শিমুল বাশারের আত্মগদ্য ‘আমি আমারেই দেখি’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৪, ২০২০

লালমাটিয়ার সবুজ গাছগুলোতে তখন থোকা থোকা ছায়া ধরা আবছা আন্ধার কালো। মধ্যরাতের নির্জনতায় রাস্তায় আরাম করে কুয়াশা নামছে। আমার আলতো নিবিড় কোলে ঝর্নাদির স্নিগ্ধ মুখমণ্ডল উতলা হয়ে আছে যেন! ছাতিম ফুটেছে কোথাও। সুন্দর গন্ধ! এমন গন্ধের রাতে আমাকে ঘুমপাড়াতে নানি বলতো, পরি আছে আশপাশে, ঘেরান পাও? তোমারে দূর ফলের দ্যাশে নিয়া যাইবো।
 
এইসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখের পাপড়িতে হালকা হালকা শীত জমা হয়। কুড়ায়ে পাওয়া কাঁসার বালতির হাতল কাইটা বানানো আমার শৈশবের খেলনা রিংটা হঠাৎ গড়ায়ে নেমে যায় পাশের ডোবায়। ডুবাতে ডুবাতে চক্ষু লাল করি। সারাদিন ডোবার পাশে বইসা ওই খেলনা রিংয়ের জন্য কান্দি আমি! তারপর একটা সফল শীতের অপেক্ষা বুকে নিয়ে আমি এতদূর লালমাটিয়ায় চলে আসছি!

দিনে দিনে এতবড় হইছি যে, নিজের আঙুল ফসকায়ে এখন নিজের হাত থেকেই পড়ে যাচ্ছি। ক্রিমসন কাপের পাশে যে মেয়েটা রোজ বেলুন কেনার জন্য অনুযোগ করে, আজ তার হাতে শাপলা ফুল দেখে ২০ টাকায় কিনে নিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কুকুরের বাচ্চাঅলা বাড়িটার সামনে আইসা দাঁড়াইলাম চুপে। একসময় আকাশ থিকা চাবিসহ একটা রশি নাইমা আইলো।

একটা হট্কা গিট্টু দিয়া শাপলা দুইটারে বাইন্ধা দিয়া আবার হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি আপুর বাসা ছাড়ায়ে কিছুদূর আগাইতেই বরিশাইল্যার দোকান। দোকানটা দেখার পরই বুকের ভিত্রে ছ্যাঁত কইরা ওঠছে। মনে পড়ল, আজ তার জন্য কোনো সিগারেট কেনা হয়নি। পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে হেমন্ত কুড়ানোর সুখ আঁৎকা একটা রিকশা কাইরা নিয়া গেছে আজকে।

পথের ভেজা ধুলায় হাত বুলাতে বুলাতে এই মধ্যরাতে আমি আর কোনোদিন সিগারেট খাব না, এ বিশ্বাস পোক্ত করতে করতে আগায়ে যাই। প্রতি পদে পদে আমি আমারেই দেখি। বেঙ্গলের ভেতর পড়ার টেবিলে বইয়ের পাতায় সোফি যেমন একটা খাম খুইলা চিঠি পড়ে, আমিও তেমন একটা চিঠি পাই। চিঠিতে একটা মাত্র লাইন, ‘তুমি কে?’ বান্দরবনের ব্যোম রাজা জুমলিয়ান দাদার কথা মনে পড়ে। তার মতো আমিও আজ কমলার কোষ চুষতে চুষতে কোথাও যাওয়া দরকার বলে ঘরে ফিরা যামু ঠিক, সিগারেট আর খামু না।

বারান্দায় বইসা চিৎকার কইরা গান গামু, আই এম ইউ এন্ড হোয়াট আই সি ইজ মি।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী