প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শৈবাল মাহমুদের কলাম ‘মজিদ খান থেকে রেজা কিবরিয়া’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০২২

সামরিক সরকারের উপদেষ্টা ডক্টর মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। এই নীতিকে সাম্প্রদায়িক ও জাতীয় পাবলিক শিক্ষার বুনিয়াদ ধ্বংসের নীল নক্সা আখ্যা দিয়ে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

মজিদ খানের শিক্ষানীতির মূলে আছে শিকাগো অর্থনীতির তত্ব, যাকে এমন কি পুঁজিবাদীরাও সামাজিক বৈষম্যমুখি প্রবর্তনা বলে। বিশ্বের প্রথম সারির পুঁজিবাদী ও কল্যাণবাদী রাষ্ট্রগুলোতে শিকাগো অর্থনীতিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ইয়োরোপীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবাকে পাবলিক খাতে রাখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শিক্ষাখাতে স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাবলিক খাত বজায় রাখা হয়েছে।

মজিদ খানের শিক্ষা নিতি প্রবল আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকার প্রত্যাহার করে নিলেও পরের বেসামরিক সরকারগুলো এই নিতিগুলো প্রবর্তন করে এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা খাত ঢালাওভাবে প্রাইভেট বিনিয়োগে ছেড়ে দেয়া হয়। মজিদ খান মেধার কথা বললেও মূলত শিক্ষাকে মুনাফা করবার পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেছিল। মজিদ খানের পর একে একে অর্থমন্ত্রী হয়েছেন সাইফুর রহমান, শাহ এস, এম, এস কিবরিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত, যাদের সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে মুনাফার পণ্য করতে প্রাইভেট খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে সরকারের প্রত্যেকটি খাতে নিয়োগ বাণিজ্য আরো বিস্তৃত হয়েছে।

শাহ এস, এম, এস কিবরিয়া একজন পেশাদার আমলা হিশেবে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কর্মজীবনও শুরু হয় পাকিস্তান আমলে পেশাদার আমলা হিশেবে। মুহিত এরশাদ সামরিক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন এবং আওয়ামী লিগের অর্থমন্ত্রী হন। সাইফুর রহমান ছিলেন চার্টার্ড একাউন্টেট এবং জিয়ার আমলে রাজনীতিতে আসেন। দেখা যাচ্ছে বেসামরিক দলগুলো তাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে সামরিক সরকারের বিভেদমূলক, বৈষম্যমূলক নিতিগুলো বাস্তবায়ন করেছে আমলা ও চার্টার্ড একাউন্টেটদের দিয়ে। স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্রী নেতা টিটোর প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাকে পাকিস্তান আমলের আমলাদের বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনে না রাখতে পরামর্শ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সে পরামর্শ শোনেননি। তারপর কি হয়েছে তা আমরা জানি। বাকশালেও অনেক পাকিস্তান আমলের আমলাকে বিভিন্ন খানে গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর থেকে প্রত্যেকটি পট পরিবর্তনে শাসক বদলালেও আমলাদের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বেড়েছে। এখনকার বাংলাদেশকে পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক পুলিশ রাষ্ট্র বলা যায়, যেখানে জনগণ, রাষ্ট্র, জন প্রতিনিধি সবাই আমলাদের হাতে জিম্মি। মজিদ খান যেভাবে শিক্ষাকে যে কিনতে পারবে তার অধিকারে নেবার সুপারিশ করেছিল, তার ফলশ্রুতি হচ্ছে এই আমলাতান্ত্রিক পুলিশ রাষ্ট্র।

মজিদ খানের শিক্ষানীতির সবচেয়ে বেশি সুফল পেয়েছে ব্র্যাক, গণস্বাস্থ্য ও ইবনে সিনাসহ এনজিওগুলো। এদেরকে সহায়তা করেছে আবার সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামদের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। দৃক প্রাইভেট লিমিটেডের পাঠশালা প্রকল্পটির মালিক শহিদুল ইসলাম সরকার বিরোধী বা আওয়ামী লিগ বিরোধী এক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত হলেও, বর্তমান সরকারের আমলে দৃক তাদের বেসরকারি সনদপত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্স সিল বসাবার সুযোগ পেয়েছে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের সহায়তায়। বেসরকারি দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিষদে আসীন এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাদেকা হালিম, সামিনা লুতফা। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে এখন সহায়তা করছে জাতির করের টাকায় প্রশিক্ষিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এভাবে একের পর এক প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়েছে যাতে শিক্ষকতা করছে পাবলিকের টাকায় প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা। এই প্রাইভেট জায়গাগুলো মূলত সেই মজিদ খানের শিক্ষানীতির সম্প্রসারণ, টাকা থাকলে একজন সনদ পাবে, টাকা না থাকলে পাবে না।

বাংলাদেশে কোটাবিরোধী যে কথিত ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, প্রবর্তনার দিক থেকে তা মজিদ খানের শিক্ষানীতির প্রতিফলন বলা যায়। মেধার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলে প্রকারান্তরে মূল্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সামনে আনা হয়েছে। মূল্য দিতে না পারার ফলে, কিম্বা মজিদ খানের ভাষায় পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা না থাকায় তৃতীয় বিশ্বের ব্যাপক জনগণ উচ্চশিক্ষায় আসতে পারে না। আবার মধ্যম আয়ের টার্গেট বলে নিম্নবিত্তকে আরো হীনমন্যতায় ফেলে যে কোনো মূল্যে শিক্ষা কিনতে হবে বলে নির্দেশনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

কোটাবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনায় প্রতিক্রিয়াশীলেরা জড়িত থাকলেও সরকারি-বেসরকারি ব্যাপক ছাত্রছাত্রীদের অংশ নেয়া বলে দেয়, একের পর এক শাহ এস, এম, এস কিবরিয়া, সাইফুর রহমান, আব্দুল মুহিত জনতাকে শুধু হীনমন্যতাতে ভুগিয়ে দুর্নীতিবাজ বানাতেই সফল হয় নি, তারা মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে জনতাকে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন ভুলিয়ে দিয়েছে। জন সমর্থন না পেয়ে কথিত মেধার প্রতিদ্বন্দিতাভিত্তিক কোটা বিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে থেমে যায়।

কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন শাহ, এস, এম, এস কিবরিয়ার অক্সফোর্ড শিক্ষিত ছেলে রেজা কিবরিয়া। রেজা কিবরিয়া কিশোর কাল থেকে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন। উনি পড়াশোনা করেছেন ওনার বাবার পাঠানো টাকায়, ওনার বাবার টাকা এসেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনগণের করের টাকা থেকে। রেজা কিবরিয়া পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন এলিট অবস্থান থেকে এবং সেখান থেকে বিকশিত হয়েছেন। এখানে ওনাকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়নি। পাবলিকের করের টাকা পাবলিকের খাতে সুষম বিতরণ হলে সব বিত্তের লোকের পড়াশোনায় সমান অধিকার থাকে।

শিক্ষাকে পণ্য করে এলিটের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করলে কি হয়? রেজা কিবরিয়া আওয়ামী রাজনীতিতে আস্থা হারিয়ে কিছুদিন কামাল হোসেনের রাজনীতিতে আস্থাবান ছিলেন। কামাল হোসেনের লোকেরা জনতার কাছে যেতে চায় না বুঝে রেজা কিবরিয়া নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সেখানে উনি কেবল আওয়ামী লিগ এই করেছে, সেই করেছে বলেন, কিন্তু সুদূরপ্রসারী গণমুখী কোনো শিক্ষানীতির কথা বলেন না। অথচ অর্থনীতিবিদ হিশেবে উনি সেখান থেকে শিক্ষানীতির কথা বলতে পারেন। একজন অক্সফোর্ড প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ হিশেবে উনি নিশ্চয় বুঝতে পারেন যে, কোটাবিরোধী আন্দোলন যে কোনো কল্যাণকামী অর্থনীতির বুনিয়াদ সমূলে উপড়ে ফেলে পুরোপুরি পুঁজিবাদী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ। আর এ উদ্যোগে পর্দার অন্তরালের গফ ফাদারদের এজেন্ট হিশেবে কাজ করেছে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা। রেজা কিবরিয়া যে গ্রেট ব্রিটেনে প্রশিক্ষিত হয়েছেন, সেখানেও বিভিন্ন ধরনের কোটা আছে শিক্ষা খাতে, যাকে বলা হয় আয়নির্ভর শিক্ষা ব্যয়ের মিন্স টেস্ট।

রেজা কিবরিয়া এবং তার কোটা বিরোধী বন্ধুরা যা চাচ্ছেন, তা এরই মধ্যে হরেদরে বাংলাদেশের চলছে। অর্থাৎ জোর যার মুল্লুক তার। ওনারা মজিদ খানের মেধার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলে পেছনের দরজা দিয়ে মূল্যের জোরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঢোকাতে চাইছেন। ব্র্যাক, গণস্বাস্থ্য, ইবনে সিনা বাংলাদেশে জাঁকিয়ে বসেছে দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচির নামে। এসব এনজিও এবং কর্পোরেশনগুলো এখনো বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। রেজা কিবরিয়াদের সাথে জনতার বিচ্ছিন্নতার জায়গাটি হচ্ছে, জনতা বুঝতে পারে যে এসব প্রকল্পের পেছনে মজিদ খানের ভুত রয়েছে। আবার বড় দলগুলো এই ভূত নাচে পারঙ্গম হওয়াতে মিনিয়েচারদের চলতে হয় উচ্ছিষ্ট নিয়ে। বড় দলগুলো এবং মিনিয়েচার উভয় পক্ষের নিজেদের বদলানোর সময় এসেছে।