শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৭, ২০২০

হাইওয়ে ধরে গাড়ি দ্রুত বেগে ছুটছিল।
দূরে দূরে পাহাড়ের কোলঘেঁষা বিচ্ছিন্ন জনবসতির আলোগুলি টিমটিম করে জ্বলে আছে। অন্ধকার ছিন্নভিন্ন করে প্রায় উড়ে চলার মতো এই পথ অপরিচিত বোধ হচ্ছিল। যেন এই জগতের কেউ আমি নই, নই এই শহরের, দূর দূর অবধি জীবনের যত চিহ্ন সে সবই আমার কাছে দুর্বোধ্য অস্পষ্ট বোধ হচ্ছিল। স্মৃতি-বিস্মৃতির যবনিকা পতন ঘটেছিল, ঘোর কেটেছিল, একটি কণ্ঠস্বরে।

আপনি... এত রাতে... হাইওয়ে ধরে কোথায় চলেছেন?
সত্য বিবৃতির অবস্থায় আমি ছিলাম না। নিষ্পলকে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম ভীষণ শান্ত একটি মুখ, উপত্যকার মতো নির্বিকার এবং স্থির।

বললাম, বাড়ি যাচ্ছি।
কিছু সময় সে আর কোনো কথা বললো না। শুধু অতিক্রান্ত পথের শেষে একটি একটি করে মাইলস্টোন পার হয়ে যেতে দেখলাম।

আমার নাম ক্রিস্তভ। শহরের বাইরে গেছিলাম একটা কাজে। এ শহর দিনের বেলায় যত উদার রাতে ততটাই নির্মোহ।
চমকিত হয়েছিলাম তার কথায়। সৌন্দর্য আসলে একটি বিন্যাস, ভাবের পর ভাব শব্দের সাথে শব্দের বিন্যাস। সেদিন রাতে সম্ভবত সে তার শব্দের ছোঁয়ায় এমনই কিছু নির্মাণ করতে চেয়েছিল।

আপনাকে চিনি না... এত রাতে নির্বিকার ভাবে হেঁটে চলেছিলেন... মনে হলো আপনি খুব একা... সে বলে চলেছিল, দূরে দূরে যত আলো দেখছেন ওসব নক্ষত্রের চেয়েও বেশি দূর, যদি আপনি হেঁটে পৌঁছতে চান। বলেই ক্রিস্তভ খুব হাসতে লাগলো। দেখলাম তার নয়নতারা অবধি সে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে ফুলের পাপড়ির মতো।

এতরাতে একজন অপরিচিতর সাথে এভাবে পথ চলা, অথচ আমার ভয় করেনি এতটুকু, এমনই ছিল ক্রিস্তভের উপস্থিতি। আমি যেন আশ্বস্ত ছিলাম সে আমাকে ঠিক পৌঁছে দেবে। আমার একতরফা নীরবতা ভঙ্গের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বললাম, আমি বেহেস্তে থাকি। ক্যাব মাঝরাস্তায় ড্রপ করে গেছে।

ব্যাস এটুকুই। এর অধিক তার আর কিছুই জানার ছিল না বোধহয়। সে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো। আর আমি ফিরে গেলাম ফ্রিতি নদীর কাছে যেখানে পথের ধারে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম আমি।

জ্ঞান ফিরতেই যাকে দেখেছিলাম সে জুমেরান। তার গভীর দুটো চোখ আমার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। তার হাত আমার কপালে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কোথায়।

সে বললো, আমি তার ঘরে। ফ্রিতি নদীর কাছে কোথাও আমি পড়েছিলাম জ্ঞান হীন অবস্থায়। জুমেরান সে পথেই ফিরছিল। সে আমাকে দেখে চিনতে পারে। তুলে এনে রাখে তার ঘরে । শুশ্রূষা করে। ঘোরের ভেতর রাত কেটে ভোর হয়। ভোরের আলোয় আমি জেগে উঠি আমার ভয়ার্ত স্মৃতির ভেতর থেকে।

