শিমুল বাশারের গদ্য ‘ঘরে ফেরার আগে’

প্রকাশিত : নভেম্বর ৩০, ২০২০

প্রান্তরে ঢলে পড়া রোদে মৃদু হাসি লেগে থাকে। প্রজাপতি ওড়ে কিংবা তখন আমাদের মনে হতে পারে প্রজাপতি নাচে। একটা বৃত্তের ভেতরে পুরোটা বিকেল শুধুই লালনীল বেলুন ওড়ে। তারপর আমাদের শহরে নিয়ম করে অতল সন্ধ্যা নেমে আসে। দারুচিনি আর লবঙ্গ দিয়ে হাঁড়িভাঙা আখগুড়ের এক কাপ চা এনে দিলে মাহমুদ সেই চা খেতে খেতে হয়তো নুসরাতের কথাই ভাবে কিংবা ভাবে না, হয়তো আমাদেরই আজকাল এমন মনে হয়। হয়তো আমরাই নুসরাতকে আর ভুলতে পারি না!

অঘ্রানের সবচেয়ে ম্লান সন্ধ্যাটা বিড়ালের মতো তখন হয়তো মাহমুদের হৃদয়ে ঢুকে যায়। বুকটা ভার হয়ে এলে নিজেকে আড়াল করতে মাহমুদ ব্যালকুনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে অসংখ্য টবের জঙ্গলের পাশে কামিনী ফুটতে শুরু করেছে। মাহমুদের ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে নীল অপরাজিতা লতা বেয়ে অগ্রাণের চাঁদটা ধীরে নেমে আসে ব্যালকনিতে। সে মোবাইল বের করে চাঁদের একটা ছবি তোলে, সাথে সাথে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে দেয়।

আমরা ঘর থেকে বের হই। কমলার কোষ আর বাদাম খেতে খেতে সলিমুল্লাহ রোডে গিয়ে চেয়ার পেতে বসি, আড্ডা দেই। মধুপুরের চুনিয়া গ্রামে মান্দিদের আপ্যায়ন সংস্কৃতির গল্প বলি। বেঙ্গলে যাই। তন্বীর জন্য অপেক্ষা করি। বীথি আসে, খুব অচেনা লাগে! তার পাশে সুদর্শন ছেলেটা অহংকার নিয়ে বসে থাকে। আমরা পরস্পর পরস্পরের সাথে কথা বলি। অহংকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। বীথি চুপ করে থাকে। আসলে জগতের প্রতিটি মানুষই নিজের কাছে খুব দামি। শুধু আমি এক পায়ের একটা পায়েল হয়ে কোথায় যেন নীরবে জড়ায়ে থাকি।

রাতও বাড়তে থাকে। বঞ্চনার কথা বলি, বিয়োগ ব্যথা বাড়তে থাকে। একে একে বিদায় নেয় সবাই। আমার প্রায়ান্ধ মা দূরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সাহস দেয়, সুখে থাকো! বাবা কবে চলে গেছেন আরো দূরে! তারপর আমরা কজন পথের ধুলায় লুটপাট হতে হতে লালমাটিয়ার আঁধারে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ভার ভাগাভাগি করবো বলে বিধ্বস্ত পিঁপড়ার কাঁধে আলতো হাত রাখি। জীবনের বাঁকে বাঁকে জমানো রোদ, ছায়া চিকমিকে গ্লানি আমাদের চোখের তারায় গলতে থাকে।

ঘরে ফেরার আগে মুঠো ভরা স্নিগ্ধ প্রজাপতি দল ছেড়ে দিয়ে আসি তার আকুল পিঠে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী