রিফাত বিন সালামের গদ্য ‘ফ্যাতাড়ু হইতে সাবধান’

প্রকাশিত : জুলাই ০৮, ২০২১

ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে কিছু বলার আগে লেখক সুবিমল মিশ্রের কয়েকটা লাইন বলে নেয়া ভালো। এতে কবি নবারুণ ভট্টাচার্যর চরিত্রটাকে আরো সহজে ধরা সম্ভব। সুবিমল মিশ্র বলছেন, মোট কথা বই হওয়াকে বই-হওয়ার ট্রেডিশন থেকে বের করে আনতে হবে। সাহিত্যকে সাহিত্য-হওয়ার ট্রেডিশন থেকে। এদিকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে আমার মনে হলো, রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্র-ট্রেডিশন থেকেও বের করে আনতে হবে। সে সময় এখন এসে গেছে।

নবারুণ আসলে এ কাজটাই করেছেন। সুপার-হিরোকে সুপার-হিরো হওয়ার ট্রেডিশন থেকে বের করে করে এনেছেন। ফ্যাতাড়ুরা অন্য দুনিয়া থেকে আসা সুপারম্যান টাইপ কোনো এলিয়েন নয়। কিন্তু ওরা সুপার-হিরো। ওরা এক্কেবারে মানুষ, খাঁটি মানুষ। শুধু খাঁটি মানুষই বরং প্রিকুলিয়ার খাঁটি বাঙালি। ওদের পাখা নেই, অথচ ওরা উড়তে পারে। ফ্যাঁত্ ফ্যাঁত্ সাঁই সাঁই মন্ত্র বলে নিউটনের সূত্র অমান্য করে ওরা আকাশে উড়ে বেড়ায়। উড়ে গিয়ে হয়তো কালোবাজারিদের ভয় দেখায় কখনো। কখনো ভণ্ড প্রগতিশীল সাহিত্যিকের মুখোশ খুলে ফ্যালে। এমনকি, আইপিএল খেলা চলাকালীন মাঠে গিয়ে নাচ দেখিয়ে খেলা ভণ্ডুল করে দ্যায় ওরা। পশ্চিমা সুপার হিরোদের মতো ঝকঝকে আঁটোসাটো পোশাক পড়ে না। ধুতি, ছেঁড়া নোংরা পাঞ্জাবি আর তিনবেলা ভাত থাকে ওদের চিন্তায়। তা-বলে ওরা কিন্তু অবুঝ নয়, পুঁজিবাদী সভ্যতার খেলা অনেক ভালোভাবেই ওরা বোঝে। আবার রোজ নিয়ম করে বাংলা মদের সঙ্গে চলে বাঙালিয়ানা আড্ডা। কিন্তু শ্রেণি সচেতন মাতাল তারা।

যে সমাজে ওদের দাম নেই, যে সমাজ ওদের মানুষ হিসেবে মনেই করে না, সে সমাজের কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয় না ওরা। ভাত আর শান্তির ঘুম, এটাই ফ্যাতাড়ুদের দাবি। অন্যায় সহ্য হয় না ওদের। সবমিলে আজব জিনিস ফ্যাতাড়ুরা।

কবি নবারুণ ভট্টাচার্য ছাড়া আর কারো এত দম ছিল না যে, ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে গল্প ফাঁদবেন। আর কে বা এত রাজনৈতিক সচেতন লেখক ছিলেন গত কয়েক দশকে? আছেন দু’চারজন, কিন্তু নিম্নবিত্ত যাপনের মৌখিক ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সামনে আনার সাহস দেখিয়েছেন কয়জন? ফেলুদা, হিমু, ব্যোমকেশ, শবর....বাংলা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী চরিত্র আছে, ছিল, আসছে নতুন নতুন চরিত্র। কিন্তু এর কোনো চরিত্রই শ্রেণি সচেতনতার কথা বলেনি। এসব চরিত্রে অপমানিত মানুষদের Revenge নেয়ার মটিভ অনুপস্থিত। এরা কেউ বলে না Revenge নিতে হবে। ধাক্কা না দিলে সমাজ কাউকে সম্মান দেয় না। সরকারি অফিসে, বাসে, ট্রেনে, শপিং মলে কিংবা সরকারি হাসপাতালে রোজ রোজ ডাক্তার বা নার্সের খ্যাঁকানি খেয়ে সম্মানের ভয়ে চেপে যাওয়া অপমানিত ভদ্র-সভ্য মিডিল ক্লাস কিংবা লোয়ার ক্লাস মানুষের প্রতিশোধ নেয়ার গল্প নেই এসব সাহিত্যে। থাকলেও আমতা আমতা করে বলা কিছু ট্যাজেডি মার্কা ন্যাকা গল্প আছে। ফ্যাতাড়ুরা এক্কেবারেই ন্যাকামি পছন্দ করে না। বরং পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করে।

নবারুণ সেই কাজটাই করেছেন ফ্যাতাড়ুদের দিয়ে। ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে নবারুণ নিজেই বলছেন সে কথা, "একটা ব্যর্থতা বোধ তো ওদের মধ্যেই আছেই। কারণ রাজনৈতিকভাবে আমরা যা কিছু অর্জন করেছিলাম তার অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সেই বোধটা আজকে যদি কোনো রাজনীতি সচেতন লেখকের মধ্যে না থাকে, আমি সেটাকে আশ্চর্য বলে মনে করবো। কিন্তু ফ্যাতাড়ু শুধু একতা রাজনীতির ব্যাপার নয়, ফ্যাতাড়ু একটা দৃষ্টিভঙ্গি Towards রাজনীতি। আর ফ্যাতাড়ুরা ব্যর্থতা বা সতর্কতার কোনো তোয়াক্কায় করে না। তাদের কাজই হলো উড়ে বেড়ানো আর যেখানে সেখানে ঝামেলা পাকানো। তারা সেটাই করেছে। ওদের পাবলিসিটিটা অনেক বেড়ে গেছে। ফ্যাতাড়ু হলো মানুষের স্বপ্নের সেলিব্রেশন, তার প্যাশানের সেলিব্রেশন। এ যে স্থিতাবস্থা, বড়োলোকদের বদমাইশি ওগুলো তো দেখতে ভালো লাগে না। কিছু করতে পারি না। ফাইভস্টার হোটেলে গিয়ে তো চোখ মারতে পারি না। চারটে ফ্যাতাড়ু ঢুকিয়ে দিই। তারা যা পারে করুক। কিছু বানচাল করে দিক, ভেস্তে দিক, এর মধ্যে Spoil করার একটা আনন্দ আছে।

আমি মনে করি, এতে অপমানিত মানুষদের একটা Revenge নেয়ার ব্যাপার আছে। অনেকেই আমাদের জীবনে নানা ক্ষেত্রে ভয়ংকর Insulted। কারণ এ শহরটা আমাদের অপমান করছে এখন। কারণ এখন রাস্তা  বানাচ্ছে আর শপিং মল বানাচ্ছে, এখানে তুমি এসো না। এখানে তুমি এক্কেবারেই ফ্যাতাড়ু। আমি যদি আমার মতো জামাকাপড় পরে সেখানে যাই কিচ্ছু হবে না, কেউ আমাকে পাত্তা দেবে না। এখন আমি তো শুধু নবারুণ, নিজেই না বরং বাংলা সাহিত্যে ফ্যাতাড়ুর আবির্ভাব এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু করতে পারি না। অন্তত আমার ডি.এস, মদন এরা করবে আর পুরুন্দর ভাট কবিতা লিখবে। এগুলো চলবেই, কিছু করার নেই।"

নবারুণ ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ু সিরিজে অসংখ্য ফ্যাতাড়ুর অস্তিত্বের কথা বলা হলেও মূলত প্রধান তিন ফ্যাতাড়ুকে নিয়েই গল্পগুলো বাধা হয়েছে। মদন, ডি এস এবং পুরন্দর ভাট এ তিনজন হলো ফ্যাতাড়ু সিরিজের নায়ক। নবারুণ ভট্টাচার্যের ছোটগল্প ফ্যাতাড়ুতে দুজন ফ্যাতাড়ুর কথা বলা আছে। মদন ও ডি.এস। পরবর্তী ছোটগল্প ও উপন্যাসে পুরন্দর ভাটের উদয় হয়। মদন দুনিয়ার সকল খোঁজ-খবর জানে। দুনিয়ার কোথায় কি হচ্ছে, কে কোন দেশ দখল করছে, যুদ্ধ, মিসাইল, রাজনীতি, বিজ্ঞান, এমনকি কলকাতা শহরে কোথায় কি চলছে সব কিছুরই খবর রাখে মদন। একই সাথে বাকি দুই ফ্যাতাড়ুর নেতাও সে। যে কোনো সভা-সমিতি, গরিবদের মেরে বড়লোকি ফুর্তিবাজি ভণ্ডুল করতে হয় কিভাবে, সেটা মদন ভালোভাবেই জানে। তারই প্লানে মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডি এস আর পুরন্দর ভাট।

ডি এস অনেকটা পাঁড়মাতাল টাইপ মানুষ, অনেক মোটা, কিছুটা লোভি, মাথা মোটা, সহজেই নার্ভাস হয়ে যাওয়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক আজব বাঙালি। মূলত মদনের জন্যই ডি এস কিছুটা সচেতন মানুষ হয়েছে, এছাড়া ভদ্র-অভদ্র কোনো সমাজেই চলার মতো নয় সে।

আরেক নায়ক হলেন কবি পুরন্দর ভাট। অসম্ভব মেধাবী কবি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা পুরন্দরের একটা কবিতার কিছু লাইন পড়লেই তার ট্যালেন্ট বোঝা যাবে সহজেই,
জাহাজ-ক্যাপ্টেন তুমি, বাকি সব মাঝি আর মাল্লা
সকলে জাঙ্গিয়া পরা,তুমি শুধু পরো আলখাল্লা।

বাংলা সাহিত্যে যে কবিতা লেখার সাহস কেউ দেখায় না, সেই কবিতা লিখেই কবি হয়েছে পুরন্দর।

লেখক: কার্টুনিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী