রাহমান চৌধুরীর গদ্য ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকদিন’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২১

খন্নানের জমিদার বাড়ির তৃতীয় দিনের সুটিং চলাকালে চা খেতে খেতে সৌমিত্র বাবু এক সময়ে বললেন, ‘খুব শীঘ্র আমার ঢাকায় যাবার সম্ভাবনা আছে। ঢাকায় গেলে যোগাযোগ হবে তো আপনার সঙ্গে?’ বললাম, ‘অবশ্যই।’ সঙ্গে সঙ্গে আমার ঢাকার ফোন নম্বর দিলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘ভারত ভ্রমণ শেষ করে আপনি কলকাতায় ফিরবেন কবে?’ তারিখটা তাঁকে বললাম। মার্চের ত্রিশ না একত্রিশ তারিখ বলেছিলাম, সেটা ঠিক মনে নেই। তিনি বললেন, ‘কলকাতায় ফিরে আসার পরদিন আমাকে ফোন করে বাসায় চলে আসেন। আপনার নাটকের চারটা দৃশ্য পড়া হয়েছে। যখন সম্পূর্ণটা পাঠ শেষ হবে, আপনার সঙ্গে কথা বলবো। গলফগ্রিনে আমার বাসা। কলকাতায় আপনি সল্টলেক এ থাকছেন তো, সল্টলেক থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবেন।’ সুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমরা ভারতের ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললাম। তিনি তাঁর সন্তানদের সম্পর্কে কিছু কিছু বললেন। রাজনৈতিক নাটক নিয়ে আমার অভিসন্দর্ভ সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইলেন। কলকাতার নাটক আর নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে আমার মতামত বললাম। তিনি বাংলাদেশের নাটক সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন করলেন। কিন্তু খুব বেশি সময় কথা বলা যাচ্ছিল না।

নব্যেন্দুদা বারবার আমাকে ডেকে পাঠাচ্ছিলেন তাঁর সঙ্গে মনিটরের সামনে বসার জন্য। কারণ আমাকে মন্তব্য করতে হবে শটগুলি সম্পর্কে। বিশেষ করে গল্পটার সঙ্গে যখন মুসলমানদের সংস্কৃতি জড়িত।

যখন রিসোর্টে ফিরে এলাম, রাতে আমাদের নিয়মিত আড্ডা বসলো। কথাবার্তা পানাহার চলছে। সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘শুনেছি ভাষা আন্দোলন দিবসে বিরাট অনুষ্ঠান হয় আপনাদের ওখানে?’ বললাম, ‘ঠিক শুনেছেন।’ তিনি বললেন, ‘সত্যি বাংলা ভাষার জন্য আপনারা যা করেছেন, তার তুলনা হয় না।’ বললাম, ‘ভাষা আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, বাংলা ভাষার জন্য আমরা ভদ্রলোকরা বিশেষ কিছু করিনি, বছরে একদিন খুব আবেগ নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আর গলাবাজি করা ছাড়া।’ তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি! ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে কতো কিছু হচ্ছে আপনাদের ওখানে। শুনেছি একমাস ধরে বিরাট বইমেলা হচ্ছে।’ বললাম, ‘আমার কথা শুনে আপনি অবাক হয়েছেন তো, আরো হবেন। আমাদের একমাসের বইমেলায় যে কয়টা স্টল হয়, আপনাদের কলেজ স্ট্রীটে তার চেয়ে বেশি বইয়ের দোকান আছে। ২১ এর বইমেলায় যে কয়টা মান সম্পন্ন বই বের হয়, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বই বের হয় কলেজ স্ট্রীটে। বইমেলা বা ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান দিয়ে আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি দরদ বুঝতে চেষ্টা করলে ভুল করবেন।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ বললাম, ‘ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝতে হবে আমরা জীবন যাপনে, আমাদের সমস্ত কর্মে বাংলা ভাষাকে কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছি তাই দিয়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি নামক একদিনের অনুষ্ঠান দিয়ে নয়।’

