শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২৩

রায়ার বুকটা দুরু দুরু করে কাঁপছে। গ্রীন রোড থেকে রিকশা এখন ডান দিকে ছয় নম্বর রোডে ঢুকছে। রায়ার গন্তব্য সাতাশ নাম্বার। সেখানে অপেক্ষা করছে ইকবাল। রাস্তার পাশের আবর্জনার উৎকট গন্ধে রায়া মুখে আঁচল চাপা দিল। এই শাড়িটা তাকে ইকবাল দিয়েছে। আজই প্রথম পরলো। আবর্জনার স্তুপের পাশেই যানজটের কবলে রিকশা এখন স্থবির। খোলা ডাস্টবিনের পাশেই আমগাছের গুড়িতে নির্লিপ্ত ভংগিতে বসে আছে একজন লোক। তার বসার ভংগিটি অসম্ভব কেতাদুরস্ত। পরনের শার্ট আর প্যান্টের প্রকৃত রং যে কী, তা বোঝা মুশকিল কয়েক মণ ময়লার ভারে। ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল আর কতক লম্বা দাড়ি দেখে ঠাওর হয়, যেন এইমাত্র লোকটি ধুলোর সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে। মুখে বিড়বিড় করে কী যেন সে বলে যাচ্ছে। চোখের চাহনিটি বসার ভংগির মতো কেতাদুরস্ত। এমন বুঝমান স্মার্ট লুকিং পাগল সচরাচর চোখে পড়ে না। উৎসুক মানুষের মতো রায়াও কিছুক্ষণ তাকায় তার দিকে।

 

কী এত ভাবে তারা! কোথায় তাদের জগৎ! আহারে, এরও নিশ্চয়ই কোনোদিন সংসার ছিল। মায়ার একটা বাধন ছিল। মাথা খারাপ হওয়ায় বোধহয় সংসারে আর জায়গা হয়নি। রায়া চোখ সরিয়ে মনে পাঠিয়ে দেয়। চোখ এখন মনে, সামনের সব দৃশ্য তাই ঝাপসা হয়ে যায়। ছোট ছোট দুশ্চিন্তাগুলোকে ভেবে ভেবে সেগুলোকে আরও বড় করে তোলে। অরণ্যের কোনো অসুবিধা হবে না তো। সুহৃদ অবশ্য তাকে যথেষ্ট টেককেয়ার করে। দুপুরে সুহৃদ কলেজ থেকে ফিরলে রায়া আগেই জানিয়ে রাখে বিকেলে যেন সুহৃদ বাসায় থাকে। সে আজ গাউছিয়া যাবে। ওখানে ভিড়ের মধ্যে অরণ্যকে নেয়া যাবে না। সময় কত দ্রুত চলে যায়। এই তো মাত্র কয়েক মাস আগেই দেখা হলো ইকবালের সাথে। প্রথম দেখাতেই রায়া তার প্রেমে পড়েনি। তবে মুগ্ধতা একটু ছিল বৈকি। দিনে দিনে ইকবালের যাতায়াত অবাধ হয়েছিল তাদের বাসায়। উপলক্ষ অবশ্য জয়াই ছিল। দুজন যাতে দুজনকে বুঝতে পারে সেজন্য রায়া তখন অনেক সুযোগ করে দিয়েছে।

 

হয়তো দুজনকে একসংগে বাইরে ঘুরতে পাঠিয়েছে বাহানা করে। নয়তো কখনো সখনো একটু নিরিবিলি নিভৃতে কথা বলারও সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু ঠিকঠাক আয়োজন করে যে প্রেম হয় না, সে রায়া বুঝেছিল জয়ার নিমরাজি ভাব দেখে। সে এখনই বিয়ে করবে না। তার অনেক স্বপ্ন। ব্যান্ডের সিডি বের হবে। পরিচিতি আসবে, তারকা বনে যাবে। বিয়ে করলেই কি আর এসব হবে। শুনে রায়া কিন্তু মোটেও গোস্বা হয়নি বরং খুশি হয়েছিল। কারণ ততদিনে যে ইকবাল সিধ কেটে তার ভেতরটা চুরমার করতে শুরু করেছে কী এক বাঁধভাঙা জোয়ারে।

 

সুহৃদ বন্দিনী রায়া চায়নি শিকল ভাঙতে। কিংবা ভাঙা যে যায়, সে কল্পনাও করেনি। তাতে কি? কখনো সখনো মানুষ যা অবাস্তব মনে করে তাও তো বাস্তব হয়ে যায়। ইকবাল সুচতুর লোক। রায়াকে আকাশের চাঁদ মনে করেনি সে। সুহৃদের টানাপোড়েনে চলা মধ্যবিত্ত সংসারের ছিরি দেখেই বুঝে নিয়েছিল, রায়ার দুর্বল জায়গাগুলো। কথায় কথায় সরু চোখ বুঝে নিয়েছিল সুহৃদের অনুপস্থিতি ক্ষণ। সে মোক্ষম ক্ষণে দামি উপহার দিয়ে তাকে চমকে দিতে ভোলেনি। ভোলেনি উপহার দেয়ার ছলে রায়ার শবরি কলার মতো আঙুলগুলো বেখেয়ালি ভঙ্গিতে একটু ছুঁয়ে দিতে। তাতে রায়া কিছু মনে করেনি। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই অন্যমনস্ক ছিল। কিন্তু বারবার এমন অন্যমনস্ক ভুলে রায়া বুঝে নেয় তার মনোবাঞ্ছা। সেই সঙ্গে নিজের নবজাগরিত পুলক অনুভব। সুহৃদের সংগে নিজ অভাবজনিত খিটিমিটিতে এ পুলক অনুভব যেন নতুন পত্রপল্লবে ডালপালা শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হয়। রায়া আর ফিরতে পারে না কিংবা ফিরতে চায় না। এখানে পৌঁছে ফেরা যায় না, শুধু চলা যায়।

