
সাদ রহমান
লিডারদের একলা চলার তত্ত্ব ও আমাদের অবস্থান
সাদ রহমানপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটা প্রচলিত অর্থে আমাদেরকে ভালো বা পজেটিভের ভাইব দেয়। কিন্তু, গতকাল রাত্রে ভাইবা দেখলাম, গানটা আসলে ততো ভালো বা পজেটিভ না। বা অন্তত আমরা যেইভাবে এই গানকে পাঠ করি, গানটা সেইভাবে পাঠের না।
সাধারণত, আমরা এই গানকে পাঠ করি একটা ইন্সপিরেশনাল বা উৎসাহ হিসেবে, যা হতাশ হয়ে পড়া ব্যক্তিকে জাগায় ও পথ চলার প্রেরণা দেয়, সহজ অর্থে, তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু গানটা আদতে হইলো— আপনি যে শুধু জাইগা উঠবেন ও পথ আগাবেন তাই নয়, বরং আপনি সমাজ বা অন্যের চাইতে বড় বা বিশেষ হবেন, সেরকম অবস্থাই গুরুত্বপূর্ণ।
খেয়াল করছেন কিনা, এই গানের সবচেয়ে মূল জায়গা হইলো ‘ডাক শুনে’। গানটির লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমানের জায়গাটাও মূলত ওইটাই। মানে যখন তিনি `ডাকলেন`, দেখা গেলো কেহই তার ডাক `শুনলো না`। তাই তিনি এই গানটা লেখলেন, অর্থাৎ একলা চললেন।
কথা হইলো, কেহ তার ‘ডাক’ শুনবে ক্যানো? ধরেন আপনি যদি কোন কারণে ‘ডাক’ দেন, সেটা আপাত আপনারই স্বার্থ। এখন সেই ডাক যে অন্যের শুনতে হবে, আর না শুনলে আপনার অভিমান করার সুযোগ থাকবে, এবং এইভাবে, লোকের তরফে আপনার ডাক না শোনার ভিত্তিতেই যে আপনার সামনের পথে একলা চলার মনোভাব তৈরি হবে, আমি বলবো, এইটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি হিসাব-নিকাশ থেকে আসা চিন্তা।
আমি যখন ‘ডাক’ দেই, তখন আমি লিডার হইতে চাই, বা লিডার হই। এটা আমার ডাকের পরিণতি। এখন যারা আমার লিডারত্ব স্বীকার করতে চায় না, তাদের সঙ্গে তাই বইলা আমার অভিমান করা সাজে? সাজে না। কারণ আমার ‘ডাক’ বা ‘লিডারত্ব’কে স্বীকার করবার জন্য এই পৃথিবীতে একজনেরও জন্ম হয় নাই। বরং কেউ যদি আমার ডাক শোনে, সেটা তারই মহত্ব। যা কখনোই আমার প্রাপ্য ছিল না।
এই যে একজন `ডাক` দিলেন, আর সেই অনুসারে অন্যদের `শোনা` অথবা না শোনার ভিত্তিতেই পথ তৈরি হইলো, এইটা যুগে যুগে লিডারদের ঘটানো নানান জমিদারি প্রোপাগাণ্ডাগুলোর একটা। যিনি লিডার হইতে চান, তিনি মূলত দেখাইতে চান যে, তার ডাক আপনি শুনতে বাধ্য।
এই গানের পরবর্তী লাইনে ঠাকুর সাহেব লেখতেছেন, ‘যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা…।’ মজার বিষয় হইলো, এই যে কারোর কথা না কওয়া এবং উল্টা তারই অভাগা হইয়া যাওয়া, এইগুলা লিডারদের তরফে উক্ত প্রোপাগাণ্ডার পরের ধাপ। ‘ডাক দেওয়া’ আর ‘কথা কওয়া’ তো এক অবস্থা না। আগের প্যারাতে তিনি ‘ডাক’ শব্দটি কইলেও এইখানে ঠাকুর ‘কথা’তে নাইমা আসতেছেন ক্যানো? আর তিনিই যে ‘অভাগা’ হইয়া যাইতেছেন, সেটাই বা ক্যানো?