নব্যেন্দুদা বললেন, ‘মানে কী? আপনাদের ওখানে কি আমাদের মতোই বাংলা ভাষার চেয়ে অন্য ভাষার দৌরাত্ম্য বেশি?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমরা এখনো ইংরেজি ভাষার দাসত্ব করছি। প্রায় ক্ষেত্রে আমাদের উচ্চশিক্ষার বাহন ইংরেজি।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘ভারতেও উচ্চশিক্ষার বাহন ইংরেজি। আপনি কি ইংরেজি শেখার বিরুদ্ধে?’ বললাম, ‘ইংরেজি শেখা আর ইংরেজি ভাষার দাসত্ব করা দুটা আলাদা জিনিস। যখন আপনি স্বাধীনভাবে ইংরেজি শিখবেন সেটা হলো শেখা। যখন আপনার উপর ভাষাটা চাপিয়ে দেয়া হয়, সেটা হচ্ছে দাসত্ব। ইংরেজরা আমাদের উপর যে দাসত্ব চাপিয়ে দিয়েছে সেখান থেকে আমরা বের হতে চাচ্ছি না। সেটাই হচ্ছে দাসত্ব।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘কিন্তু ইংরেজি না জানলে তো পিছিয়ে পড়বেন।’ বললাম, ‘আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি না। জাপান, চীন যারা অনেক এগিয়ে গেছে তারা ইংরেজি জেনে এগিয়ে যায়নি। আর ভারতবর্ষ ইংরেজিতে লেখাপড়া করে তাদের ছাড়াতে পারেনি। ফ্রান্স বলেন, জার্মানী বলেন, নরওয়ে বলেন আর ডেনমার্ক বলেন, সকলেই মাতৃভাষায় লেখাপড়া করছে। তাদের উন্নতি করার জন্য ইংরেজি ভাষায় লেখাপড়া করতে হয়নি। যখন আমরা বলি ইউরোপীয় রেঁনেসা, তার একটা বিষয় হলো, ল্যাটিন বাদ দিয়ে মাতৃভাষায় ফিরে যাওয়া, মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করা। যখন থেকে ইউরোপ মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেছে, তখন থেকেই তারা উন্নতি করতে শুরু করেছে। মুসলমানরা পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞানে নবজাগরণের পূর্বে ইউরোপের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। পৃথিবীতে সত্যিকারের জ্ঞানবিজ্ঞানে একটা উন্নত দেশ আমাকে দেখাতে পারবেন না, যারা মাতৃভাষায় লেখাপড়া করেনি।

নব্যেন্দুদা বললেন, ‘কিন্তু আমাদের মতো দেশগুলির পক্ষে ইংরেজি না জেনে কি বিজ্ঞান চর্চায় উন্নতি করা সম্ভব? আমাদের তো বইপত্র নেই।’ বললাম, ‘বইপত্র জাপানের ছিল না, বিদেশের সব বিজ্ঞানের বই তারা জাপানী ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছে। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছেন, জাপান যা পেরেছে, মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করলে বাঙালীরাও সেরকম উন্নতি করতে পারতো।’ খুব জোর দিয়েই বললাম, ‘ভিয়েতনাম পর্যন্ত মাতৃভাষায় লেখাপড়া করছে। নিজেদের ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করছে। সেজন্যই তারা দ্রুত অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছাড়াও বাংলার সেরা বিজ্ঞানী জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু সকলেই বলে গেছেন মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা না করলে আমরা আগাতে পারবো না। বাংলার চার সেরা বিজ্ঞানীদের ভাষ্য এটা। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা দেবার জন্য। তিনি বহু চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের অনুমোদন লাভ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঠ করলে দেখবেন, তিনি কীভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। মধুসূদন, বঙ্কিম সকলেই ছিলেন মাতৃভাষার পক্ষে। বঙ্কিমচন্দ্র তো দাসত্ব করার জন্য বাবুদের ইংরেজি শেখার আগ্রহকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। গান্ধীও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে কথা বলে গেছেন। ইংরেজদের দিয়ে যাওয়া শিক্ষাকে তিনি বলতেন, বুদ্ধির লাম্পট্য।’

