শিমুল বাশারের আত্মগদ্য ‘আয়নার আলো-ছায়ার খেলা’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২১

বেঁচে থাকতে গিয়ে পৃথিবীতে অচেনা মানুষেরা ধীরে ধীরে চেনা মানুষ হয়। প্রতিদিনই অসংখ্য নতুন মুখ দেখি... কিছু মুখ আমাদের মনের আয়নায় থেকে যায় চিরকাল। চাইলেই তাদের দেখতে পাই। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, কখনো বিষণ্ণ, কখনো আবার প্রসন্ন। সে আয়নার আলো-ছায়ার অপরূপ খেলা চলে সারাক্ষণ। হয়তো আমারই মুখের ছায়া তাদের মুখের ছবিতে দেখি। অনেকটা ‘আই এম ইউ অ্যান্ড হোয়াট আই সি ইজ মি’ গানটার মতো। তবে সে আয়নাটায় কিন্তু বেশিরভাগ মুখেরই জায়গা হয় না। কোন মুখের কি রূপ, কি লাবণ্য তা আমাদের কাছে চিরদিনের জন্য অজানা থেকে যায়।

সন্ধ্যায় রবীন্দ্র সরোবরে যাই। টুকটুকে লাল কার্ডিগান পরে প্রাক্তন আসে। আমরা ধীরে দৌড় শুরু করি। দৌড়াই, আড়চোখে তার মুখের রূপ দেখি। কিছু সময় পর ক্লান্ত হয়ে সে হাঁপাতে থাকে। তার বুক জোরে জোরে ওঠানামা করে। সে আমার অনিমেষ তাকিয়ে থাকা দেখে মৃদু মৃদু হাসে। আমি দৌড়াতেই থাকি। সে আমার পেছনে পড়ে যায় কিংবা আমি থাকি তার পেছনে। কিছুতেই আমরা দুজন পাশাপাশি দৌড়াতে পারি না। আলম সাহেবের একান্ত বাগানের কাছে যে পথটা দুভাগ হয়ে গেছে, বিভ্রান্তিকর সে জায়গাটায় এসে আমরা দুজন দুদিকে চলে যাই। ওই পথে তারে একা রেখে সচেতনে আমি হারিয়ে যাই। এরপর মাহমুদ আর মেথিকে কল দিয়ে মঞ্চের কাছে এসে আয়েশ করে বসে অস্বাস্থ্যকর পায়েশ চা খাই।

মধ্যরাতে বৃষ্টি আপুর বাসার সামনের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে যে ঘরে ঘর নাই সেদিকেই ফিরে যেতে থাকি। সেদিন লামিয়া টেক্সট দিয়ে জানিয়েছে, জানুয়ারির ১৫ তারিখে বৃষ্টি আপুর বিয়ে। আমাকে চশমার ফ্রেম পাল্টাতে অনুরোধ জানায় লামিয়া। আমি লামিয়াকে বলি, অল্প ভেঙেছে, তুমি চিন্তা কইরো না, অতটুকু ভাঙায় আমার পথ চলতে অসুবিধা হবে না।

লালমাটিয়া ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বরিশাইল্যার দোকান পরে। দোকানটা দেখে মাহমুদকে বললাম, চলো মাহমুদ, বরিশাইল্যারে ধইরা মারি। ভাইঙা চুইরা হালারপুতের দোকানডা তছনছ কইরা দেই।
মাহমুদ হাসতে হাসতে জানতে চায়, কেন ভাই, কি হইছে?
আমি বলি, এই হালারই সব দোষ!
মাহমুদ বলে, না ভাই, সব দোষ চান্দের!

আমি চাঁদের দিকে তাকাই। আমার বুকের ভেতর থেকে ধারালো নখযুক্ত একজোড়া হাত বের হয়ে আসে গোপনে। সে হাতে চাঁদটারে আমি টান মেরে আকাশ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসি বুকের খুব কাছে। খামচাতে খামচাতে চাঁদের গাল রক্তান্ত করতে করতে লালমাটিয়ার নির্জন পথ ধরে এগিয়ে যাই। হঠাৎ করে শহরের বিদ্যুৎ চলে যায়। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায় আমাদের চারপাশ। অন্ধকারের গহনতার ভেতর আমার হাত থেকে তাজা লাল রক্ত জ্বলজ্বল করে ফোঁটায় ফোঁটায় চুঁইয়ে পড়তে থাকে মাটিতে। আমি ভয়ে দৌড়াতে থাকি। আমার পেছন পেছন যেন মাহমুদ নয়, আরেকটা আমি ছুটছে। আমি তারে কিছুতেই দোষ দিতে পারি না।

গাবতলীতে এসে দক্ষিণের একটা ছুটন্ত বাসে চেপে বসি। বাসের চটচটে সিট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামতে থাকে। অস্থির হয়ে আমি এদিক সেদিক তাকাই। জানালা ধরে যেদিকে চোখ রাখি সেদিকেই রক্ত ছিটকে যেতে থাকে। আমি কাউকেই দোষ দিতে পারি না।

অপরাধ করে আমাদের মন নিজের দোষটা স্বীকার করতে চায় না কোনোদিন। অবচেতন মনও তখন যুক্তি খুঁজতে থাকে নিজের পক্ষে এবং বেরও করে ফ্যালে। নিজের পক্ষে যুক্তি না পেলে বড়জোড় ভাবতে থাকে, সে পরিস্থিতির শিকার। ওই পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে না গেলে হয়তো অপরাধটা সে করতো না! এসব ক্ষেত্রে কারো ওপর দোষ চাপাতে পারলে আমাদের মনে কিছুটা শান্তি আসে। তাই দোষ সব বরিশাইল্যার দোকানের। বীথি আপু বলে, এইটাই সবচেয়ে বড় দোষ যে, তার ওপর কোনো দোষ চাপানো যাচ্ছে না।

আমি বীথি আপুকে বলি, বীথি আপু, রক্ত ক্লেদের দীর্ঘ ক্লান্তিকর পথ হেঁটে এসে আমি তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। বাস্তবতা না বোঝার মতো অর্বাচীন আমি নই। তবু নিজের জন্য একটা ভুল করতে পারার স্বাধীনতার জন্য আমি সারারাত ধরে কাঁদি।

নিখুঁত এক শিষ্টাচার দেখিয়ে সে চলে যায় দূরে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী