শিল্প তো কান্নারই প্রতিচ্ছবি

কামরুল আহসান

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২০

চোখের পানির হয়তো নানারকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। চোখের পানি পড়ে অসুখে, চোখে পানি আসে সুখে। চোখে যদি পানি জমে না থাকতো তাহলে চোখ শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যেত। মাঝে মাঝে নাকি চোখ দিয়ে এম্নিতেই পানি পড়া ভালো, তাতে গ্রন্থি ভালো থাকে। আবার কান্না ছাড়া খালি খালি পানি পড়লে নাকি খারাপ। এক সময় চোখ একেবারে শুকিয়ে যায়, তখন জ্বালাপোড়া করে।

কেন আসে চোখে পানি! অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে চোখই একমাত্র সজীব, জীবন্ত, বাইরে থেকে এর ভিতরটা পর্যন্ত দেখা যায়। আদিতে হয়তো ধুলো-ময়লা দূর করার জন্যই চোখে পানি আসতো, সে এক নিছক শারীরিক ক্রিয়া। কিন্তু কান্নার অশ্রু তো ভিন্ন রকম! মানুষ কাঁদতে শিখলো কবে? মানুষ ছাড়া আর কোনো পশু-পাখি কি কাঁদে! মাছের চোখে কি অশ্রু আছে! শুনেছি গাছও নাকি কাঁদে। মানুষ কাঁদে গোপন ব্যথায়, গাছ কাঁদে কোন বেদনায়!

ছোটবেলায় ওয়াজে শুনেছি, আল্লাহ নাকি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন মানুষের কান্না। হুজুররা মোনাজাত ধরে বলতেন, কাঁদেন, কাঁদেন, কাঁদলে মাপ পাবেন। এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেন, এক ফোঁটা চোখের পানির কারণে মাপ হয়ে যাবে সারাজীবনের গোনা।

কাঁদলে আত্মা শুদ্ধ হয়। কাঁদে তো সে যার হৃদয় পবিত্র। কাঁদলে মন কাদামাটির মতো নরম হয়ে যায়। কাঁদতে জানতেন আমার নানি। নানি আসলেও কাঁদতেন, গেলেও কাঁদতেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটা গল্প আছে, না কান্দে বুবু। বুবু আসলেও কাঁদে, গেলেও কাঁদে। একদিন বুবু আর কান্দে না। আমি জিগাই, ও বুবু, কান্দো না ক্যান! বুবু আর কান্দে না।

কান্নার চেয়ে ভয়ঙ্কর তো গুমড়ে মরা। এমনও তো হয় মানুষের, বুক ফেটে যায়, কিন্তু, কান্না আসে না। কার যেন এক গল্প আছে, এক মায়ের সন্তান মারা গেছে। মা কাঁদতেও পারে না। কেবল বোবার মতো বসে থাকে। তার আরো সন্তান আছে। তাদের দিকেও খেয়াল নেই। এক আত্মীয় ছোট সন্তানটাকে এনে কোলে রাখে, এবার মহিলা কেঁদে ওঠে হাউমাউ করে। আত্মীয়রা নিশ্চিন্ত হয়, হ্যাঁ, এবার সে বাঁচবে।

মানুষের যত অমর সৃষ্টি, যত শিল্প, সে তো কান্নারই প্রতিচ্ছবি। মওলানা রুমির মসনবি শরিফ তো কান্নারই সমুদ্র। রুমি বলছেন, ও খোদা, আমি তো ছিলাম এক জমাটবদ্ধ বরফখণ্ড। তাবরিজের সূর্য আসলেন, আর আমাকে ফালি ফালি করে কাটলেন। এখন দেখো আমি বয়ে যাচ্ছি সমুদ্রের পানে।

পবিত্র কোরআনকে কে যেন বলেছিলেন এক বাক্যে তর্জমা করতে। সেই সুফি দার্শনিক শুধু ফেলেছিলেন কয়েক ফোঁটা জল। আর উচ্চারণ করেছিলেন এক অপূর্ব বাক্য, পুরো কোরআনের সার কথা হচ্ছে, মরার আগে মরে যাও!

মরার আগে মরে যাও, এ আবার কেমন কথা! মরার আগে আবার কেম্নে মরে মানুষ। মানুষ তো মরে মরার আগেই, মরার পর তো আর মরে না। নিজের ইগো, অহংকার বিসর্জন দেয়ার নামই তো মরণ। সেই মরণ হচ্ছে কোনো এক অসীমের প্রতি নিজেকে সমর্পণ। রুমি বলছেন:

Die now! Die now! Die now, in this love!
When you die in this love, new life, you will receive.
Die now! Die now! Do not fear this death.
When you die and leave this earth, heaven you will seize.

শুধু যে দুঃখে আমাদের চোখে পানি আসে তা, তো না। চোখে পানি আসে অসহ্য সুখে। মহৎ কিছুর সামনে দাঁড়ালেই আমাদের মন আপনা থেকে কেঁদে ওঠে। কবি হাইরেন হাইনে নাকি ল্যুভর মিউজিয়ামে যেতেন আর ভেনাস দ্য মিলোর মূর্তির পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতেন। কাঁদতেন কিসের জন্যে? কনস্তান্তিন পাউস্তোভস্কি আমাদের জানিয়েছেন, কাঁদতেন মানজাতির লুপ্ত পরমোৎকর্ষের জন্যে, কাঁদতেন জেনে যে রাস্তাটা দীর্ঘ।

মানব সভ্যতার যদি গর্ব করার মতো কিছু থাকে সে তো এই, যে, চোখের পানিকে সে রূপ দিতে পেরেছে অপরূপ শিল্পে, পরমের সাধনায়। অশ্রু পরিণত হয়েছে মুক্তায়।

মানুষের এ-সভ্যতার এখন বড় দুঃসময়। এ থেকে মানুষের মুক্তির উপায় যদি কিছু থাকে তা হলো কান্না। মানুষকে যদি কিছু এক করতে পারে তাহলো চোখের পানি। চোখের পানি ফেলতে দরকার জ্ঞান-সাধনা। জ্ঞান-সাধনা হচ্ছে অসীমের প্রতি নতজানু হয়ে জীবনের তুচ্ছতাকে স্বীকার করা। একদিন এ-জগত ছেড়ে চলে যাব, হায়, এর চেয়ে বেশি সত্যজ্ঞান আর কী উপলব্ধি করার আছে এ-জীবনে! কাঁদো মানুষ কাঁদো, নিজের লাশ সামনে নিয়ে কাঁদো, কাঁদো সমগ্র মানবআত্মার শব কাঁধে নিয়ে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক