রাহমান চৌধুরীর নাটক ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৩

(অধীশ্বর আর তরুণী মুখোমুখি বসে রয়েছেন।)
বয়স্ক: খাবার দাবার বিশ্রামের ব্যাপারে সামান্য সমস্যা হয়নি তো?
তরুণী: না। অসংখ্য ধন্যবাদ সেজন্য।
বয়স্ক: বিশেষ কারণে তোমার বন্ধুকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
তরুণী: শুনেছি।
বয়স্ক: সবটা জানো না। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তার সঙ্গেই কথা হচ্ছিল। সে রাজী হয়েছে আমার প্রস্তাবে। গবেষণা করবে আমার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
তরুণী: বিশ্বাস করি না।
বয়স্ক: না করারই কথা। কিন্তু আমার প্রস্তাবের মধ্যে সে একটা ইতিবাচক ব্যাপার দেখতে পেয়েছে। ঠিক সে-কারণেই আমার প্রস্তাব মেনে নিতে আপত্তি করেনি।

 

তরুণী: কী সেটা?
বয়স্ক: বহু বছর ধরে তোমরা গবেষণা করছো। কিন্তু অর্থের অভাবে সেটাকে সেভাবে সফল করে তুলতে পারছো না। যদি তোমরা এই গবেষণায় সাফল্য চাও, অনেক টাকার দরকার হবে। ভাস্করকে বলেছি সে টাকাটা আমি দেবো। যতো টাকা লাগে পাবে। স্বাধীনভাবে তোমরা গবেষণা করবে। কিন্তু সফলতা লাভ করলে আমাকে কিঞ্চিত ভাগ দিতে হবে। সেকারণেই তোমার বন্ধু রাজী হয়েছে।
তরুণী: তাহলে তো হয়েই গেল আপনার কাজ। যখন সে রাজী হয়েছে আপনার কথায়, আপনার বিপদ কেটে গেছে।
বয়স্ক: না, বিপদ পুরোটা কাটেনি।
তরুণী: কেন?
বয়স্ক: নিজেই তুমি জানো সমস্যাটা কোথায়। তোমার বন্ধুটি বলেছে, হয়তো এই প্রস্তাবে তুমি রাজী হবে না।
তরুণী: ভাস্কর তো রাজী হয়েছে, আমি রাজী না হলে সমস্যা কি?
বয়স্ক: সকল তথ্য সমানভাবে তোমার হাতেও রয়েছে। যদি ভাস্কর তার তথ্যগুলো আমাকে দিয়ে দেয়, তারপরেও তোমার কাছে সেসব তথ্য থেকে যাবে।

 

তরুণী: ভাস্কর সৃষ্টিশীল ছেলে। বড় কিছু করবার জন্য সবসময় অস্থির। কিন্তু টাকার অভাবে তার মেধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছিল না। সম্ভবত তাই আপনার প্রস্তাবে সে একটা নতুন আশার আলো দেখতে পেয়েছে।
বয়স্ক: কিন্তু তুমি?
তরুণী: ভাস্কর আর আমি দুজনে ভালো বন্ধু, তবুও আমরা আলাদা মানুষ। যাই হোক, আপনার প্রস্তাবে আমি রাজী নই।
বয়স্ক: রাজী না হবার পরিণতি তুমি জানো?
তরুণী: জানি। তাই বলে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে হবে!
বয়স্ক: সমাজে কোথায় অন্যায় নেই? বহুকাল ধরে অন্যায় সমাজে আছে বলেই আমরা অন্যায় করতে বাধ্য হই।
তরুণী: কিন্তু কাউকে না কাউকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে।
বয়স্ক: ঠিক আমার মেয়ের ভাষায় কথা বলছো। ঠিক একই ভঙ্গিতে।
তরুণী: কী বললেন?
বয়স্ক: না কিছু না।
তরুণী: যদি আমি রাজী না হই, ভাস্করকে কি তাহলে মুক্তি দেবেন?
বয়স্ক: নিশ্চয়। মুক্ত হয়ে সে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করবে। আমার সঙ্গে আর বিরোধে জড়াবে না।

 