নব্যেন্দুদা বললেন, ‘বাংলাদেশে নানারকম লেখালেখি হচ্ছে বাংলায়। বাংলা ভাষার কদর তো সেখানে আছেই।’ বললাম, ‘বাংলা ভাষায় এখানে পশ্চিমবঙ্গে আরো বেশি লেখালেখি হচ্ছে। সেটা দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি ভদ্রলোকদের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করা চলে না।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘তাহলে কি আমাদের চেয়ে আপনাদের ওখানে বাংলা ভাষার ব্যবহার কম?’ বললাম, ‘তাও না। আসলে আমাদের লড়াইটা ছিল উর্দুর বিরুদ্ধে। ইংরেজির বিরুদ্ধে নয়। ভদ্রলোকরা উর্দুর বিরুদ্ধে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু জিন্নাহ যদি বলতেন, ‘ইংরেজি হবে রাষ্ট্রভাষা’ কজন ভদ্রলোক আন্দোলন করতেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘তাই! এটা তো একটা চমৎকার নতুন কথা শোনালেন।’ বললাম, ‘২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আমাদের ভদ্রলোকদের মধ্যে আবেগ আছে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি সত্যিকারের সম্মান নেই।’ সৌমিত্র বাবু জানতে চাইলেন, ‘বারবার আপনি ভদ্রলোক কথাটা ব্যবহার করছেন কেন? সাধারণ মানুষ কি আন্দোলন করেনি?’ বললাম, ‘নিশ্চয় করেছে। কিন্তু দেখবেন সেটা ভদ্রলোকদের উৎসাহের কারণেই করেছে। রাষ্ট্রভাষা আপনি বাংলা করলেন, না উর্দু করলেন, না কি ইংরেজি করলেন তাতে সাধারণ জনগণের কী যায় আসে? তারা সবসময় নিজের মাতৃভাষাতেই কথা বলবে। ইংরেজরা যখন শিক্ষার বাহন ইংরেজি করেছে, সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই সময়ও নিজের মাতৃভাষায় কথা বলেছে। স্বাধীন ভারত যখন অফিসিয়াল ভাষা ইংরেজি আর হিন্দি করেছে, সাধারণ মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলেছে, মাতৃভাষায় গান গেয়েছে। উপরে বসে শাসকরা কোন্ ভাষা প্রতিষ্ঠা করলো সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষ মাথা না ঘামিয়ে নিজের মাতৃভাষায় তারা সবরকম যোগাযোগ রক্ষা করেছে। আর আমাদের দেশের ভদ্রলোকরা? ভাষা আন্দোলনে মানুষ প্রাণ দেয়ার পরেও, সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে চালু করতে দেয়নি। ঘরে বাইরে তারা ইংরেজি বলতে পছন্দ করছে।’

নব্যেন্দুদা বললেন, ‘আপনার কথার মধ্যে যুক্তি আছে। এখন মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার পর আসলে আপনার দেশে বাংলা ভাষা চালু করা যেতো। কারণ আমাদের মতো আপনাদের দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী রাজ্য নেই। সকলেই আপনারা বা আপনার দেশের ব্যাপক মানুষ একই ভাষায় কথা বলেন।’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘শুনেছি আপনাদের ওখানে আবার অনেকে আরবি ভাষা বলতে পছন্দ করে?’ বললাম, ‘ঠিক শুনেছেন। একদল কারণে অকারণে আরবী বলতে পছন্দ করে। তারা কিন্তু ভদ্রলোক নয়। আর ভদ্রলোকরা কারণে অকারণে ইংরেজি বলতে পছন্দ করে। বাংলা ভাষাকে হীন করে দেখার ব্যাপারে দু পক্ষের চরিত্র একই রকম। দু পক্ষই দুই রকম ‘বিদেশী ভাষা’ ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে এক ধরনের জোশ অনুভব করে। তবে যারা আরবী বলে, তারা ভদ্রলোকদের মতো গড়গড় করে আরবী বলে না। দুচার লাইন আরবী বললেও, বাংলাই বলে বেশি। ভদ্রলোকরা কিন্তু অনেক অনুষ্ঠানে শুধু ইংরেজিই বলে। যদিও সেসব অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র বাঙালীরাই উপস্থিত থাকে। বাংলাকে সেসব অনুষ্ঠান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। কারণ সেটাই তাদের আভিজাত্য। ইংরেজি ভাষার সেখানে ভয়াবহ প্রভুত্ব।’

