রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ’

পর্ব ৮

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩

তরুণী: সম্ভবত আপনাকে বিপদগ্রস্থ করে ফেলেছি আমরা। ভাস্কর ভয়াবহ মেধাবী। আসলে সে নিজেই একটা কম্পিউটার। মনে হয় আপনার শর্তে রাজি হয়ে সে আসলে কিছুটা সময় ক্ষেপণ করতে চেয়েছিল। এরই মধ্যে সে তার হতের ঘড়ির চিপস দিয়ে প্রশাসনকে তথ্যগুলো পৌঁছে দিয়েছে।
বয়স্ক: ব্যাপারটা কি তুমি আগে থেকেই জানতে?
তরুণী: সঠিক জানতাম না কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আপনাকে সে আমার কাছে পাঠিয়েছে সময় ক্ষেপণ করার জন্যই।
বয়স্ক: হুম।
তরুণী: ভাস্কর আর আমি শুধু আপনাকে খুনীই ভেবেছি এতদিন। তবুও আমরা আগেভাগেই তথ্যগুলো কাউকেই দিতে চাইনি। কারণ আমরা জানতাম প্রশাসন উল্টো আচরণ করতে পারে। ফলে আমরা প্রশাসনের মধ্যে বিশ্বস্ত ও সৎ কাউকে খুঁজছিলাম। ভাস্কর সম্ভবত তার কাছে তথ্যগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে।
বয়স্ক: ভাস্কর কাকে তথ্য পাঠিয়েছে আমরা জেনে গেছি। যাকে তোমরা সৎ কর্মকর্তা বলে জানো, প্রশাসনে সর্বদাই সে আমার বিরুদ্ধ পক্ষ। সর্বদা সে ভয়াবহ সৎ মানুষের ভান করে, কিন্তু বিদেশিদের স্বার্থে কাজ করে।
তরুণী: কী বলছেন!
বয়স্ক: ঠিক বলছি, প্রশাসনে ওদের হাত আমার চেয়ে কম রক্তাক্ত নয়। যাকে তোমরা তথ্য পাঠিয়েছো, তার নির্দেশেই আমার কন্যাকে হত্যা করা হয়। মূলত সে আমার মতোই খুনী এক চক্র-প্রধান কিন্তু প্রশাসনের কর্মকর্তা সেজে বসে আছে। প্রশাসনের ভিতরে বসে থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে নিজের মাফিয়া চক্র পরিচালনা করে।

 

তরুণী: ভুল হয়ে গেছে আমাদের। মহা ভুল। রাজনীতিটা আমার বোঝা দরকার ছিল। রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ যে ভুলটা করে, আমরা তাই করেছি। সাধারণ মানুষ হয় এই দল, না হলে ওই দলকে ভোট দেয়, যারা কেউই তার বন্ধু নয়। ঠিক আমরাও তাই করেছি। শুধু আপনার ক্ষমতাকে ধ্বংস করবার জন্য আপনার প্রতিপক্ষের হাতে তথ্যভাণ্ডারটা তুলে দিয়েছি। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি আপনার সেই প্রতিপক্ষ নিঃসন্দেহে আপনার চেয়ে ভয়ংকর।
বয়স্ক: দুজনেই কি তাহলে এতক্ষণ আমরা দুজনকে নিয়ে খেলছিলাম? পিতাকন্যার সম্পর্কটা মিথ্যা ছিল?
তরুণী : না। (ভিন্ন স্বরে) প্রথম প্রথম আমি খেলছিলাম আপনার সঙ্গে। সময় পার করছিলাম। কিন্তু যখন আপনি আমাকে কন্যা বলে সম্বোধন করেন তারপর কখন যেন একসময় আমি আপনার কন্যা হয়ে গিয়েছিলাম। কম বয়সে পিতাকে হারিয়েছি তাই। তখন আর আপনার সঙ্গে খেলছিলাম না। কিন্তু তার আগেই সম্ভবত ভাস্কর তার তথ্য প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে। সৎ প্রশাসন মনে করে আমরা আসলে আপনার প্রতিপক্ষের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। (স্বর পাল্টে) একটা কথা বলবো?
বয়স্ক: বলো।
তরুণী: নিশ্চয় একটা সময়ে আমরা আপনাকে কঠিন শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার চরিত্রের ভিন্ন দিকগুলো তখন আমরা জানতাম না।
বয়স্ক: ঠিক আছে আমাকে ভাবতে দাও। বিপদে ঠাণ্ডা মাথায় সব চিন্তা করতে হয়।

 