তরুণী: ভাস্কর বড় বিজ্ঞানী হোক, আমি চাই। কিন্তু ঠিক এভাবে করে সে নিজের ব্যবস্থা করবে তা চাইনি। ভাস্কর ভুলে গেল কেমন করে, আপনার হাতে কতো মানুষ মারা পড়েছে। [দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে] ভাস্কর যা ভালো মনে করেছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভাস্করের সঙ্গে কি আমার একবার দেখা হতে পারে?
বয়স্ক: ভাস্কর নিজেই আর তোমার মুখোমুখি হতে চাইছে না। কারণ নিজের সিদ্ধান্ত নেবার পর সে তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে লজ্জা পাচ্ছে।
তরুণী: ভাস্কর তাহলে সম্পূর্ণ বিবেক হারিয়ে ফেলেনি।
বয়স্ক: যদি তুমি ভাস্করের মতো আমার প্রস্তাবে রাজী হও, খুব ভালো। যদি রাজী না হও, যদি বিবেকের তাড়নায় ভিন্ন পথ অবলম্বন করো-তাহলে তোমার পরিণতি খুব ভয়ংকর হবে-
তরুণী: তারজন্য আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
বয়স্ক: কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারি আমি তা কি জানো?
তরুণী: জানার দরকার নেই।
বয়স্ক: জানার দরকার নেই! দম্ভ প্রকাশ করছো! তোমাকে আমি-

 

তরুণী: কী করবেন?
বয়স্ক: প্রয়োজন হলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো।
তরুণী: পাঁচশো বছর আগে জোয়ান অব আর্ক নামে এক কিশোরীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। নির্ভয়ে সে মাথা উঁচু করে প্রাণ দিয়েছিল।
বয়স্ক; [রাগ সংযত করে] জানি সে কথা।
তরুণী: ব্রুণো নামের এক বিজ্ঞানীকে বহু বছর আগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আপোস করেননি।
বয়স্ক: ব্রুণোর প্রতি সেখানে অন্যায় করা হয়েছিল। কারণ বৈজ্ঞানিক ব্রুণো সেদিন কারো তথ্য চুরি করেননি। কিন্তু তুমি আমার ভাণ্ডার থেকে তা চুরি করেছো।
তরুণী: চুরি নয় ছিনতাই। বহু মানুষের হত্যার সংবাদ সেখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন আপনি।
বয়স্ক: যা নিয়ে অন্য কেউ মাথা ঘামায়নি, তা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছো কেন? যদি চুরি করা তথ্যগুলো ফিরিয়ে না দাও, কঠিন শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।

 

তরুণী: সত্য প্রতিষ্ঠা করা আমার দায়িত্ব ।
বয়স্ক: পুরো প্রশাসন যেখানে আমার সঙ্গে যুক্ত সেখানে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তুমি সত্য প্রতিষ্ঠা করবে? ভুল পথে হাঁটছো বালিকা। গণমাধ্যমগুলোর যেখানে সত্য প্রচার করার কথা, সেখানে তারাই ভয়ে মুখ খুলছে না।
তরুণী: সবগুলো প্রচার মাধ্যম যে মুখ বন্ধ করে বসে আছে তাও নয়।
বয়স্ক: চারদিকে ভালো করে চোখ মেলে তাকাও। সত্য প্রতিষ্ঠার দিন শেষ। কয়েকজনের ইশারা বা আঙ্গুল হেলনে সবকিছু চলছে। সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক সবাই সত্য প্রতিষ্ঠার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। শুধু তুমি একা মাথা উঁচু করে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাও? [খুব রেগে] ভুল সিদ্ধান্ত! যদি তুমি উদ্ধত আচরণ করো, তোমার উঁচু মাথা গুড়িয়ে নীচু করে দেয়া হবে।

 

তরুণী: হ্যাঁচ্ছোঃ, ভয় কী দেখাচ্ছো? হ্যাঁচ্ছোঃ
[বয়স্ক তরুণীর সাহস দেখে ধাক্কা খায়। নিজেকে সামলে নিয়ে]
বয়স্ক: রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ নাটকের গান। ঠিক বলেছি না?
তরুণী: মনে হচ্ছে আপনার সাম্রাজ্যটাও তাই। চিড়েতন, হর্তন, ইস্কাবন-একটা তাসের দেশ।
বয়স্ক: বলতে পারি, গুরুদেব মানে রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে তুমি কিছুটা মুগ্ধই করেছো আমাকে।
তরুণী: গুরুদেব মানে?
বয়স্ক: নিশ্চয় সে তোমার গুরুদেব হবেন। কিন্তু মানুষটাকে আমিও চিনি। যদি অনুমতি দাও, তাসের দেশ থেকে আমিও দু-একটা লাইন বলতে পারি।
তরুণী: বলুন।
বয়স্ক: ঠিক পরের অংশেই তোমার উদ্দেশ্যেই তিনি বলছেন, ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত। আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।’ নতুন যৌবনের দূত হওয়াটা ভালো লক্ষণ নয় বালিকা।

 

তরুণী: রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন তাহলে?
বয়স্ক: বহু বছর আগে পড়েছিলাম। বলতে পারো বহু কিছুই পড়া হয়েছে। নাটক তো একটাও বাদ রাখিনি।
তরুণী: সত্যি বলছেন?
বয়স্ক: হ্যাঁ।
তরুণী: বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
বয়স্ক: [হাসে] ‘আকাশে তো আমি রাখি নাই, মোর উড়িবার ইতিহাস।
তবুও উড়েছিনু।
তরুণী: খুবই অবাক হচ্ছি আমি।
বয়স্ক: রবীন্দ্রনাথ থেকে আরো খানিকটা বলবো? শুনবে-
তরুণী: নিশ্চয়।
বয়স্ক: যার যাহা বল
তাই তার অস্ত্র, পিতঃ যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,
তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ কোন্ নর লজ্জা পায়?

 

তরুণী: ঠাকুরের কোন কবিতা?
বয়স্ক: [হাসে] গান্ধারীর শেষ আবেদন। পড়োনি?
তরণী: না।
বয়স্ক: সম্ভবত এবারেরটা পড়ে থাকবে-
তরুণী: শুনি আগে।
বয়স্ক: গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
তরুণী:একখানি ছোট খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা-
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

 

বয়স্ক: ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই-ছোট সে তরী
আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
তরুণী: বাহ আপনি তো অনেক মনে রেখেছেন।
বয়স্ক: সত্যি বলতে তোমাকে দেখে হঠাৎ রবিঠাকুরের রক্তকরবী নাটকের নন্দিনীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। নাটকটা কখনো পড়েছো?
তরুণী: পড়েছি।
বয়স্ক: বলতে পারবে?
তরুণী: হ্যাঁ। রাজাকে নন্দিনী বলছে-
সময় হয়েছে, দরজা খোলো।
[ দুজন তখন অভিনয় করে চলে। ]
বয়স্ক: আবার এসেছ অসময়ে। এখনই যাও, যাও তুমি।
তরুণী: অপেক্ষা করার সময় নেই, শুনতেই হবে আমার কথা।
বয়স্ক: কী বলবার আছে বাইরে থেকে বলে চলে যাও।
তরুণী: বাইরে থেকে কথার সুর তোমার কানে পৌঁছায় না।
বয়স্ক: আজ ধ্বজাপূজা, আমার মন বিক্ষিপ্ত কোরো না। পূজার ব্যাঘাত হবে। যাও যাও। এখনই যাও।
তরুণী: আমার ভয় ঘুচে গেছে। অমন করে তাড়াতে পারবে না। মরি সেও ভালো, দরজা না খুলিয়ে নড়ব না।
বয়স্ক: বাহ! তুমি সুন্দর অভিনয় করো।

 

তরুণী: যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম একবার রক্তকরবী নাটকে অভিনয় করেছিলাম।
বয়স্ক: তাই? আর কী নাটক করেছো?
তরুণী: আন্তিগোনে নাটকে একবার আন্তিগোনের চরিত্রে অভিনয় করেছি।
বয়স্ক: আন্তিগোনের শেষ পরিণতির কথা মনে আছে?
তরুণী: কেন থাকবে না।
বয়স্ক: [হঠাৎ ক্রুদ্ধ স্বরে] যদি তোমার শেষ পরিণতি আন্তিগোনের মতো হয়।
তরুণী: কখনো কি আমার চোখে মুখে ভয় দেখেছেন?
বয়স্ক: মৃত্যুকে তুমি ভয় পাও না?
তরুণী : পাই। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে অন্যায় করা চলে না।
বয়স্ক: বুঝতে পারছো যে তুমি একা? তোমার পাশে কেউ থাকবে না।
তরুণী: না থাকলো। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো-
বয়স্ক: [কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে স্বগত] ঠিক আমার মেয়েটার মতো হয়েছে। কণ্ঠস্বরে সামান্য ভয় নেই।
তরুণী: নিজের মেয়ের কথা কী বললেন?
বয়স্ক: কথাটা তোমাকে বলেই ফেলি, ঠিক তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। সে-কারণেই তোমার সঙ্গে এতটা ভদ্র ব্যবহার করছি। না হলে হয়তো-

 

