শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগলবন্দিনী’

পর্ব ৮

প্রকাশিত : মে ০৭, ২০২৩

তখনও বিকেল জমেনি। দুপুরের রোদ গেছে ঘুমাতে। অরণ্যের ভাতঘুম অবশ্য ছুটে গেছে ছাদে যাওয়ার অমোঘ আকর্ষণে। চোখ কচলে পাশ ফিরে বোঝে, মা তাকে ঘুম পাড়িয়ে অন্য ঘরে গেছে। সেই অন্য ঘরটা যে অদূরে পাঁচ তারকা হোটেলের অভিজাত কক্ষ, অরণ্যের তা বোঝার কথা নয়। তবে খানিক বাদেই সে ঘরের আনাচ-কানাচ খুঁজে খুঁজে আবিষ্কার করে, সদর দরজায় মস্ত এক তালা। আর এই তালাবদ্ধ বাড়িটায় সে ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। এই আবিষ্কারের অনুভূতি তার ছোট্ট শরীরটা কাঁপতে থাকে অজানা অবারিত ভয়ে।

 

নিজের অজান্তেই গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকে মা-মা স্বরে। আজ কী কেয়ামতের দিন? সেই দিন নাকি ভীষণ ভয়ঙ্কর হবে। মা তাকে রেখে কোথায় গেল? বাবা এখনো আসে না কেন? জয়া খালামণি কেউ একজন আসুক। যদি আর কেউ কোনোদিন না আসে তখন সে একা একা বাড়িটাতে কি করবে? কি খাবে? কার কাছে ঘুমাবে? কার সঙ্গে কথা বলবে? সত্যিই কি আর কেউ আসবে না? এই ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতায় সে কি করে একা থাকবে? হয়তো সে মরেই যাবে। যদি ভূত আসে? ভূত বলে নাকি কিছু নেই। তাহলে ভূত নাম কিভাবে হলো?

 

যে জিনিস নেই সেই জিনিসের আবার নাম হয় নাকি? সব বড় মানুষ আসলে বোকা। ভূত আছে। এই একটু পরে আসবে। আর তাকে একা পেয়ে তার ঘাড় থেকে রক্ত চুষে খাবে। ওগুলোকে ড্রাকুলা বলে। জয়া খালামণি বলেছে। অবশ্য একটা রসুনের মালা কিংবা এক কোয়া রসুন রাখলে নাকি ড্রাকুলারা কাছে আসে না। সে কি এখন রসুন খুঁজবে? অরণ্য আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল। তার জামাটা ভিজে জপজপ। বুকের সঙ্গে দুই হাত দিয়ে সজোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল সে। পাশের বাসাগুলোতেও কি কেউ নেই? কেউ কেন তার কান্না শুনে দৌড়ে আসছে না? মানুষগুলো এত পচা কেন?

 

তাদের বাসায় কোনো ল্যান্ডফোন নেই যে বাবাকে ফোন করবে। সবার মোবাইল আছে অথচ তার একটা মোবাইল নেই। তার একটা মোবাইল থাকলে এখন সে মাকে ফোন দিতে পারত। কিভাবে নাম্বার টিপে ফোন করতে হয় অরণ্য তা জানে। মোবাইলে সে ভালো গেমসও খেলতে পারে। বাবা আজ বাসায় এলে তাকে বলতে হবে, যেন অবশ্যই তার জন্য একটা মোবাইল কেনা হয়। কিন্তু বাবা কখন আসবে নাকি আর কখনোই কেউ আসবে না! অরণ্য বিছানায় ঝাপ দিয়ে হুহু করে কাঁদতে থাকল। পৃথিবীটা এত ভয়ঙ্কর একটা জায়গা সে আগে কোনোদিন বোঝেনি। সে এই পৃথিবীতে আর থাকবে না। অন্য আরেকটা পৃথিবীতে চলে যাবে স্পেসশিপে চড়ে। সে পৃথিবীতে কোনো ভয় নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। শুধু আনন্দ আর আনন্দ।

 

রায়া যে হলুদ রঙের চেয়ারটায় বসে আছে তার সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে লাগানো চেয়ারগুলোতে বসে আছে আরও জনাদশেক মানুষ। সবার মুখই বিষণ্ণ। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তবে তার কেবলই পাশে তিনজন মানুষ বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে গল্পগুজব করে এই বিরক্তিকর সময়টাকে জমিয়ে তুলেছে। দুজন মাঝবয়সী পুরুষ অন্যজন পঞ্চাশোর্ধ শেষ যৌবনা নারী। মাথায় সযত্নে আটসাট করে বাধা হেজাব। ছাগলের জাবর কাটার মতো অনবরত পান চিবিয়ে কথা বলছে। সে-ই এই আসরের মধ্যমনি।