তরুণী: শত্রু পক্ষ তথ্যগুলো পাওয়ার ফলে কী ঘটতে পারে?
বয়স্ক: শত্রু পক্ষ এখন প্রমাণ করতে পারবে তাদের মানুষজনকে আমি হত্যা করেছি। কিন্তু আমি প্রমাণ করতে পারবো না শত্রু পক্ষ আমার কন্যাকে হত্যা করেছে।
তরুণী: সত্যের পক্ষে লড়তে গিয়ে আপনার তথ্যগুলো আরও খারাপ একটি চক্রের হাতে তুলে দিয়েছি। দুজনেই আপনারা রাষ্ট্রের জনগণের শত্রু কিন্তু বিদেশি শত্রুকে জয়ী হবার পথ দেখিয়েছি। বড় শত্রুর কাছে ছোট শত্রুকে পরাজিত করেছি। জনগণের শত্রু হলেও নিজের কন্যাকে আপনি জনগণের পক্ষেই চালিত করেছিলেন, বিদেশিরা তা করবে না। লুটপাট করবে শুধু। রবীন্দ্রনাথকে ওদের সামান্য প্রয়োজন নেই যা আপনার আছে।
বয়স্ক: কথাটা সত্যি। কিন্তু তোমাকে আরও শিখতে হবে। যখন দেশের শত্রুরা বিদেশের দালালি করে, বিদেশিদের চেয়ে আরও নোংরা হয় তাদের চরিত্র।
তরুণী: ভাস্করকে নিশ্চয় আপনার লোকরা এতক্ষণে চরম শাস্তি দিয়েছে। আপনি এবার আমাকে শাস্তি দিন। যা খুশি।
বয়স্ক: শাস্তি দিয়ে কী লাভ হবে আর। যা ঘটার ঘটে গেছে। নতুন করে আবার সব খেলা আরম্ভ করতে হবে আমাকে। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, তথ্যগুলো তোমাদের হাতে চলে যাবার পর আমার প্রতিপক্ষ মানে মূল শত্রুর দুই সহকারীকে বহু টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলেছি।

 

তরুণী: আপনাকে চেনা খুব কষ্ট। আপনার খেলার কৌশলটা খুব ভিন্ন।
বয়স্ক: মন খারাপ করো না, ভাস্করকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারণ ভাস্করের দায়িত্ব দিয়েছিলাম যাকে কাজটা সেই করেছে। কিন্তু তোমার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল আমার নিজের হাতে।
তরুণী: (কতকটা আপন মনে) ভাস্করের চোখ দুটো ছিল বড় উজ্জ্বল। কত স্বপ্ন দেখেছিল সে বিজ্ঞান নিয়ে। (অধীশ্বরকে) সব ভালো মানুষরা কি এভাবে মারা পড়বে ক্ষমতাবানদের হাতে?
বয়স্ক: ভাস্করের জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। যদি ভাস্করের দায়িত্বটা আমি নিতাম তাহলে হয়তো এমনটা ঘটতো না।
তরুণী: ভাস্করকে এ ঘটনায় আমিই জড়িয়েছিলাম।
বয়স্ক: যাই হোক, মুক্তি দিচ্ছি তোমাকে। হয়তো আর আমাদের দেখা হবে না। কিন্তু মনে রেখো সত্যিই তোমাকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম।
তরুণী: বিশ্বাস করি।
বয়স্ক: কিন্তু কন্যার কাছে কিছু দাবি তো থাকতেই পারে পিতার।
তরুণী: বলুন কী দাবি?
বয়স্ক: ঠিক আমার অতীত আমার ছেলেবেলাটা ছিল অনেকটা তোমার মতোই, ভালো কাজের জন্য প্রাণ দিতে চাইতাম। নিজের মেয়েকে তাই সেভাবেই বড় করতে চেয়েছিলাম। পারলাম না। কখনো মা তুমি, জনগণের স্বার্থে বাইরে কিছু করো না। পিতা ভুল পথে গেছে, কন্যা যেন সঠিক পথে থাকে। জনগণের সঙ্গে থাকে।
তরুণী: কথাটা সবসময় মনে রাখবো।
বয়স্ক: কিন্তু...
তরুণী: বলুন।
বয়স্ক: কিছুতেই তাড়াহুরো করবে না। জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে হলে আগে সমাজটাকে, সমাজের বিচিত্র মানুষের চরিত্র আর অনুভুতিগুলোকে বুঝতে হবে। গভীরভাবে সমাজকে অধ্যয়ন করতে হবে। বড় একজন বিজ্ঞানী তুমি, এটাই শেষ কথা নয়। বিজ্ঞানকে ব্যবসায়ীদের মুনাফার খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে। নাহলে বিজ্ঞান মানুষের জন্য ক্রমাগত অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। বিজ্ঞানের ওপর থেকে বাণিজ্যের আধিপত্যকে দূর করতে হবে।
তরুণী: সংগ্রাম করবো তার জন্য।
অধীশ্বর: বহু মানুষকে সঙ্গে পাবে। মনে হবে খুব নীতিবান। খুব আদর্শ নিয়ে চলে। পরে দেখবে সব মেরুদণ্ডহীন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেখবে তারা সবাই পিছিয়ে গিয়ে তোমার শত্রু পক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। মনে রাখবে, খুব কঠিন পথে পা রেখেছো।
তরুণী: তবুও হতাশ হবো না। নিজের সংগ্রামে দৃঢ় থাকবো।

 

বয়স্ক: নিজের ছেলেবেলার স্বপ্নগুলো তোমার কাছে রেখে গেলাম। কিন্তু আমার মতো ক্রোধে রাগে হতাশায় নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ো না।
তরুণী: কথা দিচ্ছি হবো না।
বয়স্ক: মনে রাখবে সংগ্রাম করতে হলে দৃঢ়তা আর জ্ঞানচর্চার বিকল্প নেই।
তরুণী: স্মরণ রাখবো।
বয়স্ক: দূর থেকে যতটা সম্ভব আমি তোমাকে নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করবো। কিন্তু তুমি কখনো আমাকে বন্ধু মনে করবে না। কারণ মুনাফা লাভের স্বার্থে আমি যে কোনো অন্যায় করতে পিছপা হবো না। কিন্তু সর্বদা মনে মনে আমার কন্যার সংগ্রামের বিজয় কামনা করবো। কিন্তু বাস্তবে আমার পথটা হবে ভিন্ন। বর্তমান অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াবার সুযোগ নেই আমার। কিন্তু তোমার জন্য ততটাই সহানুভূতি থাকবে যা আমার নিজের কন্যার জন্য ছিল।

 

তরুণী: (তরুণী হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে) সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষের পরিচয় পেলাম আপনার মধ্যে। মানুষের সত্যিকারের পরিচয়টা কী আমাকে বলবেন?
বয়স্ক: পথ চলতে চলতে নিজেই একদিন জানতে পারবে। (তরুণী কেঁদে চলেছে) কাঁদছো কেন? কন্যা, তোমাকে পেয়ে আমার ভিতরের অনেক কষ্ট দূর হয়ে গেছে। দুজন আমরা কন্যা আর পিতাই থাকবো সারাজীবন। হয়তো আমার শেষ পরিণতি হবে কিং লীয়ারের মতো। কিন্তু তুমি তোমার যুদ্ধ বন্ধ রাখবে না। স্মরণ রাখবে, আমরা দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, দুই প্রতিপক্ষ দেশী হই আর বিদেশি হই-একই লক্ষ্যে ধাবিত। দুজনের কাউকেই তুমি ক্ষমা করো না। মনে রাখবে তোমার লড়াই আমাদের দুজনেরই বিরুদ্ধে। কারণ আমরা মুনাফার দাসত্ব করছি। সবসময় তোমার লড়াই চলবে সকল মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে। (তরুণী কাঁদতেই থাকে।)
তরুণী: বুঝতে পারলাম, সবকিছুই ইতিহাসের অনিবার্য পরিনাম। সব মানুষই ইতিহাসের ক্রীড়নক। ইতিহাসই মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিপদের মধ্যে রেখে গেলাম আপনাকে।
বয়স্ক: কত কঠিন সংগ্রামে মাথা নত করছো না। কিন্তু ভিতরের মনটা তোমার কতো নরম। বলো, তোমাকে আমি কী দিতে পারি। কন্যাকে তো কিছু একটা দেয়া দরকার। বিজ্ঞান চর্চার জন্য যদি টাকার দরকার হয়, অঢেল টাকা আছে আমার। লজ্জা করো না।

 

তরুণী: পিতা, ‘শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্য লোভে, অয়ি
বীরের সদগতি হতে যেন ভ্রষ্ট নাহি হই।
বয়স্ক: মহাভারতের কর্ণ ছিল আমার প্রিয় চরিত্র। কর্ণ মাকে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল। (পরম মমতায় নিজের দুই হাতে তরুণীর মুখটা উঁচু করে ধরে) জানি, আমার এই সাম্রাজ্য ভোগের লিপ্তা তোমার নেই। বিপুলা এ ধরনীতে তুমি বীর কন্যা আমার। সারা বিশ্ব তোমার মতো বীর কন্যা-পুত্রদের দিকে বহু স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিজেকে নিয়ে ভাবি না। কন্যা, শুধু কথা দাও বিজ্ঞানকে বাণিজ্যের শাসন থেকে রক্ষা করবে। সমস্ত মানুষের মুক্তির লড়ােই চালিয়ে যাবে।
তরুণী: কথা দিলাম।
বয়স্ক: মুক্ত তুমি। আমার মানুষরা তোমাকে এখান থেকে সসম্মানে তোমার এলাকায় পৌঁছে দেবে। কারো কাছে তোমার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপের আসল কথা কিছুই ফাঁস করবে না। যা কিছু আমার এই বিশেষ কক্ষে আলোচনা হয় তা আরো কারো জানার সুযোগ থাকে না। সবাই যেন তোমাকে আমার বিরুদ্ধ পক্ষ হিসেবেই জানে। না হলে তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
তরুণী: কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।
বয়স্ক: বিদায় নিচ্ছি এবার। কিছুটা সময় তুমি এখানেই বসে অপেক্ষা করো।
(চট করে অধীশ্বর বিদায় নিয়ে চলে যায়। তরুণী দৃঢ়তার সঙ্গে একা দাঁড়িয়ে থাকে।) চলবে