তরুণী: বলুন। না হলে-
বয়স্ক: কন্যার বয়সী তুমি, তোমাকে আমি হত্যা করতে চাই না। দয়া করে আমাকে তথ্যগুলো ফেরত দাও।
[মেয়েটার পায়ের কাছে বসে পড়ে]
তরুণী: কী ব্যাপার অধীশ্বর, নিজের রাজ্যে বসে আপনি এমন আচরণ করছেন কেন?
বয়স্ক: স্পষ্ট করে বলবো? যখন তোমার সামনে এসে দাঁড়াই একটা দুর্বলতা আমাকে পেয়ে বসে। কারণ আমার মেয়ের ছায়া দেখতে পাই তোমার ভিতরে। ঠিক তোমারই মতো উদ্ধত। কখনো উচ্চস্বরে কথা বলতো না। কিন্তু যা বলতো তার নড়চড় হতো না।
তরুণী: সত্যি? [স্বর পাল্টে] আপনার সেই কন্যাকে একবার দেখতে পারি? মানে আমার সঙ্গে একবার কি তার সাক্ষাৎ হতে পারে?
বয়স্ক: না সেটা সম্ভব নয়।
তরুণী: সমস্যা কি? এক নজর দেখবো তাকে। যাকে আপনি এত ভালোবাসেন।
বয়স্ক: বললাম তো সম্ভব নয়।
তরুণী: কেন?
বয়স্ক: থাক সেসব প্রসঙ্গ।
তরুণী: থাকবে কেন? বলুন।
বয়স্ক: আমার মেয়েটা ছিল ঠিক তোমার মতোই দৃঢ়চেতা। মাত্র সতেরো বছর বয়সে আমার এই সাম্রাজ্য আমার সবকিছুর বিরুদ্ধে সে একদিন বিদ্রোহ করে বসে।
তরুণী: তারপর?
বয়স্ক: রাগ করে সে চলে যায় আমাকে ছেড়ে। কখনো ফিরে আসেনি আর।
তরুণী: কন্যাটি কোথায় আপনার এখন?
বয়স্ক: জানি না, আর কখনো সন্ধান পাইনি।

 

তরুণী: সন্তান হারাবার বেদনা আমি জানি না। কিন্তু পিতা হারাবার বেদনা আমি জানি। খুব কম বয়সে আমি আমার পিতাকে হারিয়েছি।
বয়স্ক: তোমার বয়সী মেয়ের জন্য কম বয়সে পিতাকে হারানো খুব দুঃখজনক। হয়তো তোমার সেই কষ্ট খানিকটা আমি বুঝতে পারছি।
তরুণী: মনে মনে আমি চাই, আপনি যেন আপনার কন্যাকে খুঁজে পান।
বয়স্ক: কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে আমি আমার পেশার কারণেই খুব নিষ্ঠুর। যদি তুমি আমার হাতে তোমার তথ্যগুলো ফিরিয়ে না দাও, আমাকে নিষ্ঠুর হতেই হবে। যদি তুমি মত না পাল্টাও-
তরুণী: বহু আগেই আমার সিদ্ধান্ত আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি।
বয়স্ক: মৃত্যুকেই বেছে নিতে চাও?
তরুণী: যদি তাই ঘটে মেনে নিতেই হবে।
বয়স্ক: ভীষণরকম উদ্ধত বালিকা তুমি, আমি যদি আমার সমস্ত শক্তিটা তোমাকে দেখাতে পারতাম।
তরুণী: মৃত্যুকে যে নীরবে শান্তভাবে মেনে নিতে পারে তাকে আর কী শক্তি দেখাবেন।
বয়স্ক: নিজেকে সক্রেটিস মনে করো! নীরবে ঠাণ্ডা মাথায় যে শাসকদের দেয়া মৃত্যুদণ্ড মেনে নিয়ে হেমলক পান করেছিল।

 

তরুণী: শুধু মহান সক্রেটিস কেন, লক্ষ লক্ষ সম্মানিত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে। দীর্ঘ সে ইতিহাস।
বয়স্ক: কিন্তু তুমি কিছুতেই বুঝতে পারছ না, সত্যের জন্য এইভাবে প্রাণ দেয়ার চেয়ে গ্যালিলিওর মতো আপস করে বেঁচে থাকা ভালো।
তরুণী: সম্মানিত গ্যালিলিও চার্চের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে আপস করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বয়স্ক: ঠিক সেই পরামর্শটাই তোমাকে দিচ্ছি। মৃত্যুকে বেছে না নিয়ে জীবনকে বেছে নাও। যদি বেঁচে থাকো বাকিজীবনে বহু সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারবে।
তরুণী: বাহ বেশ যুক্তি আছে আপনার কথায়।
বয়স্ক: [কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ] বিশ্বাস করবে কি না জানি না। যদি তুমি তথ্যগুলো আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমার কন্যার মর্যাদা পাবে। যখন আমি থাকবো না, তুমি হবে এই বিরাট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। নিশ্চিত আমি যে, আমার কন্যা আর ফিরে আসবে না।

 

তরুণী: খুব আনন্দের খবর আপনি আমাকে আপনার কন্যা হিসেবে গ্রহণ করতে চাইছেন। যখন আমার পিতা জীবিত নয়, তখন আপনাকে পিতার সম্মান দিতে আমার আপত্তি নেই।
বয়স্ক: সত্যি বলছো?
তরুণী: হ্যাঁ। যখন আপনি আমাকে সন্তানের মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সেই আবেগকে আমি খাটো করতে পারি না।
বয়স্ক: বাহ! আমার কন্যার সঙ্গে তোমার এতটাই মিল যে, আমি ভিতরে ভিতরে তোমাকে কন্যাই ভাবছিলাম। কিছুতেই নিষ্ঠুর হতে পারছিলাম না। শুধু যে তোমার ভিতরে আমার কন্যাকেই দেখতে পাচ্ছিলাম তা নয়, নিজের অতীতটাও যেন তোমার ভিতরে দেখতে পাচ্ছিলাম।
তরুণী: মানে? [কিছু ভেবে নিয়ে] কী বলছিলেন নিজের অতীত সম্পর্কে?
বয়স্ক: না না তেমন কিছু না।
তরুণী: মানুষ হিসেবে আপনি যতই নিষ্ঠুর হন, আপনার ভিতরের প্রকৃতিটা বিচিত্র। ভাবছি, আপনি এই পথে কী করে এলেন? এটা তো আপনার পথ নয়।
বয়স্ক: বালিকা, ক্রমাগত তুমি আমাকে চমকিত করছো। বলতে পারো মুগ্ধ করে চলেছো। ঠিক আছে আসো, প্রথম আমরা একটা শর্তে আসি-

 

তরুণী: যাকে কন্যা বলে মেনে নিয়েছেন তার সঙ্গে হিসেবের লেনদেন করতে চান! কন্যার সঙ্গে কি পিতার হিসেবী সম্পর্ক হয়?
বয়স্ক: না হয় না। কিন্তু যে সাম্রাজ্য আমার কন্যাকে দিয়ে যাবো ভাবছি, সেই সাম্রাজ্যটা আমাকে আগে টিকিয়ে রাখতে হবে। যদি তথ্যগুলো বিরোধী পক্ষের হাতে চলে যায়, আমার এই সাম্রাজ্যের সবকিছু তারা গুড়িয়ে দেবে।
তরুণী: দিক। অসুবিধা কি?
বয়স্ক: বিরাট সাম্রাজ্যের কিছুই আর তখন তোমার কপালে জুটবে না।
তরুণী: নিজের কন্যার কথা আর একবার ভাবুন। নিশ্চয় সে আপনার এই বিরাট সাম্রাজ্য চায়নি। চাইলে এসব ফেলে চলে যেতো না। হয়তো সে শুধু পিতার স্নেহটুকুই আপনার কাছে পেতে চেয়েছিল। আপনার সাম্রাজ্য নয়, পিতার স্নেহটুকুই শুধু আমি আপনার কাছে চাই।
বয়স্ক: বুঝতে পেরেছি কন্যা সেজে ক্রমাগতই আমার মনকে দুর্বল করছো। কিন্তু না, এই দুর্বলতা আমার সাজে না।
তরুণী: নিষ্ঠুর হতে চান আমার উপর? হতে পারেন। মৃত্যুকে এখন আমার আর ভয় নেই। কারণ মৃত্যুর আগে আমার হত্যাকারী আমাকে তার সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বয়স্ক: বিশ্বাস কর মা, তোকে আমি কন্যার মতোই দেখি। আমাকে তোর উপর নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করিস না।

 

তরুণী: নিজের কন্যার উপর তো ঠিকই নিষ্ঠুর হয়েছিলেন। তাহলে কেন আমার উপরে হবেন না?
বয়স্ক: না, নিজের কন্যার উপর আমি সামান্য নিষ্ঠুর হইনি।
তরুণী: নিষ্ঠুর না হলে সে মারা পড়লো কী করে? [বয়স্ক ধরা পড়ে বিমূঢ় হয়ে যায়] খুব অবাক হচ্ছেন। ভুলে যাচ্ছেন কেন, আপনার তথ্যের কিছু ভাণ্ডার আমার হাতে আছে।
বয়স্ক: না, তাকে আমি মারিনি। পিতা নিজের কন্যাকে হত্যা করতে পারে না।
তরুণী: নিজের হাতে করেননি। কিন্তু কারো না কারো গুলিতেই তো মারা পড়েছিল।
বয়স্ক: বিরোধী পক্ষ সুযোগটা নেয়। যখন আমার কন্যা আমার সকল নিরপত্তার বেস্টনী পার হয়ে রাগ করে চলে যায়, বিরোধী পক্ষ সুযোগটা নেয়। হঠাৎ একদিন নিরাপত্তহীন পেয়ে শত্রু পক্ষ আমার মেয়েকে হত্যা করে।
তরুণী: [কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে।] কন্যার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তাহলে আপনি পর পর বহুজনকে হত্যা করেন?
বয়স্ক: হ্যাঁ। কিন্তু যতক্ষণ না আমি মূল শত্রুকে হত্যা করতে পারছি আমার জ্বালা মিটবে না। ফুলের মতো মিষ্টি, মমতাময়ী, নির্র্লোভ, নিষ্পাপ আমার মেয়েটাকে নিষ্ঠুরের মতো ওরা হত্যা করেছে। বুঝতে পারছো এবার, কেন আমি তথ্যগুলো ফিরে পেতে চাই। যদি তথ্যগুলো ওদের হাতে পড়ে তাহলে মেয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে আমি ব্যর্থ হবো।

