
শ্যাম বেনেগাল
শ্যাম বেনেগাল নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ০৫, ২০২২
শ্যাম বেনেগাল খুব বড় মাপের চলচ্চিত্রকার। তাকে শুধু বড় মাপের চলচ্চিত্রকার বললেই তার যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হয় না। তিনি হিন্দি ছবির জগতের অনেক ধ্যান ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন। মুম্বইয়ের ছবির জগতে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, সেখানকার চলচ্চিত্রের দীর্ঘদিনের উচ্চকিত অভিনয়রীতির জায়গায় নতুন ধরনের বাস্তববাদী অভিনয়ের ধারাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কারণে। মূলধারার হিন্দি ছবির জগতে চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা নির্মাণের জন্য। তিনি মূলধারার চলচ্চিত্রে এসেছিলেন অনেক পরে। প্রথম নির্মাণ করেছেন বিজ্ঞাপন চিত্র আর প্রামাণ্যচিত্র। তাকে বলা হয় ভারতীয় সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ। তার হাত ধরেই সত্তর দশকে চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন শাবানা আজমী, অনন্ত নাগ, গিরিশ কারনাড, নাসির উদ্দীন শাহ, স্মিতা পাতিল, অমরেশ পুরী, পঙ্কজ কাপুর প্রমুখ।
দুই হাজার পনের সালে ঢাকায় তার সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ বা পরিচয় হয় একটি চলচ্চিত্র উৎসবে। আমি তার ছবিগুলোর গুণগ্রাহী হিসাবে ঢাকায় অনেক গল্প হয় তার সঙ্গে। তিনি যেদিন ফিরে যান তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বিমানবন্দরে তিনি আমাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে কখনো মুম্বাই গেলে যোগাযোগ করতে বলেন। সে বছরের অক্টোবর মাসেই মুম্বাই গেলে তাকে ফোন করেছিলাম। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাসের অধীন ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারকে আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম, শ্যাম বেনেগালের সব ছবিগুলির একটি প্রদর্শনী করার ব্যাপারে। ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার তাতে সম্মতি দিলে এবং শ্যাম বেনেগালের অনুমতি লাভের প্রশ্ন তুললে, আমি সে ব্যাপারেই চলচ্চিত্র পরিচালক বেনেগালের সঙ্গে কথা বলার জন্য মুম্বাই গিয়ে ফোন করি। তিনি আমাকে সাদরে পরদিন সকালে তার কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান এবং প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সেবার মুম্বাই গিয়েছিলাম। সাখাওয়াত ভাই মুম্বাই ভ্রমণ শেষ করেই সস্ত্রীক ঢাকা চলে আসবেন আর আমরা আরো কিছুদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরবো। সাখাওয়াত ভাই ঢাকা ফিরবার দিন সকালে বিমানবন্দরে যাবার সময় আমাকে শ্যাম বেনেগালের কার্যালয়ে নামিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু মুম্বাইয়ের হাজী আলী মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে আমি দেখলাম আমার হাতে অনেক সময় রয়েছে। সাখাওয়াত ভাইকে বললাম, ‘আমি এখানেই নেমে যাই, আপনাকে আর ঘুরপথে বিমানবন্দরে যাবার দরকার নেই। এটুকু আমি হেঁটে চলে যাব।’ আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে তারপর হাঁটতে হাঁটতে মিনিট দশেক আগেই শ্যাম বেনেগালের অফিসে পৌঁছে গেলাম। তিনি তখনো আসেননি। তার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম তার অফিসে। অফিসে তার পরিচালিত ছবিগুলোর পোস্টার টানানো আছে দেয়ালে। দেখলাম একজন কর্মচারী বা কেউ পূজা দিয়ে অফিসের কাজকর্ম আরম্ভ করছেন। পরিচালক বেনেগাল নিষ্ঠাবান হিন্দু কিনা আমি জানি না। সকালে তার অফিসে এরকম উপাসনার রীতি দেখে সামান্য আশ্চর্য হয়েছিলাম।
