শিমুল বাশারের গদ্য ‘এবং আমার নাম শিমুল’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১

মাটি যত ঊষর হয়, শিকড় তত গভীরে প্রোথিত হয়। বিরহী ফেব্রুয়ারির এক ভোরে আমি বৃক্ষের কথা ভাবি। বেডরুমে লাগোয়া গ্লাস সরিয়ে বারান্দাটাকে একেবারে উদোম করে জুড়ে দেই আমার শরীরের সাথে। শহুরে দোয়েল, চড়ুই, কাক আর গাড়ির হর্ণের সম্মিলিত একটা নিরেট শব্দের ভেতর ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকি।

দূরে ও কাছে বেশকিছু বৃক্ষ দেখা যায়। বৃক্ষদের শিকড় আকাশের দিকে ছড়ায় না। শুরুতে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবেই প্রধানমূল নিচের দিকে ধাবিত হয়, তবে খুব বেশিদূর নয়। সাধারণত এক মিটারের মধ্যেই সীমিত থাকে। এর কারণ, শিকড় যত গভীরে যেতে থাকে মাটি ততই কঠিন ও দুর্ভেদ্য হতে থাকে।

গভীরে গেলে অক্সিজেন ও জল দুটোরই অভাব হয়। পুষ্টির সন্ধানে তখন শিকড়গুলো চারপাশেই ছড়াতে থাকে। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর একেক জায়গার মাটি একেক রকম, প্রতিটি ইকোসিস্টেমের মাটিই ভিন্ন। প্রতিটি প্রেম যেমন ভিন্ন।

মেরু তন্দ্রায় হিমজমাট মৃত্তিকার উপরও শিকড়ের বিস্তার ঘটতে পারে আর শুষ্ক মরুতে শিকড় বালির ভেতর শতফুট গভীরেও চলে যায়। অক্সিজেন ও জলের সরবরাহ না থাকলে শিকড় সেদিকে প্রবাহিত হয় না, হতে পারে না। মাটির গভীরে জলের গতি যেহেতু কমতে থাকে সেহেতু শিকড়কেই বের হতে হয় জলের সন্ধানে।

যে জলে যত বেশি পুষ্টি মিশে থাকে, শিকড় সেদিকেই বিস্তৃত হতে থাকে। শিকড় স্বভাবগতভাবেই সুবিধাবাদী, এরা পাথরের ফাটলে, অপেক্ষাকৃত নরম মাটির ভেতরে পুরনো শিকড়ের চ্যানেল ধরেই প্রবাহিত হতে চায়। অভিযোজন হেতু শিকড়ের নানাবিধ রূপান্তর ঘটতে পারে যেমন অস্থানিকমূল, বায়বীয়মূল, চোষকমূল, ঠেসমূল, অধিমূল, শ্বাসমূল এবং আমার নাম শিমুল।

ভোরের দোর খুলে একটু একটু রোদ বৃক্ষদের গায়ে লাগতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। ঘুম ভাঙার পর সাবার সাথে কথা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসি। ফাল্গুনের হাওয়া লাগছে গায়ে। বীথি আপু বলে, ফেব্রুয়ারি মাসটা নাকি তার খুব খারাপ যায়! আমি চুপ করে থাকি। চা খাবার ছলে নিজের আবেগ লুকাই আর ভাবি, ফেব্রুয়ারিতে আদাবরে ঢুকতে গেলে প্রধান সড়কের মুখেই আপনাকে স্বাগত জানাবে ফুলে ফুলে ভরা ছোট্ট একটা শিমুল গাছ।

জানা যায়, মালয়, দক্ষিণ চীন, হংকং এবং তাইওয়ানে শিমুল গাছ চাষের প্রচলন ছিল। চীনের ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ বলছে, ন্যাম ইউয়েতের রাজা চিউ তো খ্রিস্টের জন্মের দুশো বছর আগে চীনের হ্যান শাসনামলে সে সময়ের সম্রাটকে এ গাছ উপহার দিয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় একে শাল্মলিও বলা হয়। পাতাঝরা বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ এটি, উচ্চতা খুব বেশি নয়। শাখা-প্রশাখাগুলো কাণ্ডের চারপাশে সুবিন্যস্ত। কঠিন পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য এই শাখা প্রশাখাগুলোই তার বন্ধু হিসেবে কাজ করে। আমারও বন্ধু সংখ্যা নগণ্য।

জেনেছি, শিমুলের ছাল ঘা সারাতে খুব কাজে দেয়। যারা এ সত্য টের পেয়েছে তারা ছাল চামড়া তুলে নিতে একটুও দ্বিধা করে না। তবে এ বৃক্ষের গাজুড়ে অনেক কাঁটা আছে। গোড়াটা মজবুত এবং বেশ পুরু। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কাঁটা কমে। আমারও বয়স হচ্ছে। বীথি আপু, ছাল চামড়া আমারও তুলে নিয়ে গেছে অনেকে। শীতে সব পাতা ঝরে, ফাল্গুনে শিমুল ফুল ফোটে। দিগন্ত লাল আগুন সময় এখন। অবহেলা আর অনাদরে এ সময়টায় পথের ধুলায় লুটাতে থাকবে লাল লাল ফুল। আহা, ফুলেদের রাজ্যে এক গাঢ় ভুলের মতো শিমুল!

ঝরতে ঝরতে মোচাকৃতি সব ফলের অপেক্ষায় আছি। চৈত্র, বৈশাখ আসুক দেখবেন, ফল ফেটে উড়ে বেড়াবো হাওয়ায় হাওয়ায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী