শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’

পর্ব ৭

প্রকাশিত : মার্চ ২৫, ২০২৩

ভাদ্র মাস। প্রকৃতির মেজাজ এখনও খানিক খিটখিটে। সে তার ভ্যাপসা ভাদ্র তাপের কারণেই। রায়া সকালের দিকে গোসল সেরে নেয়। তবুও অরণ্যকে ঘুম পাড়াতে এসে এই মধ্যদুপুরে তার যেন গায়ে একটা জ্বালা জ্বালা ভাব শুরু হলো। একটা ফ্রেশ গোসল দিলে এই জ্বালা ভাব চলে যাবে। বাসাটা এখন অনেক সুনসান। সুহৃদ কলেজে। জয়াও বাইরে। অরণ্য ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত হতেই রায়া আধশোয়া অবস্থা থেকে পা টানটান করে পুরোপুরি শুয়ে পড়ল। হাত দিয়ে জানালার পর্দাটা একটুখানি সরিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করল দিগন্তবিস্তৃত আকাশের পানে। তার শোবার ঘর থেকে আকাশটা বেশ ভালোরকম দেখা যায়। পাশের বিল্ডিংগুলো ঘেঁষে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটা নারকেল গাছ। তার সবুজ চেরা পাতাগুলো মৃদু মৃদু দুলে চলে বাতাসে। যেন একজন পূর্ণবয়স্ক নারী এলোচুলে দাঁড়িয়ে আছে।

 

রায়া চোখ বুজে ইকবালের কথা ভাবতে লাগলো কল্পনার আনন্দে বিভোর হয়ে। ঝিমুনির মতো আসার আগে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। মোবাইলের ছোট রঙিন পর্দায় ইকরা নাম ভেসে উঠতেই শিহরিত ও আনন্দিত রায়া ফোনটা নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। ইকরা আসলে ইকবাল। নামের প্রথম অংশ নিয়ে মেয়েদের নাম সংরক্ষণ করা। যাতে সুহৃদকে অনায়াসেই বান্ধবী বলে চালিয়ে দেয়া যায়।
হ্যালো, কি করছো তুমি?
কিছু না। মৃদুস্বরে বলল রায়া।
গুড। একটু বাইরে আসতে পারবে?
কেন?
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
তাই বলে এখন?
কেন, সুহৃদ কি বাসায়?
না। জয়াও ক্লাসে। আর অরণ্য ঘুমিয়ে পড়েছে।

 

ওয়াও। তুমি জলদি করে একটু নেমে আসো না সোনাটা। ইকবালের কণ্ঠে আহ্লাদ ঝরে পড়ে।
তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? অরণ্যকে বাসায় একা রেখে আসবো?
আচ্ছা ওতো ঘুমাচ্ছে, তাই না? ও ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই তুমি আবার চলে যেও। প্লিজ আমার আজ বার্থডে, একটুকু রাখবে না।
তুমি কোথায়?
ভূতের গলি। তোমার বাসার সামনেই গাড়িতে বসে আছি।
এক কাজ করো, বাসায় চলে আসো।
না, আমি আসবো না। তুমি একটু আসো না, প্লিজ। গাড়ি করে একটু ঘুরে আবার নামিয়ে দিয়ে যাব তোমাকে। প্লিজ, আজকের দিনটা তুমি আমার পাশে কাটাবে না? আমি কত প্ল্যান করেছি। আমি সকাল থেকে কিছুই খাইনি তোমার সঙ্গে খাব বলে। আর তুমি এখন আসবা না? বুঝছি, শুধু আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি একটুও বাসোন না। ইকবাল যেন একটু গাল ফোলালো।

 

খানিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলনায় চেপে হঠাৎই রায়া বেপরোয়া কণ্ঠে বলল, আচ্ছা দাঁড়াও। কিন্তু আমি যখনই বলব তুমি তখনই আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
ওকে থ্যাংক ইউ মাই লাভ।
দড়াম করে গাড়ির দরজা লাগিয়ে ইকবাল বলল, তুমি আমার ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকো, আমি যখন বলব তখন খুলবে।
রায়া সুবোধ বালিকার মতো তা-ই করল।
খুব মাতাল করা একটা ম ম ঘ্রাণে নাক ডুবে যাচ্ছে। সেটা ইকবালের শার্ট থেকে নাকি গাড়ির এয়ার ফ্রেশনার থেকে রায়া ঠাওর করতে পারে না। তার ভেতরকার বিবেকবান নারীমূর্তির অবিরাম চোখ-রাঙানিতে এতক্ষণ যে খচখচানি অনুভব করছিল সে, তা এখন একটু একটু করে দূর হয়ে যাচ্ছে সিডি প্লেয়ারে নুসরাত ফতেহ আলির সুরের সঙ্গে। বিলাসী ভোগী নারীমূর্তির অবিচল চেতনায় সস্তা বিবেকমূর্তি মূর্ছা যায়।

 

চোখ খোলো।
ইকবালের আদুরে কণ্ঠে প্রায় ঘুমন্ত রায়া জেগে ওঠে।
বেশ ছোটখাটো একটা চোখের বিশ্রাম শেষে চার দিকে তাকিয়ে জায়গাটা ঠাহর করতে ব্যস্ত হলো সে। কারওয়ান বাজার। একেবারে সোনারগাঁও হোটেলের গাড়ি পার্কিং। ইকবালের হাত ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে সুইমিংপুলের পাশে গিয়ে ঝরনা রেস্তোরাঁয় বসলো। আহা, এতদিন সে শুধু এই পাঁচ তারকা রাস্তা থেকেই শুরু চোখে দেখেছে। আর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কপালকে দোষারোপ করে মেনে নিয়েছে। ওসব জায়গায় কি আর ইহজনমে পা রাখা হবে। শুধু ওসব জায়গা কেন, একটা সস্তা দেশি খাবারের রেস্তোরাঁয়ও কখনো সুহৃদ তাকে নিয়ে যায় না। দু’তিনটে ডালপুরি খাওয়াতে হলেও যে তার দশটা টাকা চলে যাবে মাইনে থেকে। বেশ হয়েছে। সুহৃদের জন্য এটাই উপযুক্ত শিক্ষা। সে এমন অভিজাত পরিবেশে বসে অভিজাত খাবার খাচ্ছে, এটা সুহৃদকে দেখাতে পারলে মন্দ হতো না।

 

না-না, তা যেন কখনোই না হয়। কখনোই না। পেট পুরে খাওয়া শেষে তেল চকচকে মসৃণ আভিজাত্য পেরিয়ে ইকবালের বগলদাবা হয়ে রায়া পৌঁছে গেল নয়নাভিরাম সুইটে। মজাদার সব রেসিপির কল্যাণে খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে। ধবধবে সাদা বিছানাটি দেখে গা এলিয়ে দিতে মন চাইল। রায়া মুগ্ধ নয়নে কক্ষটি দেখেই চলেছে। কয়েক পরত আরামদায়ক ম্যাট্রেসে মোড়া ঝকঝকে বিছানাটি এ কক্ষের মধ্যমনি হয়ে চিত হয়ে আছে। দুপাশে সাইড টেবিলে একই রকম সাদা ল্যাম্পশেড মায়াবী আলো দিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের একোন ওকোন মিলিয়ে আরও পাঁচ-ছয়টা ল্যাম্পশেড বাহুল্য না হয়ে মানানসই ভঙ্গিতে যে যার জায়গায় আছে। খাট সোজা দেয়ালে বিশাল এলসিডি। তারই নিচে শুকনো কাঠের তাকে চিনা পটারি, দু-একটি শোপিস। পিতলের চকচকে টবে সযত্নে প্রতিপালিত ইনডোর প্লান্ট ঘরের অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে ব্যস্ত। একপাশে গদিওয়ালা দামি সোফা। কুশনগুলো পর্যায়ক্রমে সাজানো।

 

রায়ার মুগ্ধ চোখ দেখে ইকবাল বললো, আমাদের বেডরুম এর চেয়েও সুন্দর হবে।
রায়া প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে রইল ইকবালের মুখে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না, ইকবাল কি বলতে চাইছে। ইকবাল যেন ওর চোখের ভাষা বুঝে নিল। হ্যা রায়া, আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে। তুমি পারবে না সবকিছু ছেড়েছুড়ে শুধু আমার কাছে আসতে। আমি নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বলো না তুমি পারবে না আমার জন্য...

 

রায়া যেন ইকবালের কথাতেই চিন্তায় মজলো। সেকি পারবে? পরিবেশ-পরিস্থিতি আর তার নিয়ন্ত্রনহীন অবাধ মন তাকে ইকবালের এত কাছে টেনে এনেছে। সে আজ ইকবালকে ভালোবাসে। এটাই সত্যি। ইকবালকে ভাবলে তার মন আনন্দে চনমনে হয়ে ওঠে। সুহৃদ এখন তার মন বা মস্তিষ্কের ঠিক কোন জায়গায় অবস্থিত, রায়া তা আর এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে চায় না। পালিয়ে থাকতে চায় এই রূঢ় বাস্তবতা থেকে। ভালইতো যাচ্ছে তার দিনগুলো ইকবালের সঙ্গে। লুকোচুরি করে দেখা করার স্বাদটা কিশোরের প্রথম নিটোল প্রেমের মতোই মিষ্টি। রায়া এই নিষিদ্ধ জোছনায় নিজেকে একাকার করে ফেলেছে এক অবাধ আনন্দযাত্রায়। কিন্তু তাই বলে বিয়ে? তার সংসার আছে। সন্তান আছে। অরণ্য। ও মাই গড... অরণ্য!

 

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তার মাথাটা ভোঁ করে উঠল। অরণ্যকে সে তালা মেরে এসেছে। এই এতক্ষণ পর তার এই কথাটি মনে পড়ল। চলবে