নব্যেন্দুদা জানতে চাইলেন, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনকে তাহলে সেখানে কোন চোখে দেখা হয়।’ বললাম, ‘যদি সত্যি বলতে হয়, এটা প্রধানত একটা আবেগ। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি তাদের মধ্যে খুব কম মানুষ আছে, যারা বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারাই আবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঘটা করে অনুষ্ঠান করে। রাষ্ট্রের প্রচুর টাকা খরচ হয় এর পেছনে।’ সৌমিত্র বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিলেন। তিনি এবার বললেন, ‘কাল আপনার কাছে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে নানা রকম ব্যাাখ্যা, আবেগ আর বীরত্বের কথা শুনেছিলাম। আজ বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ শুনলাম। সব ঘটনাকে দেখছি আপনি ভিন্ন দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা করতে পারেন।’ বললাম, ‘দয়া করে আমার বক্তব্যকে একপেশে করে দেখবেন না। পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে কিন্তু এই বাংলা ভাষা নিয়ে আমার অনেক কথা বলবার আছে।’ নব্যেন্দুদা বললেন, ‘কী রকম?’ বললাম, ‘যা ঐতিহাসিক সত্য। সেটা কি জানতে চান?’ সৌমিত্র বাবু বললেন, ‘বলেন।’ বললাম, ‘বহুকাল এমন গেছে, যখন বাঙালী মুসলমানকে বাঙালী মনে করা হতো না। কিন্তু তারাও বাংলায় কথা বলতেন। হিন্দু বাঙালীকে বলা হতো “বাঙালী” আর মুসলমান বাঙালীকে বলা হতো “মুসলমান”। বহু নামীদামী সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা না ভেবেচিন্তে এসব বলেছেন বা লিখে রেখে গেছেন। চল্লিশ সালেও শিক্ষা নিয়ে সংসদের বিতর্কে শেরে বাংলা ফজলুল হককে বলা হয়েছিল, মুসলমানদের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব থাকলে বাংলা ভাষা ধ্বংস হয়ে যাবে। কারা কারা এরকম বক্তব্যে স্বাক্ষর করেছেন তা বলতে চাই না। কারণ মহান এক বাঙালীও তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ সবকিছুর পর প্রমাণ করেছে তারা বাঙালী। বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা ভুলে যান। পূর্ব বাংলার মানুষ যে বাঙালী তা নিয়ে কি আর সংশয় আছে আপনাদের?’ সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। নব্যেন্দুদা বললেন, ‘সত্যি কি তাই? বাঙালী মুসলমানদের হাতে বাংলা ভাষা ধ্বংস হবে এমন কথা বলা হয়েছিল? আমরা জানি না তো। কবে ঘটেছিল?’ বললাম, ‘সে আলোচনায় আর যেতে চাই না। দলিলপত্র আছে। কখনো চাইলে দেবো আপনাদের। বক্তব্যের উপসংহারটা হচ্ছে এই, কলকাতার বাবুদের মতে যাদের হাতে বাংলা ভাষা ধ্বংস হবার কথা, ভাষার জন্য যেভাবেই হোক তারাই প্রাণ দিয়েছিল।’

নব্যেন্দুদা বললেন, ‘মশায় আপনি আশ্চর্য্য লোক! কথা কীভাবে ঘুরিয়ে ফেলছেন। আমাদের কোন্ রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ নব্যেন্দুদার কথায় আমি হাসলাম। সৌমিত্র বাবু প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি সত্যিই কাল চলে যাচ্ছেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’ তিনি বললেন, ‘সম্ভব হলে থেকে যান আরো দু-একটা দিন। বেশ তো আড্ডা জমেছে।’ বললাম, সম্ভব হলে থাকতাম। কাল রাতে কলকাতা থেকে সবকিছু গুছগাছ করে পরদিন রাতের মুম্বাই ট্রেনে জলগাঁও যাওয়া। সেখান থেকে অজন্তা আর ইলোরা। তারপর হায়দারাবাদ। তিনি বললেন, হায়দারাবাদ গেলে অবশ্যই রামুজি ফিল্ম সিটিটা দেখে আসবেন। বললাম, ঠিক আছে দেখে আসবো। তিনি বললেন, ‘যেদিন আমার বাসায় আসবেন আপনাকে আমার সেই ছবিটা দেখাবো যেখানে আমি অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করেছি।’ বললাম, ‘তাহলে আমি খুব খুশি হবো আর কৃতজ্ঞ থাকবো।’ কলকাতায় আমার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, মৃণাল বাবুর সঙ্গে জীবনের প্রথম আড্ডা, প্রকাশ ঝাঁর দামুল ছবির প্রিমিয়ার শো দেখা; ইত্যাদি নানা বিষয়ে আমরা গল্প করলাম। তিনি উত্তম কুমারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট আড্ডা সম্পর্কে কিছু কিছু কথা বললেন। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, উত্তম কুমার সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা আর গদগদ প্রশংসা শুনে। কারণ তাঁরা দুজনেই বাংলার খুব জনপ্রিয় বা আলোচিত অভিনেতা। পরস্পরের প্রতি এসেব ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ইর্ষা থাকে। কিন্তু সৌমিত্র বাবুর মধ্যে সামান্যতম তা লক্ষ্য করলাম না। বরং দেখলাম উত্তম কুমার সম্পর্কে তাঁর মধ্যে রয়েছে সমীহ ভাব।

