শশী হকের গদ্য ‘গল্প থেকে দুনিয়া’

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২২

এই যে মানুষেরা এত সহজে দুনিয়াটার একচ্ছত্র দখল নিতে পারলো, তা এক বিস্ময়কর কাহিনিই বটে। না, জ্ঞান এই কাজের জন্য  যথেষ্ট ছিল না। এর জন্য যে প্রধান শর্ত, লার্জ স্কেলে যূথবদ্ধ এবং সংযোজিত হতে পারা, সেটা মানুষের পক্ষে ঘটানো সম্ভব হয়েছিল কেবল বিশ্বাসযোগ্য অসাধারণ সব কল্পগল্প সৃষ্টি করতে পারার গুণে। আর, তারপর, বিশ্বাস-মাধুর্যে সেই কল্পগল্পগুলি fictional reality সত্য ও সুন্দরে রূপায়িত হয়ে তৈরি করতে থাকে মানব ঐক্যের ক্লাসিক স্ট্রাকচার।

পৌরাণিক টোটেম এবং আদি পেগানিজম ছিল তেমনই এক সেট লাগসই ফিকশন, বা, ঐক্যশক্তিকে নিজের আইডেনটিটি বলে ভাবতে পারার কমন স্প্রিচুয়াল স্পেস। এরপর রিলিজিয়ন এই গল্পটাকেই ইউনিভার্সাল করে দিয়ে সমস্ত মানুষকে একটা মহাগল্পের ভিতর বাঁধতে চাইল, যার নাম মানব জাতি। ইজিপশিয়ান, সুমেরীয়, বৈদিক বা  মায়ান-এজটেক এই বিশাল সভ্যতাগুলি যে রহস্যময় শক্তির কারণে অই পর্যায়ে যেতে পেরেছিল, তার উৎস, কল্পাবেগের যুথবদ্ধ ফিকশনাল রিয়েলিটি ছাড়া আসলে আর কিছুই নয়। তাই পিরামিড-জ্ঞান যতটা না শক্তিশালী তারচে অনেক বেশি শক্তিশালী তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটা জাতির গল্প।

মানুষ রহস্যময়, কারণ সে কল্পনা করতে পারে। সে কল্পনার আশায় বাঁচে, আবার কল্পনার কাছেই মরে যায়। অন্যদিকে গল্পই যেন তার প্যাশন, নেশা। মানব-জাতি নামের এক মহাগল্পের ভিতর তাই গড়ে ওঠে আরো গল্প, গল্পের পর গল্প, যেন শেষ নাই। আমাদের পরিবার, রাষ্ট্র, জাতিসত্তা, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি সবই আসলে মানুষের সেই অসাধারণ কল্পগল্পের এক একটা এল্পাইড ফর্ম,  যার ভিতর ঝকমকায় এক সাধের দুনিয়া। এই গল্পগুলি আমরা বিশ্বাস করি, সত্য ভাবি, এমনকি তার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকি। এইসব গল্পের শক্তি অসীম।

কিন্তু ব্যাক্তি মানুষের সবচেয়ে বড় না-পাওয়া হচ্ছে, সে নিজের গল্প নিজের মতো করে তৈরি করতে পারে না। হয়তো সেটা সে চায়ও না, বা অই পারাটা যেন সেই পাগলামি, যাকে সে ভয় পায়। মানব জাতির মহান আর বিপুল গল্পের বিস্ময়কর বিজয় তাকে সুরক্ষার এমন এক স্বাচ্ছন্দ্যে বন্দি রাখে, যেখানে প্রাণের বিন্দু বিন্দু গল্পগুলির পাগলামি স্বচ্ছ বাবলের মতো জানালা দিয়ে বাইরে উড়ে যায়। আর এটুকুতেই যেন সে খুশি। কারণ সে মানব জাতির অংশ হতে পেরেছে, এবং নিজেকে ভাবতে পারছে আশরাফুল মাখলুকাত।

লেখক: কবি