খেয়াল করলে আমাদের বোঝা সম্ভব, ‘ডাক’ আর ‘কথা’কে ঠাকুরের তরফে এক কইরা নেওয়ার মধ্য দিয়া ঠাকুর আসলে তার ‘ডাক’কে আরো স্বাভাবিক কইরা তুলতেছেন। লিডাররাও মূলত এই কামই করেন। তারা আপনার মনে এই জিনিস প্রতিষ্ঠিত করতে চান যে, তার ‘ডাকে’ আপনার অংশগ্রহণও শেষপর্যন্ত একটা কনভারসেশনের মতোই। যেনো আপনারা দুইজনেই কথা বলতে পারবেন। অথচ দেখা যায় তার ‘ডাক’ আপনি শোনার পরে সকল কথা তিনিই বলেন, আপনি এইখানে শ্রোতামাত্র হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এর বেশি কিছু না।
ঠাকুরের ‘অভাগা’ হওয়ারও একই ধারা, লিডারদের সঙ্গে সেই অদ্ভুত কনভারসেশনে, যেখানে আপনি শ্রোতার চাইতে বেশি কিছু হইতে পারবেন না, সেটায় রাজি না হইলে, লিডারই উল্টা ‘অভাগা‘ বোধ করবেন। হা হা।
উইকিপিডিয়াতে দেখলাম, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীরও এই গানটা খুব প্রিয় ছিল। আমার মনে হয়, গান্ধীর এই পছন্দের পিছনে ওইটাই মূল কারণ। অর্থাৎ পিপলের মনে লিডারের ‘ডাক শোনা’র ব্যাপারে একটা সাধারণ মনোভাব তৈরি করা। মানে লিডার ডাক দিবেন আর আপনি ঝাপ দিবেন, সেইভাবে আপনাকে স্বাভাবিক কইরা তোলা। এবং একই সঙ্গে সমাজের তুলনায় ‘বড়’ ও ‘বিশেষ’ অবস্থায় একজন কারোর আবির্ভূত হওয়ার মধ্য দিয়াই, বা যাকে আমরা লিডার হিসেবে বুঝি শুধু তার বোঝবুদ্ধির ভিতর দিয়াই আমাদের বিবিধ মুক্তির পথ উন্মুক্ত করা।
বিষয় হইলো, যুগে যুগে ঠাকুর, জমিদার ও লিডারদের তরফে এইসব প্রোপাগাণ্ডা চলছেই। সেটাকে আমরা স্বাভাবিকভাবেই দেখি ও দেখবো। এবং এইসব লিডারদের মাধ্যমে যে কিছু ভাত-কর্য-রুটি আমরা গরিবেরা পাই না, সেরকমও না। পাইয়া বরং তার কৃতজ্ঞতাও আমরা স্বীকার করি। কিন্তু আমার দিক থেকে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, লিডারের ‘ডাক’ যখন গরিব শুনবে না, সেই অবস্থাটা। আমি মনে করি, লিডারের ডাক ফিরাইয়া দেওয়াই বরং বেশি পলিটিকাল, এই দুনিয়ায় আমাদের যার যার পথ চলার প্রেক্ষিতে। জমিদারি স্বভাবের যে কোন ডাকের ব্যাপারে, আজকে ও পরবর্তী দিনে, আমরা গরিবেরা যতো ক্রিটিকাল হইয়া উঠবো, আমাদের মুক্তির পথ ততো সহজ হবে।
ভুল বুঝবেন না, লিডার আপনাকে ডাকবে তার স্বার্থেই। এবং তার ‘একলা চলা’ কোন অস্বাভাবিক কিছু না, যার ফলে আপনার গিল্টি খাওয়ার কিছু থাকতে পারে। লিডার বা জমিদার বা অন্য যে কেউ যে এই পৃথিবীতে ‘একলা’ চলবেন, সেটা আপনার ও আমার মতোই স্বাভাবিক বাস্তবতা। এর চেয়ে বেশি কিছু না। বরং, যখন আপনি লিডারের ‘একলা চলা’কে বিশেষভাবে মণ্ডিত হইতে দিবেন, তখনই লিডার একনায়কতন্ত্রের দিকে পা বাড়ায়। এই ব্যাপারে সচেতন থাকুন।
লেখক: কবি