 

তরুণী: হত্যার তথ্যগুলো সব আমার কাছে আছে। যা আপনার তথ্যভাণ্ডার থেকে আমি চুরি করেছি। কিন্তু তার পেছনের এতসব কারণ আমার তখন জানা ছিল না।
বয়স্ক: বুঝতে পারো নিজের মেয়ের এই করুণ মৃত্যু কতো কষ্টকর। জানি মেয়ে আমার আর ফিরবে না। কিন্তু প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। যে এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে তাকে হত্যা করেই তবে আমার শান্তি।
তরুণী: খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।
বয়স্ক: কেন?
তরুণী: না তেমন কিছু না। সত্যি কি আমার সঙ্গে আপনার কন্যার মিল আছে?
বয়স্ক: হ্যাঁ, তোমরা দুজনেই ঠাণ্ডা মাথার অসম্ভব জেদী মেয়ে। যা সিদ্ধান্ত নাও করে ফেলতে চাও। দুজনেই তোমরা বিবেকবান, সহানুভূতিশীল। রবীন্দ্রনাথ মনে হচ্ছে তোমার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব?
তরুণী: বলতে পারেন আমি তার অন্ধ ভক্ত। দিবসও রজনী তার ধ্যান করি। রক্তকরবী নাটকটা আমার ভীষণ পছন্দ। নন্দিনীর সব সংলাপ এখনো আমার মুখস্থ।
বয়স্ক: ঠিক তুমি আমার কন্যার মতো। মা তাকে কতো ইংরেজি পড়ালো। কিন্তু সে হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের গানের ভক্ত। মুখে সারাক্ষণ রবীন্দ্রনাথের গান। কিন্তু আমার কন্যা আবার ভিন্ন দিকে রবীন্দ্রনাথের খুব সমালোচক। কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, মুখে সারাক্ষণ রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা আর নিন্দা।

 

তরুণী: বাহ!
বয়স্ক: ঠিক যেমন তুমি। পিতার স্নেহ আমার ঠিকই গ্রহণ করেছো কিন্তু আমার অপরাধগুলো ক্ষমা করতে পারছো না।
তরুণী: রবীন্দ্রনাথের প্রতি আপনার এত দুর্বলতা কেন?
বয়স্ক: সত্যিই জানতে চাও?
তরুণী: ‘হ্যাঁ, অবশ্যই জানতে চাই।
বয়স্ক: কখনো বা কোনো এক সময়ে আমি বিশ্বভারতীরই ছাত্র ছিলাম। [তরুণী অবাক হয়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পায় না।] খুব অবাক লাগছে?
তরুণী: প্রশ্ন করি একটা? আপনি কেন নিজেকে এভাবে জালের মধ্যে আটকে রেখেছেন? ঠিক রক্তকরবীর রাজার মতো। বরং এসব না করে, সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করুন। আপনার নিজের কন্যা পর্যন্ত আপনার এসব কর্ম পছন্দ করতো না। আপনার এসব কাজের জন্য রাগ করে সে আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
বয়স্ক: কন্যা আমার, প্রিয় কন্যা আমার ফিরবার আর পথ নেই। যখন তুমি একবার বাঘের পিঠে চড়ে বসবে সেখান থেকে আর নামা যায় না।

 

তরুণী: বলুন তো কেন এই অপরাধ চক্রের জীবনে ঢুকে পড়লেন। নিজেকে ভয়াবহ একজন খুনী বানিয়ে ফেললেন?
বয়স্ক: থাক সেসব প্রসঙ্গ। দীর্ঘ সে ইতিহাস। তোমার ভালো লাগবে না।
তরুণী: কিন্তু আমি যে জানতে চাই। বলুন।
বয়স্ক: সত্যি শুনতে চাও?
তরুণী: হ্যাঁ।
বয়স্ক: ঠিক তোমার মতো প্রতিবাদী চরিত্র নিয়েই আমি বড় হয়েছিলাম। রাজনীতি করতাম গণমানুষের। কতো সভা, কতো মিছিল করলাম, কতোবার কারাগারে গেলাম।
তরুণী: সত্যি বলছেন?
বয়স্ক: হ্যাঁ। কিন্তু যখন দেখলাম যাদের সঙ্গে রাজনীতি করছি, যাদেরকে মহাপুরুষ ভেবেছি তারা প্রায় সবাই ভণ্ড। সবাই জনগণের কথা বলে নিজের আখের গোছাচ্ছে। শুধু নিজেরই প্রচার চাইছে। হঠাৎ রাগে ক্ষোভে একদিন রাস্তাটা পাল্টে ফেললাম। ধীরে ধীরে তারপর একদিন এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে দাঁড়ালাম।

 

তরুণী: শুধু এইটুকু কারণে?
বয়স্ক: না। আরো কারণ আছে। কখনো সত্যের পথ থেকে সরে দাঁড়াতে চাইনি। কিন্তু সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাটা কঠিন। যারা মিথ্যার পক্ষে কাজ করছে তাদের শক্তি অনেক বেশি। ইবসেনের ‘জনতার শত্রু’ নাটকটা পড়েছো?
তরুণী: নাটকটা পড়িনি। কিন্তু মঞ্চে নাটকটার অভিনয় দেখেছি।
বয়স্ক: কী আছে সে নাটকে?
তরুণী: সৎ একজন চিকিৎসকের সংগ্রামের কথা। শহরের বাসিন্দাদের জন্য পৌরসভা থেকে সরবরাহকৃত জলে রোগজীবানু কিলবিল করছিল। কর্তৃপক্ষ সেটা গোপন করার চেষ্টা করে। কিন্তু পৌরসভায় চাকরিরত সৎ চিকিৎসক সেটা ফাঁস করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন চিকিৎসকে ভয় দেখাতে আরম্ভ করে। চিকিৎসক সত্য বলা থেকে বিরত না হলে প্রশাসন তার উপর ক্ষেপে যায়। প্রশাসন সংবাদ মাধ্যমকে টাকা দিয়ে সত্য বলা থেকে বিরত রাখে। চিকিৎসক তখন অসহায় হয়ে পড়ে। প্রশাসন মিথ্যা অভিযোগ এনে চিকিৎসককে চাকুরিচ্যুত করে।
বয়স্ক: সত্যের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য চিকিৎসককে শেষ পর্যন্ত শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। শহরের গণ্যমান্য মানুষরা কেউ সেদিন চিকিৎসকের পক্ষে দাঁড়ায়নি। বুঝতে পারছো এবার? চারদিকে সুযোগসন্ধানী এবং চাটুকারে ভরা পৃথিবীতে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো কতোটা কঠিন?

 

তরুণী: ঠিক বলেছেন আপনি।
বয়স্ক: যখন সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে এমনি বারবার প্রবল বাধার সম্মুখিন হয়েছি, যখন সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই চিকিৎসকের মতো সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই, তখন হঠাৎ একদিন মুখোসধারী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করি।
তরুণী: ঠিক তারপরেই গণমানুষের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত হাতের অধীশ্বর হয়ে বসলেন!
বয়স্ক: বিরাট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর আমি তাতে সন্দেহ নেই। যা কিছু তুমি চাও তোমার হাতের মুঠোয় এনে দিতে পারি। চাইলে তোমাকে আমি বিরাট সাহিত্যিক বানিয়ে দিতে পারি। চাইলেই চলচ্চিত্র জগতের বিরাট তারকা বানিয়ে দিতে পারি আমি তোমাকে।
তরুণী: কী ভাবে?
বয়স্ক: প্রচার মাধ্যমকে যা আমি বলবো তাই ঘটবে। যদি চলচ্চিত্রে সবচেয়ে খারাপ অভিনয় তুমি করে থাকো, সমস্ত প্রচার মাধ্যমকে বলতে হবে তোমার অভিনয়ই শ্রেষ্ঠ। শুধু প্রচার মাধ্যম নয়, বড় বড় প্রখ্যাত সব ব্যক্তিত্বরা রাতারাতি তোমার অভিনয়ের প্রশংসা করা শুরু করবে। শুধু মাত্র আমার হাতের ইশারায় সব ঘটবে। সবচেয়ে খারাপ অভিনয় করেই তুমি সেরা অভিনেত্রীর তকমা পেয়ে যাবে।

 

তরুণী: রাজনীতি আমি তেমন বুঝি না। ভাস্কর বলে সারা বিশ্বটাই নাকি এভাবে চলছে। প্রচারের জোরে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানো হচ্ছে।
বয়স্ক: ভাস্কর ঠিকই বলেছে। যদি সমাজের ভালো করতে চাও, রাজনীতি তোমাকে বুঝতে হবে। সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ আর অর্থনীতি নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে। শুধু বিজ্ঞান চর্চা করলে হবে না। মনে রাখবে বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানকে শাসন করছে বাণিজ্য। ফলে এই বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের তেমন কাজে আসছে না। ব্যবসায়ীরা একে তার মুনাফার কাজে লাগাচ্ছে। বিশ্ব চালায় ব্যবসায়ীরা। বিশ্বের প্রায় সব মেধাবীরাই তাদের পদলেহন করে। ব্যতিক্রম শুধু তোমার মতো কয়েকজন।
তরুণী: নিজের বিরুদ্ধেই আপনি আমাকে এসব বলছেন।
বয়স্ক: নিজের মেয়েকেও প্রায় আমি তাই বলতাম। সবসময় চাইতাম মেয়েটা যেন আমার এই জগতের মোহে পড়ে না যায়। ঠিক যেন আমার ছেলেবেলার চিন্তা নিয়ে সে বড় হয়। [স্বর পাল্টে] রবীন্দ্রনাথের ভক্ত সে তো আর এমনিতেই হয়নি। নিজেই আমি তাকে সে পথেই পরিচালিত করেছিলাম।

 

তরুণী: কন্যার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার তবে এই ইতিহাস? নিজেই আপনি তাকে আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে শিখিয়েছিলেন?
বয়স্ক: যতো দ্রুত সে বিদ্রোহ করেছিল তা আমি চাইনি। কন্যাকে আমি প্রথম গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। লড়বার সব বিদ্যা সব মন্ত্র তাকে শেখাতে মনস্থ করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম লড়াইটা কতো কঠিন। কিন্তু সব বিদ্যা আয়ত্ত করার আগেই সে বিদ্রোহ করে বসলো। [সামান্য থেমে] কন্যার হয়তো সেটা দোষ নয়। সমাজটা এতটাই পচে গিয়েছিল, চারদিকে এত অন্যায় দেখে সে নিজে কিছুতেই আর অপেক্ষা করতে পারেনি। পিতার বিরুদ্ধেই প্রথম বিদ্রোহ করে বসলো।
তরুণী: নিজের চোখের সামনে ভিন্ন একটা মানুষকে দেখছি আমি।
বয়স্ক: [হঠাৎ আবৃত্তির ভঙ্গিতে] রূপ নারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়।
তরুণী: সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। [স্বর পাল্টে] কতরূপ আপনার! কতোরকম বিপরীত সত্তা নিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে বসে আছেন।
বয়স্ক: বিশাল সাম্রাজ্যটাই শুধু দেখতে পাচ্ছো তুমি। কিন্তু আমার ভেতরের হাহাকারটা কি শুনতে পাচ্ছো? বিশাল এই সাম্রাজ্যে আমি যে ভীষণ একা। প্রাণ খুলে কথা বলবার কেউ নেই আমার। [তরুণী কিছুটা বিমূঢ়। বয়স্ক প্রসঙ্গ পাল্টায়] কন্যা তুমি সৎ, তাই শত্রু পক্ষের হলেও তোমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলছি।
তরুণী: সত্যিই কি আপনি আমাকে পিতার চোখ দিয়ে কন্যা হিসেবে দেখছেন?
বয়স্ক: প্রথম থেকেই তুমি আমার সামনে আমার কন্যার ছায়া হয়ে এসেছিলে। ঠিক এখন আমার কন্যা হয়ে গেছো। যতোই তোমার সঙ্গে আমার বিরোধ হোক, তুমি আমার হৃদয়ে আমার কন্যা হয়েই বেঁচে থাকেবে।
তরুণী: দয়া করে আর এমন করে বলবেন না, আমি কেঁদে ফেলবো। কারণ আমি মনে হয় আপনাকে পিতার মতোই ভালোবেসে ফেলেছি।
[সে কাঁদতে শুরু করে।]
বয়স্ক: কী হয়েছে মা?
তরুণী : কিছু না।
[বাইরে থেকে একটা সংকেত ভেসে আসে।]
বয়স্ক:[সংকেতের প্রতি] ভিতরে আসার নির্দেশ দেয়া গেল।
[যুবতী আসে।]
বয়স্ক: কী খবর? কিছু অঘটন?
যুবতী: সম্ভবত তথ্য ভাণ্ডারের কিছু প্রমাণ শত্রু পক্ষের হাতে চলে গেছে। প্রশাসন থেকে তাই জানানো হয়েছে। শত্রু পক্ষকে আপনি ঠিক চিনবেন।
বয়স্ক: ঠিক আছে তুমি যাও। সর্দারকে ধীরস্থিরভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখতে বলো। চলবে