 

সাতাশ নম্বরে পৌঁছে ইকবালের বলে দেয়া রেস্তোরাঁটি খুজে পেতে কিছু সময় লাগলো রায়ার। কপোত-কপোতির জন্য নির্মাণকৃত খোপ মতো জায়গায় মুখোমুখি তারা। সামনে খাবারের পসরা সাজানো। চিকেন নাগেটস, দই ফুচকা, অরেঞ্জ জুস। ইন্টেরিয়ার ডিজাইনের থিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালিয়ানাকে। বেতের নিজস্ব শীতলতায় চকচক করছে চেয়ার-টেবিল। দেয়ালে বাঁশ দিয়ে আনা হয়েছে লোকজ চেহারা। মাঝে মাঝে ঝুলে আছে তালপাতার হাতপাখা। ঝাড়বাতির বদলে হারিকেন লণ্ঠন ঝুলছে। শিকেয় ঝুলছে মাটির হাঁড়ি। কোণে বড় পটারিতে রঙিন পাটকাঠি। একপাশে দেয়ালে প্রশস্ত এলসিডিতে চলমান ক্লাব ফুটবল।

 

ইকবাল বলল, খাচ্ছ না যে?
কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। মাথা নিচু করে জানালো রায়া। এরা কফি ভালো বানায়। কফি খেতে পারি।

 

আর কোনো কথা নেই। কোথা থেকে যেন এক প্রকার নিস্তব্ধতা এসে ভর করল। এখানে এই নিষিদ্ধ বিকেলে। ইকবাল পলকহীন চেয়ে আছে রায়াতে। রায়া আর করে কী, দৃষ্টি দিয়েই শোধ করে দেয় অনন্তকালের এই চেয়ে থাকা।

 

শোনো, এভাবে আর দেখা করা যাবে না। নীরবতা ভাঙে রায়া।
কেন ভয় লাগে?
সুহৃদ যদি টের পায়! তাছাড়া তুমি তো বাসায় আসো। দেখা তো হচ্ছে আমাদের।
আমি সুহৃদের সামনে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকবো তোমার দিকে?
এত কি দেখো?
তোমার মুখপানে চেয়ে কেবল কাটিয়ে দিতে পারি আরো পঁয়ত্রিশ বছর।
কাব্য হচ্ছে, না?
ওহো, কবি পত্নীর সঙ্গে তো কাব্য করা ঠিক না। ভুল চুক হয়ে গেলে... আচ্ছা সুহৃদটা এখনো আঁতেলই রয়ে গেল। ও কি করতো জানো? আমরা যখন সবাই মানজা মারতাম সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে, গাধাটা তখনও কালো লেদারের একটা ফাইল বগলে করে কবি লেখক গবেষক স্যারদের পেছনে ছুটতো। লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া ওর কবিতা দেখাত স্যারদের। আমরা এলিফ্যান্ট রোডে বব মারলে খুঁজতাম, ও চলে যেত নীলক্ষেত। কবিতার মতো সুন্দর ভাষা দিয়ে বলতো, দাদা, জগদীশ গুপ্ত হবে কিংবা শৈলজানন্দ? কল্লোল যুগের লেখকদের কী কী বই পাওয়া যাবে, হা হা হা। তবে ভালো কামাই রোজগার কিছু করতে পারুক আর না পারুক, নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে সুহৃদ। তোমার সুখি হওয়া উচিত।

 

এই কথার পর রায়ার একটু লজ্জাই হলো। কামাই রোজগারের খোটাটা কি আলপিন হয়ে বিঁধলো বুকে? সুহৃদকে এখন সে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক, বসবাসের দীর্ঘসূত্রতায় বেড়ে যাওয়া মমতার ওজন কিছু কম নয়। ধোঁয়া ওড়া কফির মগে চুমুক দিয়ে রায়া বলল, আমি উঠবো।
সে কি, গাড়িতে করে আশুলিয়া যাব নৌকায় ঘুরবো।
আজ না, আরেকদিন।
একটু যেন বিষণ্ণ মন নিয়েই উঠে দাঁড়ালো রায়া।
একটু দাঁড়াও, ব্যস্ত হয়ে ইকবাল পকেট থেকে ছোট্ট জিনিসটা বের করে রায়ের হাতে দিল।
কি এটা?
বাসায় গিয়ে দেখো।
জিনিসটা ব্যাগে ভরে বেরিয়ে এলো ওরা। বাইরে তখন দু`এক ফোটা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে একটা রিকশায় চাপতেই আকাশ ভেঙে নামলো তুমুল বৃষ্টি। রায়ার ভেতরের কান্নাগুলো বুক ভেঙে নামলো চোখে। সে নিজেকে সামলানো না। সামলানোর প্রয়োজনও নেই। আকাশ আর চোখের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে বাড়ি পৌঁছাল। চলবে