 

আপনার মা`র কি হয়েছে বললেন?
হার্টের সমস্যা। মাঝবয়সী লোকটি জবাব দেয়।
এইটা বিরাট খারাপ রোগ।
এর প্রথম উপসর্গই হইল মৃত্যু বোচ্ছেন। দেখেন দেখেন দেখছেন হাসপাতালে মানুষ এমন পোষাক পইরা আসে? অদুরের চিকন চাকন মেয়েটির দিকে আঙুল তুলে বলে মহিলা। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের হিজাবটা মাথায় হাত দিয়ে পরিপাটি করতে ব্যস্ত হয় পাছে না বেরিয়ে পড়ে চুল। এদিকে অনেকক্ষণ ধরে যে তার ওড়না যথাস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে বেখেয়ালে সে খেয়াল তার না থাকলেও ছিদ্রান্বেষী চোখ দুটো দিয়ে অন্যের খেয়ালে অভিজ্ঞ বটে।

 

বোচ্ছেন ভাই, রাস্তায় আজকালকার মাইয়াগুলানের দিকে তাকাবেন ওযু থাকলে ওযু ছুইটা যাইব, এমন বেহায়া লেবাস পরে থাকে। মরণের ভয় নাই ওগো। ব্যাটাছেলেগো মতো জিন্সের প্যান্ট পড়বো আর ওপরে পরব বাচ্চা মাইয়াগো মতো ফ্রক। শুনেন ভাই, মহিলা তর্জনী উঁচিয়ে বলে, মাইয়া মানুষ যদি ব্যাটাছেলে গো লেবাস পরে সেই মাইয়ার ওপর সরাসরি আল্লাহর লানত। আর যদি ব্যাটাছেলে মাইয়াগো পোশাক পরে কিংবা ধরেন মাইয়াগো মতো লম্বা চুল রাখে সেই ব্যাটা ছেলের ওপর আল্লাহর সরাসরি লানত।

 

রায়া উঠে গিয়ে একটুখানি হাঁটাহাঁটি করে আবার এসে বসলো চেয়ারে। ভেতরে গাইনি ডাক্তার বিপদমুক্ত করছেন জয়াকে। রায়ার মাথাটা একটুখানি ধরে এসেছে। ঘুরেফিরে তার সেই দিনের সেই কথাগুলো মনে পড়ছে। জয়া কি পরিমাণ বখে গেছে, সেটা সেদিনই বুঝল সে।

 

আপা তুমি আমাকে কিছু টাকা লোন দিতে পারবে?
কত টাকা লাগবে?
এই ধরো লাখ দুয়েক।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এত টাকা আমি কোত্থেকে পাব? আর তুইবা এত টাকা দিয়ে কি করবি?
আমরা তো বুঝছো খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছি ব্যান্ডটাকে ফর্ম করার জন্য। ওখানে শো-টো ভালই হয়। কিন্তু ব্যান্ডের অ্যালবাম বের করতে হলে একটু লাইম লাইটে আসতে হলে ঢাকা ইজ দা বেস্ট। আমরা চিন্তা করছি, প্রথমে অ্যালবাম বের করব। তারপর টিভি থেকে এমনি ডাক আসবে।
ভালো কথা, বের কর অ্যালবাম। রায়া নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে।
বললেই তো আর হবে না। আমরা কিছু গান রেডি করেছি, কথা সুর হয়েছে। কম্পোজিশন করতে হলে তো স্টুডিও ভাড়া করতে হবে। টাকা লাগবে বুঝছো। আবার আরেকটা জিনিসও ভেবেছি, আমরা নিজেরা কম্পোজিশন না করলে স্টুডিও ভাড়া করার ঝামেলা নেই। সেক্ষেত্রে ধরো আমি কোনো মিউজিসিয়ানকে দিয়ে কম্পোজিশন করালাম। এই যেমন ধরো আইয়ুব বাচ্চু বা ফুয়াদকে দিয়ে। তাহলে শুধু ওনাদের পেমেন্টটা দিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। কিন্তু উনাদের পেমেন্ট অনেক। দ্যাটস হোয়াই টাকাটা খুব দরকার।

