শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ১

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০

আমি মারিয়া। একটা ছোট্ট শহরে থাকি, আমার মেয়েকে নিয়ে। আমাদের শহরের থেকে একটু দূরেই পাহাড়, আরও কিছু দূরে সমুদ্র। ভীষণ সুন্দর এই শহরের নাম, বেহেস্ত। ছোট শহর, কিন্তু সে বড় ব্যস্ত। ভোর হতে না হতেই ডিউটিতে বেরিয়ে পড়ে শহর রক্ষার কর্মচারীরা। তাদের কাজ একটা ইয়া বড় ইঞ্জিন থেকে লম্বা পাইপ দিয়ে শহরের রাস্তা ক্লিনজিং করা, রাস্তার পাশে যত গাছ তাদের জল দেয়া ও পরিচর্যা করা, শহরের ডাস্টবিনগুলোকে শোধন করা। শহরটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে বহু পরিশ্রম করে এরা, উদয়াস্ত খাটে।

সকলেই এখানে উপার্জনক্ষম। যে যার মতো কাজ করে। আমার মতো সিঙ্গল মাদাররা তো বটেই, তাদের বাচ্চাদের জন্য রয়েছে সুন্দর ক্রেজের ব্যবস্থা। যেদিন নিজের শহর ছেড়ে এই শহরে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেদিনই জেনে নিয়েছিলাম এই সব কিছু। যেদিন এ শহরে পা রেখেছিলাম প্রথম, কোলে তিন বছরের শিশু, সেদিনই মনে হয়েছিল এবার হয়তো সব কিছু সুন্দর হবে, এ শহরেরই মতো।

একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে উঠি আমরা। এ শহরের পুরনো বাসিন্দা আমার বন্ধু রুবি সব ব্যবস্থা করে দেয়। ফার্নিচার তেমন কিছুই ছিল না। রুবি একটা বেড আর একটা কাবার্ডের ব্যবস্থা করে দেয়। আর কিছু কুকিং ইউটেনসিল। এরপর আমার প্রথম কনসার্ন ছিল একটা কাজ। সাথে যে সামান্য টাকা এনেছিলাম তাতে বেশিদিন চলবে না। তাই একটা কাজ খুঁজতে শুরু করি হন্যে হয়ে। আমার এর আগে দু বছরের ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স ছিলো স্কুলে পড়ানোর। কিন্তু এ শহরে স্কুলে পড়াতে গেলে আলাদা ওয়ার্ক পারমিট চাই, আর সাথে পাঁচ বছরের রেসিডেন্সিয়াল প্রুফ।

স্কুলে হলো না। কিন্তু কাজ পেয়ে গেলাম একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, রিটেইল ম্যানেজমেন্টে। সাথে সাথে মেয়ের জন্য ব্যবস্থাও হলো ক্রেজের। ক্রেজ কাম কিন্ডারগার্টেন। এখানকার মেয়েরা কর্মঠ হলেও যথেষ্ট মাতৃসুলভ। আমি বেরতাম ভোর সাতটায়, ডাউনটাউন রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে এক ঘণ্টার জার্নি। আমার বসেরা যথেষ্ট কোওপারেটিভ ছিলেন। কাজ শিখি দ্রুত। ওখানেই আমার সাথে আলাপ হয় ডাউনটাউনের মেয়ে সান্দ্রার। সান্দ্রা বয়সে আমার থেকে ছোট হলেও কাজে আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র। ক্রমে ও আমার পারিবারিক বন্ধু হয়ে ওঠে। সেসব কথায় পরে আসছি।

প্রথমেই সমস্যা হয় আমার মেয়ে মিশ্মিকে নিয়ে। একদিন কিন্ডারগার্টেন থেকে ফোন আসে। আর্লি লিভ নিয়ে ট্রেন ধরে ডাউন টাউন থেকে ছুটে ছুটে ফিরতেই মেয়ে এসে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, "পাপ্পা পাপ্পা"। কিন্ডারগার্টেনের নার্সরা বলে মেয়ে সারাদিন কিছু খায়নি। ওরা যতবারই চেষ্টা করেছে মিশ্মি রিফিউজ করেছে।

কান্না থামিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। সে আমার ঘাড়ে মাথা রেখে বলে, "পাপ্পা পাপ্পা", তাকে কি বলে সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারলাম না। বড় বেশি অপরাধ বোধ হলো সেদিন। খুব একা লাগতে লাগলো এ শহরে। বাধ্য হয়েই সান্দ্রাকে কল দিলাম। সান্দ্রা এলো। ভাগ্যিস এলো। সান্দ্রা বললো, "একা একা ওর মন খারাপ করছে। চলো একটু বেড়িয়ে আসি"। সেদিন সন্ধ্যা বেলা আমি, সান্দ্রা আর মিশ্মি ডাউনটাউন বেড়াতে গেলাম। শহরে আসা অবধি এই প্রথম। স্ট্রিট লাইটে শহরটাকে মায়াবী লাগছিল। কী সুন্দর সাজানো শহর। ঢালু রাস্তা। মিশ্মিকে বেলুন কিনে দিলো সান্দ্রা। আমরা তিনজন একটা রেস্তরাঁয় ডিনার সারলাম।

ফেরার সময় আমাকে আর মিশ্মিকে ক্যাব ধরিয়ে দিয়েছিল সান্দ্রা। হালকা হালকা বৃষ্টির ভেতর ক্যাব এগোচ্ছিল ঝিম ধরা বেগে। শহরের লাল হলুদ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো ক্যাবের উইন্ডোয় লেগে। মিশ্মি ঘুমিয়ে পড়েছিল আমার কাঁধে, তার ছোট ছোট শ্বাস আমার গায়ে লেগে মিলিয়ে যাচ্ছিল গভীরে।

সেদিন প্রায় তিন মাস পর হঠাৎ আমার ফেলে আসা শহরের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিলো জুমেরানের কথা, বৃষ্টির ভেতর হাত ধরাধরি করে তার সাথে ভুট্টা ক্ষেতে হারিয়ে যাওয়ার কথা। চলবে