তিনি জানালেন, চলচ্চিত্রে তিনি বহু অভিনয় করেছেন। কিন্তু মঞ্চে অভিনয়ের স্বাদ আলাদা। চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে হয় খণ্ডিতভাবে, পরের দৃশ্য আগে আর আগের দৃশ্য পরে; একটানা অভিনয় করার সুযোগ নেই। মঞ্চে অভিনয় করে তিনি তাই ভিন্ন রকম স্বাদ পান। তিনি জানালেন, অভিনয়ের উপর আমার লেখা বইটি পড়ার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী। ভিন্ন দিকে আমি তাঁকে বললাম, চলচ্চিত্র জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনি একটি বই লিখে ফেলেন। বাংলা সিনেমা নিয়ে সেরকম একটা বই পাঠ করতে আমি ভীষণভাবে উদগ্রীব। বললাম, আপনি অনেক পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন, বিস্তারিতভাবে লিখে ফেলেন একটা বই। নব্যেন্দুদা বললেন, খুব ভালো পরামর্শ দিয়েছেন তোমাকে রাহমান সাহেব। লিখে ফেলো সৌমিত্র, আমি নিজে তোমার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দেবো।

নব্যেন্দুদা আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘মুসলমানীর গল্পের যতটুকু আমার কাজ দেখেছেন কী মনে হয়?’ বললাম, যতটুকু দেখেছি তাতে কিছুই মন্তব্য করা যায় না। নব্যেন্দুদা বললেন, ‘আমার নিজের মন্তব্য শুনবেন এ সম্পর্কে?’ বললাম, বলেন। নব্যেন্দুদা বললেন, কাজটা কিছুই হয়নি। যা করতে চেয়েছি তার কিছুই হয়নি। কাজটা যে আমার ভালো হয়নি, তা কিন্তু আপনি নিজেও জানেন। খুব ভালো করেই জানেন। ভদ্রতা করে আমার মুখের উপর কথাটা বলতে চাননি।’ বললাম, ‘চলচ্চিত্রের লোক হয়ে টেলিফিল্ম করতে আসাটা আপনার ঠিক হয়নি। কারণ যা আপনি করতে চান, তার বাজেট এটা নয়। তার জন্য প্রস্তুতি এটা নয়।’ নব্যেন্দুদা আমাকে সমর্থন করলেন। বললেন, ঠিক বলেছেন। সঠিক কথা বলার জন্যই আমি আপনাকে পছন্দ করি। আসলে এভাবে কাজ করে সৃষ্টিশীল কিছু করতে পারাটা কঠিন। সত্যি বলতে কি, অন্ততঃ আমি পারি না। অন্যরা হয়তো পারেন। কিন্তু সৌমিত্রের কাজ দেখে আমি খুশি। সে তার সেরাটা দিয়েছে। ব্যর্থতা যদি থাকে আমার।’