 

তোদের ব্যান্ডের লিডার কে?
রোমেল।
তুই তো শুধু ভোকাল। তাহলে তোর মাথায় সব চিন্তা কেন?
আহা, তুমি বুঝতে পারছ না, অ্যালবাম বের হলে পরিচিতি আসলে শুধু আমারই আসবে। মানুষ শুধু ভোকালকেই চেনে। পেছনে দাঁড়িয়ে কে কী বাজালো, মানুষের কিছু এসে যায় না। এই পর্যায়ে এসে জয়া হঠাৎ দুচোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরল। বসা থেকে গা এলিয়ে শোবার চেষ্টা করে আবার হুড়মুড়িয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাথরুম থেকে জয়ার বমি করার আওয়াজ পেল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এক কুৎসিত সন্দেহে রায়ার করোটিতে ভনভন করে ঘুরতে থাকে। অবশেষে নিভৃতে পেয়ে সে মনের কথাটি বলেই বসে। তোর পিরিওড হয়েছে শেষ কবে?

 

জয়া আতঙ্ক আর অবাক চোখে তাকায়। মুহূর্তে সামলে নিয়ে বলে এ প্রশ্ন করছ কেন?
কেন করছি তা তুই ভালো করেই জানিস।
ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করে জয়া। এরকম পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়লে চলবে না। সে এমন কিছু অন্যায় করেনি। আজকাল এসব কোনো ব্যাপারই না। একজন গাইনি ডাক্তারের কাছে গেলেই ঝামেলা মিটে যাবে। সে কথা মুখে বলার আগেই রায়া বলল, চল কালই আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাবি। কিন্তু তার আগে বল, ছেলেটা কে?
জয়া নিরুত্তর।
রোমেল?
নীরবতা।
শুভ?
আবার নীরবতা। রায়া এবার ঠাস করে মারল চড়। বলছিস না কেন?
বলব না মরে গেলেও বলবো না।
কেন বলবি না? ছেলে যদি ভাল হয় আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করব।
আজব! কিসের বিয়ে? আমি এখন বিয়ে করলে তো?
তাহলে প্রেম করলি কেন?
প্রেম করিনি। জয়ের চোখমুখ অসম্ভব শক্ত দেখাচ্ছে। একহাত কোমরে রেখে আরেক হাত দিয়ে চুল সরাতে ব্যস্ত।
প্রেম করিসনি তাহলে এসব?
আচ্ছা, প্রেম করলেই এসব হয়। এমনি হতে পারে না?
পারে। প্রস্টিটিউটদের বেলায় হতে পারে।
বাজে বকো না।

 

পাশের চেয়ারে লোক দুটো এখন কেবিনে চলে গেছে তাদের রোগীদের কাছে। হেজাবওয়ালী ফাকা চেয়ার দুটোতে হাত পা ছড়িয়ে বসেছে। তার চোখ বন্ধ। খানিকবাদে ঠোঁট দুটি ঈষৎ ফাঁক হয়ে মৃদু ঘড়ত ঘড়ত শব্দ তুলছে। বসে থাকতে থাকতে রায়ার খিদে পেয়ে গেছে। কিন্তু এই ক্লিনিকে ছোট্ট একটি কফি ঘর ছাড়া কোন খাবার জায়গা নেই। কফি ঘরের কথা মনে হতেই কফি নামক উপকারী মোহিনী বস্তুটি মস্তিষ্কের বিশেষ স্থানে সংকেত পাঠায়।

 

এক মগ কফি এখন না হলেই নয়। রায়া কফি ঘরের দিকে পা চালায়। অরণ্যকে সে সুহৃদের কাছে রেখে এসে এই কর্ম সারতে এসেছে। মাথায় তার অজস্র প্রশ্নবোধক চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান। কে বান্টি? না ছেলেটা কালো কুচকুচে জয়ার রুচি ভালো। অনিক? নাহ! চশমার পুরু কাচের আড়াল থেকেও তার নিষ্পাপ চোখ দুটো ভেসে ওঠে। হঠাৎ আকাশ থেকে বজ্র পড়ে হৃদপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ বহুমাত্রায় জেগে ওঠে। রক্তচাপ নেমে গিয়ে হাত-পা যেন শিথিল হয়ে আসে। সুহৃদ নয় তো? চলবে