শিশির ভট্টাচার্য্যের গদ্য ‘ধর্মের বিপক্ষে আমি নই’

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৩, ২০২২

ধর্মের বিপক্ষে আমি নই। ইতিহাসে নিজের বহু গুরুদায়িত্ব পালন করেছে ধর্ম। ধর্মের অনেক ভালো দিক আছে। খ্রিস্টধর্ম না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি কঠিন হতো, ইসলাম না থাকলে গ্রেকোরোমান জ্ঞান মধ্যযুগে চিরতরে হারিয়ে যেত।

রামায়ণ-মহাভারত পড়ে আমি তৃপ্তি পাই, কোরানের সুললিত আবৃত্তি শুনে আমার ভালো লাগে, বাইবেল পড়ে হাজার দুই বছর আগের কথা আমি জানতে পারি, গীর্জা-প্যাগোডায় গিয়ে বসলে আমার মন শান্ত হয়। বিশাল সব গীর্জার কারুকাজ দৃষ্টিসুখকর। ইস্তাম্বুলে মসজিদ দেখেও আমার মনে ভক্তিভাব উদয় হয়েছে। বিভিন্ন দেশের যাদুঘরে বুদ্ধদেবের অনিন্দসুন্দর সব মূর্তি দেখেও আমি আপ্লুত হই।

আমি এও জানি যে ঈশ্বর, ধর্ম, সংস্কৃতি, দেশ, সরকার, পরিবার... সব মানুষের তৈরি একেকটি চিহ্ন। চিহ্নের একদিকে আছে শব্দ, বস্তু দিয়ে তৈরি দ্যোতক, অন্যদিকে মানব মস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল-ম্যাগনেটিক বা বৈদ্যুতিন-রাসায়নিক-চৌম্বকীয় বাস্তবতা হচ্ছে দ্যোতিত। দুটিই ভুয়া, ডাহা মিথ্যা, কিন্তু মানুষের জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য। ভাষার পুরো ব্যাপারটাই ভুয়া, কিন্তু ভাষা ছাড়া একদিনও কি বাঁচা যাবে? ভাষা, ধর্ম, দেশ, জাতিয়তা, সংস্কৃতি এগুলোকে আমি উড়িয়ে দেব না, কিন্তু এমন সব ‘ফালতু’ জিনিষের  জন্যে মানুষকে আক্রমণ করতে বা নিজে শহীদ হতে আমি গররাজী।

বাসায় আসা কোনো মুসলমান বন্ধু যখন নামাজ পড়তে চায়, তাকে একটি জায়নামাজ এবং প্রার্থনার জায়গা দিতে পারলে আমি মনে শান্তি পাই। এর কারণ কী? ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী’ এবং ‘আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ’ দুই গান শুনেই আমার চোখে পানি আসে। কেন আসে, আমিতো মুসলমান নই! দুটোই ‘বিধর্মী মুসলমানের বাচ্চা’ নজরুলের লেখা এবং দুটি গান শুনেই ঈশ্বরকে আমি তার বাপ-মা তুলে মাতৃভাষা চাটগাঁইয়াতে অশ্রাব্য গালি দিই, নজরুলের মতো একটি দেবশিশুকে তিনটি দশক ধরে খামাখা কষ্ট দেবার জন্যে। যদিও আমি জানি কৃষ্ণ, শিব বা ঈশ্বর মানুষের কল্পনা মাত্র, নজরুলের কীর্তন-ভজন শুনে কেন আমি অশ্রুসজল হই?

এর কারণ আমি মানুষ, আমি বাঙালি। ঈশ্বর, আল্লাহ, মদিনা, কাশী, এথেন্স, রোম সব আমার পূর্বপুরুষের অর্জন। ধর্মও আমার, সংস্কৃতিও আমার। মুসলমানও আমার, হিন্দুও আমার, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানও আমার স্বজাতি, ভাই-বন্ধু-পূর্বপুরুষ। বাবা এবং মা দুই জনই আমার প্রিয়। ফাজিল লোকদের মতো আমি নিজেকে জিগ্যেস করি না: ‘বলোতো বাবু, মা ভালো, নাকি বাবা ভালো?’ আমি বলি: ‘দুজনেই ভালো, দুজনকেই আমি ভালোবাসি!’ ভালোবাসি, কিন্তু দুজনের কাউকেই আমি বাড়াবাড়ি করতে দিই না। ‘আপনে আওকাত মাৎ ভুলো!’

ধর্মের জন্যে সংস্কৃতি বা কিন্তু সংস্কৃতির জন্যে ধর্মকে আক্রমণ করার আমি বিপক্ষে। কিন্তু এই দুজনের জানতে হবে, যতটা মহান নিজেকে তারা মনে করে, ততটা মহান তারা নয়। যখন দেখি ধর্ম সংস্কৃতিকে গলা টিপে মারতে চাইছে, আমি সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়াই। একই কাজ সংস্কৃতি যদি করতে যায়, তবে আমি ধর্মের পক্ষে দাঁড়াবো। সংস্কৃতি কিংবা ধর্ম দুটির কোনোটিই আমার কম প্রিয় নয়, কিন্তু আমি জানি, দুটিই শতভাগ ভুয়া, আবার এও জানি, এইসব হাজারো ‘ভুয়ামি’ এবং ডাহা মিথ্যা নিয়েই মানুষের জীবন।

বাচ্চা ধর্মপুতুল নিয়ে খেলছে, সেই পুতুল আমি কেড়ে নিতে পারি, কিন্তু তার কান্না থামাবো কী দিয়ে। ধর্মকে আমি কাঁঠালের মতো মনে করি। কোয়াগুলো পছন্দ হলে খাই, বীচিটাও ভেজে খাই, কিন্তু ভূতিটা গরুকে দিই। মৌলবাদীরা ভূঁতিটাও আমাকে খাওয়াতে এলে আমি সংস্কৃতির ঢাল তুলে তাকে বাধা দিই আত্মরক্ষার স্বার্থে।

সংস্কৃতিও কাঁঠালের মতো, মঙ্গলশোভাযাত্রাকে গোখাদ্য ভূতি মনে হলে না খান সেটা, না যান শোভাযাত্রায়, কিন্তু পুরো কাঁঠালকে অখাদ্য বলতে গেলে আমি অন্তত আপনাকে সমর্থন করবো না। শোভাযাত্রা করার পরপরই কেউ যদি মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে যায়, তবে তাকে বাধা দেবারও পক্ষে আমি নই। ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থানে আমি বিশ্বাসী। সবখানে মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর লব খুঁজিয়া!

লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনিস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গদ্যটি লেখকের ফেসবুক ওয়ার থেকে নেওয়া