লোকে আমাকে `শিক্ষিত` মনে করে কেন, বুঝি না

নূরুননবী শান্ত

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০২০

আমার রাগ আছে। মানুষের সাধারণ সীমাবদ্ধতা হলো, সে কাছের মানুষদের উপর রাগ ঝাড়ে। আমিও। এদিকে আমি তো শিক্ষাদীক্ষায় দ্বিতীয় প্রজন্ম। মানে, আমার বাপ-জ্যাঠার একজন মেট্টিক আরেকজন বিএ। দাদা-দাদি ভূমিহীন দিনমজুর। খাঁটি দিনমজুর বংশ আমি। তো, এই জাতের বাঙালির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা ভালোবাসাও ব্যক্ত করে অশ্লীলভাবে। মানে, সভ্য যারা তাদের সংজ্ঞানুসারে অশ্লীল। হুমায়ুন আজাদ গরিবদের সৌন্দর্য কবিতায় এইটা কিছুটা বলছেন। এদিকে ইলিয়াস ঢাকাইয়া কুট্টিদের ভাষা নিয়ে বলতে গিয়েও বলছেন এইরকম যে `চুতমারানী গেলি কই হালায়?` বলে হাঁক দেবার মানে হইলো, চুতমারানীরে সে আসলে মিস করতেছে! আর রেগে গেলে তো কথা নাই। আদর করে `খানকির পুত` বলা লোকেরা রাগলে নিশ্চয় `সোনা` বলবে না।

তো, আমার এইরকম ব্যাপার আছে। জন্মের পর থেকে ‘শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, চোদে না তোকে’ গালি তিনটা আমার আসে। আমার চেহারা, তথাকথিত শিক্ষা, শিল্পবোধ সব উপচায়া এই গালি আমি সুন্দর পারি। রাগলে চিৎকার করার যে রীতি, সেটাসমেত পুরা প্রেজেন্টেশন নারকীয় করে তুলি আর কি। সাথে হাতের কাছে ভাঙা যায় এমন কিছু পাইলে ভাঙি বা ভাঙার উদ্দেশ্যে ছুরে মারি মাটির দিকে। হুঁশহারা হয়ে মারিও। মানে পেটাই আর কি। এর ফলে, আমার শেষপর্যন্ত কাছের মানুষ বলে কেউ থাকে না। অথচ দূরের মানুষ এগুলা বিশ্বাস করবে না! ভাববে আমি ভুল বকতেছি! কিন্তু বিশ্বাস করেন, ভালোবাসা কম পাইলে বা না পাইলেই খালি এই তথাকথিত অসভ্য ঘটনা আমি ঘটাই।

ধরেন, প্রেমিকা ৫টায় দেখা করার কথা, কিন্তু করলো সাড়ে ৫টায়; বা ৬টায় জানা গেলো যে সে শপিং করতেছে, দেখা করবে না! আমি চিৎকার করতে থাকি, শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, তোরে চুদি না! গোপনে আমি স্বপ্ন দেখতেও পারি না যেহেতু, এইরকম গালিগুলি ফলে তারাও শোনে যারা প্রেমিকা না, যাদের কোনোদিন গালি তো দূরের কথা উপদেশ দিয়ে পর্যন্ত বিব্রত করি না। তো, গালাগালি যেহেতু সমাজে অশ্লীল, সেই তারা, যাদের সাথে একবারও গলা তুলে কথা বলতে আমার বুক চিনচিন করে। বুঝতে পারি, আমাকে অপছন্দ করে। ঘৃণা করে আসলে। এবং আমার থেকেও অশ্লীলভাবে আমাকে আক্রমণ করে। সামান্য দূরের হিসেবে কেবল প্রেমই যাদের দিছি, সেই তারাও। এবং আমার প্রেমিকারে গালি দিলাম জন্য তারা আমারে `শিক্ষিত` বলে গাইল পারে। সেটাও দিনমজুর বংশের লোক হিসেবে আমার সমস্যা না। সমস্যা হলো, লোকে আমাকে `শিক্ষিত` মনে করে কেন সেটাই আমি বুঝতে পারি না!

আমি ক্ষুদ্র হবার সাধনা করি। ভদ্রতাকে চুদি। অপমানবোধ আমার থাকার কোনো কারণ নাই। মান বিসর্জন দিয়ে বিলীন হবার দিকেই আমার অনন্ত যাত্রা। কারে বোঝাই, মানুষ হিসেবে গর্ব করার কিছু নাই। সম্মানিত হতে চাওয়া হাস্যকর। বরং নিষিদ্ধ-প্রিয়তার আদিপাপ মোচনের পরিতাপ বিনে মানুষের আর কোনো কাজ নাই। সমস্যা এটাও যে, আমার ক্ষুধা লাগে খুব। আর খাবার দেখলেই বমি আসে। চট করে সুস্থতা হারায়ে ফেলি। প্রেমিকা ছাড়া ঘুমাতে পারি না। ভয়াবহ সাইকো স্টেটে আমার বসবাস। প্রেমিকা মানে সেই ‘শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, তোকে চুদি না’ জন। ফলে অপরিচয় ধারণ করার প্রচেষ্টা আমার ব্যর্থ হইতে থাকে। প্রেমটাই আসল বাধা হয়ে ওঠে এলিমিনেশনের রাস্তায় হাঁটার! এলিমিনেশন মানে ইশ্বরের কাছাকাছি হওয়া। এক ও অদ্বিতীয়। `প্রেম` একটা খাঁচা। `মায়া` এক অশেষ জেলখানা। এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে? আমি একটানা কানতেছি। পুঁজি, সম্পদ আর মায়ার দুনিয়ায় কানতে থাকার মতো অশ্লীল ঘটনা আর কিছু নাই। ব্ল্যাক আউট!

লেখক: কথাসাহিত্যিক