তার আসতে দেরি হলো মিনিট পাঁচেক। সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ডেকে পাঠালেন তার কক্ষে। কক্ষের চারিদিকে নানারকম বই। অফিসের মেঝেতেও নানান বই রাখা আছে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, তিনি পরের যে ছবিটি করবেন, তারজন্য প্রচুর পড়াশুনা করছেন। জানালেন ছবিটি তিনি করবেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ আর স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে। সম্ভবত সরকারি অনুদান নিয়েই কাজটি করবেন। তিনি জানালেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের ইতিহাসটা জটিল আর সে কারণেই অনেক পড়াশুনা করতে হচ্ছে। মূলত তার ওই ছবিটি নিয়েই কথা হয়েছিল সেদিন অনেক বেশি। তিনি তখনো সুনির্দিষ্ট করতে পারেননি, সেই ছবিতে কোন্ দিকটি গুরুত্ব পাবে। তিনি পড়াশুনা করার ভিতর দিয়েই তা ঠিক করবেন। ছবিতে অনেক বেশি চরিত্রের উপস্থিতি থাকবে, ঠিক যেমন ছিল আগের নেতাজী ছবিটিতে। কিন্তু তার এবারের ছবিটি হবে আরো বিশাল পরিধিতে। আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম তার ছবি সম্পর্কে এসব জেনে। কারণ ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে একটি বড় মাপের ছবি হবে ভারতের পরিচালকের হাত দিয়ে এটা অবশ্যই আনন্দের খবর ছিল। বিশেষ করে শ্যাম বেনেগাল সম্পর্কে যখন আমার উচ্চ ধারণা ছিল। তখন তার বয়স বিরাশির বেশি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, ছবিটা করতে পরিচালকের সব মিলিয়ে অনেক সময় লাগবে আর সম্ভবত সেটাই হবে বেনেগালের শেষ ছবি। হয়তো একই সঙ্গে সেটাই হবে তার এ শতকের সবচেয়ে আলোচিত কাজ। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এবং ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ডামাডোলের প্রেক্ষিতে মনে মনে আমি তার ছবিটি দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম।
যখন কয়েক বছর আমি জানতে পারলাম, তিনি দুই দেশের সরকারের যৌথ প্রযোজনায় শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর একটি কাহিনিচিত্র করবেন, খুব চমকে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে তিনি যে ছবিটা করতে চান তাহলে তার কী হবে? যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার, সেই বয়সে এসে দুটি ইতিহাস নির্ভর ছবি করা কি সম্ভব হবে তার পক্ষে? মনে মনে ভেবেছিলাম, তিনি কি হিসাব মেলাতে ভুল করছেন? সত্যিই কি তার পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন নিয়ে ভালো ছবি করা সম্ভব? পরিচালক হিসেবে তার মেধা নিয়ে ততটা শঙ্কিত ছিলাম না, শঙ্কিত ছিলাম পারিপার্শ্বিকতা আর বাস্তবতা নিয়ে। মুম্বাইয়ের অফিসে তার সঙ্গে আলোচনার দিন এটা বুঝেছিলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে তার জানাশোনার পরিধি খুব কম। তেমন ধারণা নেই বললেই চলে। ধারণা থাকাটা তার জন্য জরুরি ছিল না, যদি ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ নামের ছবিটা করার দায়িত্ব না নিতেন। ছবিটি করার ক্ষেত্রেও ধারণা না থাকাটা খুব দোষণীয় নয়, যদি তিনি পড়াশুনা আর গবেষণা করার জন্য যথেষ্ট সময় পেতেন। কারণ তিনি এমন একজন ইতিহাসের চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন, যার স্মৃতি এখনো বহু মানুষের কাছে উজ্জ্বল।
ইতিহাসের চরিত্র নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে সেই চরিত্রটাকে তীক্ষ্ণভাবে বুঝতে হয়, খুব গভীরভাবে তার সময়কালকে জানতে হয়। সেখানেই শেষ নয়, যে মানুষগুলি সেই চরিত্রের আশপাশে ছায়া হয়ে ছিল, ছবি নির্মাণ করতে গেলে সেই মানুষগুলিকে পর্যন্ত আদ্যপান্ত চিনতে চেষ্টা করতে হয়। গল্প-উপন্যাস লিখতে গেলে যতটা জানতে হয়, ছবি নির্মাণ করতে গেলে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি জানতে হয়। শিরোনামের চরিত্রটির পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে পর্যন্ত জানাটাও জরুরি হয়ে ওঠে। কারণ চলচ্চিত্রে সেই সবগুলি চরিত্রকে জীবন্ত আর বাস্তব হয়ে উঠতে হবে। সেই পার্শ্ব চরিত্রগুলি চলচ্চিত্রে সঠিকভাবে ফুটে না উঠলে, মূল চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা কঠিন। শেখ মুজিবের চরিত্র কি কখনো সঠিকভাবে চিত্রায়ণ করা যাবে যদি ভাসানী, তাজউদ্দীন, মোশতাক-সেই সঙ্গে আরো সব নেতা, ছাত্র নেতাদের সম্পর্কে গভীরভাবে ধারণা না থাকে? এগুলি হচ্ছে বিষয়বস্তুর প্রশ্ন। ইতিহাসের চরিত্রগুলির দার্শনিক দিক। শিল্পের প্রশ্নে দরকার হবে চরিত্রগুলির প্রত্যেকের অবয়ব ঠিক রাখতে পারা। চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলার মতো বিশ্বাসযোগ্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের উপস্থিতি। চলচ্চিত্রে এতসব কিছু মিলিয়ে ফেলা এত সহজ নয়। নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে চরিত্রগুলির অবয়ব নিয়ে তত প্রশ্ন উঠবে না, কিন্তু চলচ্চিত্র হচ্ছে ন্যাচারালস্টিক বা স্বভাববাদী শিল্প। সেখানে ফাঁকফোকর রাখার সুযোগ কম।
ঠিক সে-কারণেই শেখ মুজিবের মতো ইতিহাসের বিশাল মাপের ব্যক্তিকে নিয়ে ছবি করতে গেলে দরকার দীর্ঘদিন ধরে অধ্যয়ন, গবেষণা আর অনুসন্ধান চালানো। এ ক্ষেত্রে এসে `দেখলাম আর জয় করলাম`, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। দরকার বিরাট বাজেট। পরিচালককে সহযোগিতা করার জন্য বড় বড় মাথা। বড় বড় সেসব মাথার মধ্যে অবশ্যই অন্তুর্ভুক্ত থাকতে হবে বড় বড় ইতিহাসবিদ, যারা গল্প বা বিষয়বস্তু দাঁড় করতে সাহায্য করবেন। যাঁদের দখলে থাকবে নানারকম তথ্য আর নখদর্পণে থাকবে ইতিহাসবোধ, সমাজবিজ্ঞানের দ্বান্দ্বিক ধারণা। কারো সখ হলো আর গল্প লিখতে বসে গেলেন, ইতিহাস নিয়ে বা ইতিহাসের চরিত্র নিয়ে ছবি করার ব্যাপারটা আদৌ তেমন নয়। কারণ বিষয়বস্তুর মূল কথা হলো ইতিহাস। ঠিক একইভাবে অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রেও, নিজনিজ চরিত্র চিত্রণের জন্য থাকতে হবে ইতিহাসের উপর অসামান্য দখল। চরিত্রটি কোন সমাজের কোন্ ইতিহাসের মধ্যে বিচরণ করছে না জানলে, চরিত্রের অন্তঃস্থল ফুটিয়ে তোলা সম্ভবই নয়। স্তানিস্লাভস্কি বা যে কোনো বিজ্ঞানমনস্ক বাস্তবাদী অভিনয় পদ্ধতির ক্ষেত্রেই এটা চরম সত্যি। সেখানেও ‘আসলাম, দেখলাম, আর জয় করলাম’ হবে না, অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের দীর্ঘদিন ধরে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
সবকিছুর পর যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা থেকে যায়, তা হলো একটা বিশেষ দল বা দলের সরকার এই ছবিটি করার জন্য টাকা দেবে। সেই সরকার বা দল কি নিরপেক্ষভাবে শেখ মুজিবের জীবনী নিয়ে ছবি করতে দেবে, নাকি নিজদের দলের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালককে প্রভাবিত করবে? ভারত সরকারের ভূমিকাটাই বা সেখানে কি হবে? ভারত সরকার কেন শেখ মুজিবের ছবি নির্মাণের জন্য টাকা ঢালছে, সেটাও বিরাট প্রশ্ন। সবাই মিলে আসলে মুজিবকে কোন চোখে বা কেমন চোখে দেখতে চাইছে সেটাই প্রধান বিবেচ্য। সেখানে পরিচালকের মতাদর্শটা বা কী হবে। সকল অভিনেতা অভিনেত্রী কি সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি লালন করতে পারবে যা চাইবে ছবির মূল নির্মাতারা? পরিচালক শ্যাম বেনেগালই বা মুজিবকে কোন চোখ দিয়ে দেখবেন, এগুলি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় যে-কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে। পরিচালক কি স্বল্প সময়ে প্রকৃত মুজিবকে চিনে উঠতে পারবেন বা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কি প্রযোজকদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা মিলবে? সবরকম বিবেচনা থেকেই যখন দেখলাম শ্যাম বেনেগালই ছবিটি করতে যাচ্ছেন, তখন প্রথমেই মনে হয়েছিল, আমার প্রিয় এই চলচ্চিত্র পরিচালকটি শেষজীবনে নিন্দা লাভের একটি পথ ধরেই হাঁটছেন কী? কিছুদিন ধরে নানা জনের ‘মুজিব-একটি জাতির রূপকার’ ছবি সম্পর্কে নানা প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, আমার সে ধারণাটাই সত্যি হতে যাচ্ছে। সত্যি না হলেই খুশি হবো।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক