শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০২২

মিনিট দশেক ধরে চোখের দু’পাতা জোর করে বন্ধ করে আছে অরণ্য। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রী এই সময়টা যেন শেষ হয় না। জোর করে তাকে শুয়ে থাকতে হয়। চোখ একটু মেললেই মায়ের চোখের কটমটানি দেখতে হবে। বিকেল আসতে এত দেরি হয় কেন, অরণ্য ভেবে পায় না। আর দুপুরের পর ঘুমোতেই বা হবে কেন? সারারাত মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। আবার দুপুরে খেয়ে ঘুমানো কেন? এ সময়টা সে বারান্দায় বসে নিচের বস্তির ছেলেমেয়েদের খেলা দেখতে পারতো। কিম্বা কাগজ দিয়ে একটা প্লেন বানাতে পারতো। প্লেন বানানো তাকে বাবা শিখিয়েছে। কাগজ দিয়ে সে নৌকাও বানাতে পারে। বাবা যখন বানাতো দেখে সে অবাক হতো আর বাবাকে সে সুপারম্যানের আসনে বসিয়ে দিত।

যেদিন সে প্রথম বানাতে শিখলো, সেদিন তার সে কী আনন্দ! পৃথিবীটা আসলে অনেক সুন্দর। কত কিছু করা যায় পৃথিবীতে। বড় হয়ে সে পাইলট আর ফাস্টফুডের দোকানের কর্মচারী হবে। প্লেন চালাতে তার ভালো লাগে। ভালো লাগে আইসক্রীম আর দোকানের কল থেকে পড়া কোল্ড ড্রিংকস খেতে। যখন সে খাবারের দোকানে চাকরি করবে, চুরি করে সে ওইসব খেতে পারবে। আচ্ছা, চুরি করা নাকি গুনাহ? গুনাহ মানে কী? যা করলে আল্লাহ রেগে যায়। আল্লাহ কোথায় থাকে? অরণ্যের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো জয়া। বিছানায় ঝাপ দিয়ে সে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরলো। ওরে আমার টুনটুনি, ভুনভুনি, কুনকুনি সোনা আব্বুটা... তোকে ছেড়ে আমি এতদিন কোথায় ছিলাম রে!

এই জয়া খালামনিটাকে তার ভালো লেগে গেছে। সে যেদিন থেকে এ বাসায় এসেছে বাসাটা যেন আনন্দে ভরে গেছে। ভরে গেছে অরণ্যের ছোট্ট হৃদয়টা। খেলা করার একটা মানুষ পাওয়া গেল। বাবা সারাদিন বই পড়ে আর খাতায় কী সব লেখালেখি করে। বাবার স্কুলের হোমওয়ার্ক হবে। এই হোমওয়ার্ক জিনিসটাও তার ভীষণ পচা লাগে। লেখাপড়াটাই বা কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলো? তার সঙ্গে দেখা হলে অরণ্য তাকে এমন মার মারবে যে, সে তার বাবার নামই ভুলে যাবে। আর যে খেলা আবিষ্কার করলো তার সঙ্গে দেখা হলে অরণ্য তার গোপন জায়গায় জমিয়ে রাখা চকোলেট থেকে একটা চকোলেট দেবে।

রায়া মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে জয়াকে বললো, তোর দুলাভাই সেদিন জিজ্ঞেস করছিল তুই খুলনা থেকে একা এসেছিস কিনা।
তুমি কী বললে?
বলেছি, বাবা এসে দিয়ে চলে গেছেন।
কেন মিথ্যে বললে?
তো কী বলবো? তুই একা এসেছিস, তাই বলবো?
আমিতো একা আসিনি আপা। আমরা পাচ ফ্রেন্ড একসঙ্গে আসছি। রোমেল, বান্টি, অনিক, শুভ আর আমি।
এই চারটা ছেলে র সংগে তুই একটা মেয়ে মানুষ এলি?
কী সব ব্যাকডেটেড কথাবার্তা বলছ আপা। উই আর ফ্রেন্ডস এন্ড উই হ্যাভ আ মিউজিক্যাল ব্যান্ড।

রায়া কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে রইলো জয়ার দিকে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জয়ার আপাদমস্তক একবার নতুন করে দেখে নিল। কিশোরী জয়া তারুণ্যের শুরুতেই নিজেকে বদলে ফেলেছে সময়ের নীল স্রোতে গা ভাসিয়ে। কালো রংয়ের আটসাট ক্যাপ্রির ওপর সে পিংক টপটি চাপিয়েছে। ডান হাতে কালো আর পিংক কাঠের বালা আর গাছিক হাবিজাবি মিলিয়ে কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত ছেয়ে আছে। বাঁ হাতে ছেলেদের মতো বড় সাইজের ঘড়ি। কানে ঝোলানো গোলাকৃতি বস্তটিকে দুল না বলে চুড়িই বলা যায়। চোখের ওপর ভ্রুতে একটি ছোট্ট বলের মতো লাগানো। ঠোঁটের নিচেই ছিদ্র করে একই রকম আরেকটি বল চকচক করছে রুপোলি আভা ছড়িয়ে। মসৃণ চুলগুলো সোনালি আর বারগেন্ডি রং ছড়িয়ে পুরো লুকটাকে গর্জিয়াস করে দিয়েছে।

রায়া অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। সে ঢাকা শহরে থেকেও এতখানি আধুনিক হতে পারেনি। সুহৃদের আগমনে রায়ার ভাবনায় ছেদ পড়ে। পিঠের নিচে একটা বালিশ নিয়ে আরাম করে বসে সুহৃদ। তারপর জয়া, কোন সাবজেক্ট পড়তে চাও?
ভাইয়া, আমার পছন্দ ফ্যাশন ডিজাইনিং।
ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ে কী করবে?
ফ্যাশন ডিজাইনার হবো।
ভালো। সময়োপযোগী বিষয়। আসলে জয়া যেই জিনিসে তোমার কোনো আগ্রহ নেই সেই বিষয়ে পড়াই ঠিক না। যে বিষয়ে তোমার দুর্বলতা আছে, মমতা আছে সে বিষয়কে সঙ্গী করলে সফল তুমি হবেই। গুড, ভেরি গুড।

রায়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, লেকচার একটু কম কম দেন। আপনার তো কবিতায় দুর্বলতা। কবিতা আপনাকে কী সফলতা দিয়েছে? দু`চারটে লিটল ম্যাগাজিনে গাছিক কবিতা ছাপা হয়েছে কেবল। একটা কবিতার বইও তো তোমার বের হয়নি।

সুহৃদের কেমন জানি কাশি পেল। একটু বিব্রত অথচ শিমুল মোস্তফার মতো জাঁদরেল কণ্ঠে বললো, দেখো সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটলে হবে না। শিল্পের পেছনে ছুটতে হবে। শিল্পকে ভালোবাসা চাই। তো জয়া, ঠিক আছে ফর্ম টর্ম কোথা থেকে কী আনতে হবে চলো আমার সঙ্গে কাল পরশু।

তোমার সঙ্গে যাওয়া লাগবে কেন? ও একাই পারবে। ও অনেক স্মার্ট মেয়ে। আর এটা দু’হাজার দশ সাল। গরগর করতে করতে বেরিয়ে গেল রায়া। তার আজকাল অকারণেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আবার অকারণেই মন ভালো হচ্ছে। চলবে