শিমুল সালাহ্উদ্দিন

শিমুল সালাহ্উদ্দিন

শিমুল সালাহ্উদ্দিনের গদ্য ‘বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে’

প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০২১

বাংলা ভাষায় আমরা বিদ্যা ও বুদ্ধিকে যুক্ত করে বিদ্যাবুদ্ধি বলি, বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিজীবী হন নিজেদের ওই বিদ্যাবুদ্ধির কারণেই। তাদের বিদ্যা থাকে, থাকতেই হবে, নইলে বুদ্ধিজীবী কিভাবে?

বিদ্যা হলো অধ্যায়ন বা শিক্ষার মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান, পুস্তক পাঠ থেকে আসে, আড্ডা থেকে আসে, জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আসে। এ বিদ্যারই অপর নাম জ্ঞান। কিন্তু শুধু বিদ্যাই কী মানুষকে বুদ্ধিজীবী করে?

তা নয়। বিদ্বান মাত্রই বুদ্ধিজীবী হন না, যদিও বুদ্ধিজীবী মাত্রই তাকে বিদ্বান হতেই হবে। বিদ্বানরা পণ্ডিত হন, দক্ষ হন, পেশাজীবী হন, বিশেষজ্ঞও হয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু এসব হওয়া আর বুদ্ধিজীবী হওয়াটা কিন্তু এক ব্যাপার না।

বুদ্ধিজীবী হওয়ার জন্য আবশ্যক আরো কিছু করা, আর সেটা হচ্ছে সমাজের কল্যাণে বুদ্ধির প্রয়োগ। বিদ্যা ও বুদ্ধি উভয়ের প্রয়োগ থাকা চাই, এই দুই শক্তি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে; বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে এ সম্পর্কটা দাঁড়ায় দ্বান্দ্বিক। এক্ষেত্রে যা প্রত্যাশিত তা হলো, বিদ্যা ও বুদ্ধি একটি দ্বন্দ্বে যুক্ত থাকবে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়বে, কিন্তু কেউ কাউকে ধ্বংস করবে না, এমনকি তাড়িয়েও দেবে না, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উভয়ের সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

বুদ্ধিজীবীর জন্য বুদ্ধির প্রয়োগটাই প্রধান কাজ হওয়ার কথা। বুদ্ধির সাহায্যে পৃথিবীকে তাঁরা ব্যখ্যা করবেন—এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র কাজ নয়। অপরিহার্য থাকে আরেকটি কাজ, সেটা হলো পৃথিবীটাকে বদলানো। অন্যায় অনাচার সুবিধাবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করা, তার অসম্পূর্ণতাকে মেনে না নেওয়া এবং তাকে বদলানোর বুদ্ধি দেয়াও বুদ্ধিজীবীর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

এসব কাজ একা করা যায় না, বুদ্ধিজীবী সেটা নিজের ভেতর থেকেই জানেন এবং জানেন বলেই বুদ্ধিজীবী হন। বুদ্ধিজীবী সংগ্রহ করেন, তিনি বিজ্ঞ; কিন্তু যা সংগ্রহ করেন তাকে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনে ও অভিভাবকত্বে নতুন করে তোলেন। তিনি ফ্যানসিফুল মানে সার্কাস্টিক নন, তিনি ইমাজেনিটিভ, কল্পনাপ্রবণ। এবং তিনি হৃদয়বানও। হৃদয়বান না হলে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এবং যুক্ত হয়ে পৃথিবীটাকে বদলানোর প্রেরণাটা পাবেন কোথা থেকে? আসলে কোনো বুদ্ধিজীবীই বুদ্ধিজীবী নন, যদি তিনি হৃদয়বান না হন। দ্বন্দ্ব থাকে বুদ্ধি এবং হৃদয়ের ভেতরও। এ কারণেই কবিরা বুদ্ধিজীবী। তারা স্বপ্ন দেখান।

একসময় ছিল যখন বুদ্ধিজীবীদের কাজটা দার্শনিকরা করতেন। তারা প্রশ্ন করতেন, ব্যখ্যা করতেন, লক্ষ্য থাকত প্রতিষ্ঠিত মতকে বদলানোর। দার্শনিকরা তখন বিজ্ঞানীর দায়ভারটাও নিতেন। তারপর বিভাজন এসেছে। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের অভিন্নতাটা ভেঙে গেছে; বৈজ্ঞানিকরা শক্তিশালী হয়েছেন, দার্শনিকরা কিছুটা পিছু হটেছেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের বিচ্ছিন্নতার এই জায়গাটায় ডাক পড়েছে বুদ্ধিজীবীর, তারা বিজ্ঞানমনস্ক, কিন্তু বিশেষজ্ঞ নন এবং তারা প্রশ্ন করেন। সেটা ভাববিলাসের জন্য নয়, দার্শনিকভাবে বোঝার ও বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে বদলানোর জন্য।

অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীর কাজ প্রশ্ন করা। কোনো প্রশ্ন এই রাষ্ট্র এই সমাজ নিতে পারে কী না সে যাচাইয়ের ভার অবশ্য আপনার। এই যাচাইটি করতে পারলে আপনি বুঝবেন, কেন এই সমাজ বুদ্ধিজীবীহীন, কেন এই সমাজ প্রশ্নহীন।

বুদ্ধির মুক্তি ঘটুক। বুদ্ধিজীবীর কোনো দল নাই, গণমানুষ তার দল। মানুষের অধিকারের কথাই তার একমাত্র শ্লোগান। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই তার কাজ। আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ বুদ্ধিজীবীর বলবার জায়গা তৈরি করা। তার বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তর্কের জায়গা তৈরি করা। আমাদের রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ এ জায়গাতেই।

লেখক: কবি