত একটা ছবির নাম বললেন। নামটা এখন মনে করতে পারছি না। বললেন সেখানে আমি একজন অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। সে ছবিটা বিশেষভাবে আপনাকে দেখতে বলবো।’ বললাম, ‘অবশ্যই দেখবো। যদি ছবিটা হাতের কাছে পেয়ে যাই।’ তিনি অতপর ঘড়ির কাটা দেখে ঠিক বারোটার কিছু আগে বিদায় নিলেন।  

পরদিন সকালে সুটিংয়ের স্পটে যাত্রার সময়ে আবার তার কণ্ঠে নানান কবিতা শুনলাম। আমাদের দুজনের সম্পর্ক তখন অনেক আন্তরিক আর হৃদ্যতাপূর্ণ হয়ে গেছে। নব্যেন্দুদা তাতে খুব খুশি। তিনি একবার আমাকে একা পেয়ে বললেন, ‘কী যাদু করলেন যে সৌমিত্রই এখন আপনাকে এখানে আটকে রাখতে চাইছে। কিন্তু আপনি আমার কথায় রাজি না হলেও দেখলাম ঠিকই সৌমিত্রের কথায় অন্তত আর একদিন এখানে থাকতে রাজি হলেন। ব্যাপারটা আমার খুবই ভালো লেগেছে, আপনাদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক হওয়াতে। গতকাল আপনার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলা আর বিশ্লেষণ খুবই ভিন্নরকম ছিল। সংস্কার ছবি শেষ করার পরেই আপনার গল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর ছবিটা করতে চাই।  সরকারের অনুদান প্রাপ্ত ‘সংস্কার’ ছবির কাজে যখন হাত দেবো, আপনি অবশ্যই তখন আমার সঙ্গে থাকবেন।’

নব্যেন্দুদা আরো জানালেন, ‘বিজরীকে বলেছিলাম ‘সংস্কার’ ছবির মূল ভূমিকায় অভিনয় করতে, সে রাজি হলো না। দেখেন ওকে রাজি করাতে পারেন কিনা। মেয়েটা বুঝতেই পারছে না, এরকম চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য কতো মানুষ হত্যে দিয়ে থাকে। নিশ্চিত করে আপনাকে বলতে পারি, আমার সংস্কার ছবি ‘পরশুরামের কুঠার’ ছবির মতো পুরস্কার পাবে। বিজরী অভিনয় করলে শ্রীলেখার মতো সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারটা পেয়ে যেতে পারে। শ্রীলেখার মতো জেদ ওর মধ্যে আছে কি না জানি না। ’ কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘বলেন তো বিজরীকে আমি কেন চাইছি। কারণ আমি চাই, বাংলাদেশের একটি মেয়ে পুরস্কারটা পাক। কাল আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে সে ইচ্ছাটা আরো বেড়ে গেছে।’ সুটিংয়ের ফাঁকে নব্যেন্দুদার কথা মতো বিজরীকে বললাম, ‘কী ব্যাপার তুমি নব্যেন্দুদার ছবিতে অভিনয় করার অফার নাকি ফিরিয়ে দিচ্ছ।’ বিজরী বললো, ‘তাঁর ছবিতে অভিনয় করতে পারাটা সৌভাগ্য। বিশেষ করে দেশের বাইরের অনুদান প্রাপ্ত একটা ছবিতে। কিন্তু যে চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে বলা হয়েছে, সেটা করলে বাংলাদেশে আর থাকতো পারবো না। ভারতে সেটা সম্ভব হলেও বাংলাদেশে সম্ভব নয়। চরিত্রটি সম্পর্কে কি আপনি জানেন?’ বললাম, ‘না’। বিজরী বললো, ‘নব্যেন্দুদার কাছ থেকে জেনে নেবেন।’

পরে নব্যেন্দুদা বলেছিলেন, ছবির একটা দৃশ্যে মেয়েটির বুকে সামান্য কাপড় থাকবে না। বুঝলাম, বিজরীর রাজি না হবার কারণটা কী। নব্যেন্দুদাকে বললাম, ‘বিজরীর সিদ্ধান্ত সঠিক আছে।’ নব্যেন্দুদা মৃত্যুর আগে সংস্কার ছবির কাজ শেষ করেছিলেন। সম্ভবত তিনি ছবিটা শেষ করতে যে টাকা প্রথম চেয়েছিলেন তার দ্বিগুণের বেশি টাকা খরচ করেছেন সরকারি তহবিল থেকে। শুনেছি ছবিটা নাকি অসাধারণ হয়েছে। নব্যেন্দুদা ছবিটা বানাবার সময় বারবার আমাকে কলকাতায় এসে তার সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে সেটা তখন সম্ভব ছিল না। নব্যেন্দুদা মারা যাবার অল্প দিন আগে বলেছিলেন, সংস্কার ছবির কাজ শেষ করে ঢাকায় আমার কাছে এসে থাকবেন কিছুদিন।

মারা যাবার এক দেড় মাস আগেও তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গল্প করেছি। শরীরটা তখন তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তিনি বারবার বললেন, সংস্কার ছবির কাজ শেষ করে মাসখানেকের জন্য অবশ্যই ঢাকায় চলে আসবেন। ঢাকায় তিনি শুধু মানুষ জনের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাবেন। বললেন, মাঝে মধ্যে রাইসুল ইসলাম আসাদ ভাইকে ডেকে নেবেন সেই আড্ডায়। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি। ছবিটা সম্পূর্ণ করার পরপরই তিনি মারা গেলেন। নব্যেন্দুদা মারা যান শরীরের প্রতি অতিরিক্ত অত্যাচার করে। তিনি নিয়ম কানুন মানতেন না। খুব খামখেয়ালী স্বভাবের ছিলেন। কিন্তু কেন যেন আমার সঙ্গে সেটা করতেন না। তিনি আমার সঙ্গে ছিলেন খুবই সহজ সরল আর আন্তরিক। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কম করে পনেরো বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ছিল পারস্পরিক সম্মানের। তিনি আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন যে ধরনের আপ্যায়ন করেছেন কখনো ভুলবো না। মানুষটাকে সম্ভবত আমি বুঝতাম। তিনি যতোই জেদি হোন কখনো আমার কথার অবাধ্য হননি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে এ কথাগুলি বলতে হলো তখনকার পরিবেশটা বোঝাবার জন্য। কারণ আমরা যে ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর কারণেই। নব্যেন্দুদার মৃত্যুর পর সংস্কার ছবিটা আর মুক্তি পায়নি। কেন জানি না। চলবে