নানান রকম বিষয় নিয়ে আলাপ হলো সেই রাত্রে। পরদিন খুব সকালে আমার চলে আসবার কথা। কিন্তু ঠিক হলো, সকালে নয় বারোটার পর সামান্য কিছু খেয়ে রওয়ানা দেবো খন্নান থেকে। নব্যেন্দুদা তাঁর ব্যবহার করা গাড়িটা আমাকে দেবেন কলকাতা যাবার জন্য। নিজেই আমি কিছুটা দেরি করতে রাজি হলাম। কারণ বিকালে বাংলাদেশের শিলা বলেছিল, যদি আমি আগামীকাল দুপুরের দিকে কলকাতা যাই, শিলা তাঁর মেয়েকে নিয়ে কলকাতা পর্যন্ত যাবে আমার সঙ্গে। শিলার কিছু কাজ আছে কলকাতায়। যদি আমি দেরি করে যাই, সকালে শিলা নিজের সুটিংয়ের অংশটা শেষ করে তাহলে আমার সঙ্গে একই গাড়িতে একদিনের জন্য কলকাতা যেতে পারবে। দুপুরের পরে যাবার প্রস্তাবে তাই রাজি হলাম।

পরদিন সকালে যখন রওয়ানা দিয়েছি সুটিং স্পটে, প্রতিদিনের মতো কবিতা আবৃত্তি করার কথা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শেষের কবিতা শোনাবেন। কিন্তু তিনি শোনালেন ভিন্ন সব কবিতা। বললাম, শেষের কবিতা? তিনি হেসে বললেন, ‘না, আজ নয় যেদিন আমার বাসায় আসবেন সেদিন শোনাবো।’ সুটিংয়ে পৌঁছে গেলাম। নব্যেন্দুদা এবং আমার মন খারাপ, আমরা চমৎকার আড্ডা বা সময় কাটানো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি বলে। যখন দুপুরে খাবার পর সাড়ে বারোটার দিকে আমি সৌমিত্র বাবুর কাছে বিদায় নিতে গেলাম, তিনি বললেন, ‘সত্যি সত্যি তাহলে আপনি চলে যাচ্ছেন?’ বললাম, ‘উপায় নেই। যেতেই হচ্ছে। কাল সন্ধ্যায় আমার ট্রেন।’ তিনি বললেন, ‘আপনি ফিরে গলফগ্রিনে আমার বাসায় আসছেন তাই তো?’ বললাম, ‘নিশ্চয়।’

সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিলাকে সঙ্গী করে কলকাতায় ফিরে এলাম। শিলার সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় বা খুব আলাপ হয়নি আগে। গাড়িতে বসে যা দু একট কথা হলো। বিকাল চারটায় আমি নেমে গেলাম কলকাতার রবীন্দ্র সদনে। নাট্যকার চন্দন সেন সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে, নৃপেনদাও আসবেন সেখানে। রাতে নৃপেনদা আর আমি একসঙ্গে তাঁর সল্টলেকের বাসায় যাবো। গাড়িটা আমাকে নামিয়ে শিলাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। পুরো রাস্তায় মনটা কমবেশি বিষন্ন ছিল। রবীন্দ্র সদনে চন্দন সেন, নৃপেনদা সহ আরো অনেককে পেয়ে বিষন্নতা কেটে গেল। নৃপেন্দ্র সাহা ‘গ্রুপ থিয়েটার’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বহু বছর, গ্রুপ থিয়েটার ছেড়ে তখন তিনি ‘নাট্য আকাদেমি পত্রিকা’র সম্পাদক। বহু নাট্যকর্মীরা তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাঁদেরই অনেক উপস্থিত সেদিনের আড্ডায়। নানারকম গল্পের পর বেশ রাতে নৃপেনদার সঙ্গে ফিরলাম সল্টলেকে। নৃপেনদা থাকতেন তখন পাতিপুকুরে। তাঁর সল্টলেকের বাসায় তখনো নৃপেনদা ওঠেননি, আমি থাকি বলে তিনি মাঝে মধ্যে এসে আমাকে সময় দেন। বাসার চাবিটা হস্তান্তর করতে এসেই সে রাতে থেকে গেলেন আমার সঙ্গে।

পরদিন সন্ধ্যায় আমি মুম্বাইয়ের উদ্দেশে বের হয়ে যাবার পর তিনি ঘর বন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে যাবেন পাতিপুকুরে। রাত অনেক হয়ে গেছে। রাতের খাওয়ার জন্য সিরাজ থেকে বিরানির প্যাকেট কেনা হয়েছে। নৃপেনদার বিরানি খুব পছন্দের খাবার। কিন্তু রাতের খাবার খাওয়ার আগেই বাসায় ফিরে প্রথমেই ব্যাগ গোছাতে লেগে গেলাম। চলবে