জুমেরানের হাত তখন আমার কপালে স্থির। তার দুচোখে মায়ার সরোবর। আমার ইচ্ছে করে তার ভেতর ডুবে যেতে। আমি ডুবে যাই। আমি চাই না এই ভোর শেষ হয়ে আবার সন্ধ্যা নামুক।

জুমেরান বলে, একটু সুস্থ হয়ে নাও। তোমায় ঘরে পৌঁছে দেব।
পাহাড়ের কোলে তার এক কামরার ঘর। ঘরের জানলা দিয়ে বুনো গন্ধ আসে।
সে বলে, তোমার গায়ে জ্বর।
আমি হাসি। জুমেরানকে বলি, আমার ঘরে কেউ নেই। মা নেই। মা ছোটবেলায় ছেড়ে গেছে অন্য পুরুষের সাথে।

বলে থামি। বলতে পারি না, এখানে তুমি আছ।
 সে সময়মতো আমার জ্বর মাপে। আমি তাকে ওনামের কথা বলি। বলি লোকটা কেমন করে আমার ওপর চড়ে বসেছিল। ওর জঘন্য লালসার কথা শুনে জুমেরানের চোখ ক্রোধে ভরে ওঠে। কোনো কথা না বলে ও জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বেলা গড়িয়ে গেলে জুমেরান বলে, এবার চলো, তোমায় পৌঁছে দেই।
 
বাবুজীর রেস্তরাঁ অবধি সে আমাকে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সে বোঝে না, পৃথিবীর সব জায়গা সব মেয়ের জন্য নিরাপদ নয়। আমি অসহায়ের মতো বাবুজীর কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তাকে বলি, মিস্টার ওনাম আমার সাথে কি আচরণ করেছে। কিন্তু আমার প্রত্যাশা মতোই সে নির্বিকার থাকে। তার চোখে মুখে বিস্ময় বা বিরক্তির লেশমাত্র নেই।

আমার স্থির বিশ্বাস হয়, এসব পূর্ব পরিকল্পিত। সে আমাকে জেনেবুঝেই ওই লম্পট অফিসারের কাছে পাঠিয়েছিল। হায় রে মেয়ে! আমি জানতাম, আমার মায়ের ওপরেও এমন অনেক অত্যাচার করেছে সে। জোর করে শুতে বাধ্য করেছে কোনো না কোনো সুযোগ নেবে বলে। সে পালিয়ে বেঁচেছে, কিন্তু নিজের মেয়েকে বাঁচাতে পারেনি।

এবার আমার পালা। অসহায় সমরে নিজের জন্মদাতার কাছেই পরাভূত হবো বলে দিন সময় গুনতে থাকি। আর অপেক্ষা করতে থাকি জুমেরানের।

কিছু কিছু অপেক্ষা জীবনে কোনো দিন শেষ হয় না ম্যাডাম। বিচক্ষণের কাজ আপনি আপনার গন্তব্য পরিবর্তন করুন। চমকে তাকাই ক্রিস্তভের দিকে। এই রাতের অজানা পথে কার সাথে দেখা হলো আমার! এ কি মন পড়তে পারে নাকি? আমার বিস্মিত পলকের রেশ কাটতে না কাটতেই সে বলে, যে আপনার অপেক্ষায় আছে তার বড় ক্ষতি হলো বোধহয় আজ।

হ্যাঁ, মানে...
এ পৃথিবীতে নতুন বলে কিছু নেই... এমন কোনো পথ নেই যা আসলে অচেনা... সব পথই আপনাকে একটি শাশ্বত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাবে... যদি সেই চিরসত্যকে জানেন তবে বুঝবেন প্রতিটি মানুষই আপনার চেনা... শুধু একে অপরের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়ে চলেছে মাত্র... এই পরিবর্তনকে আপনাকে মেনে নিতেই হবে।

এই এত রাতে বেহেস্তের পথে আচমকা যে মানুষটি আমাকে গাড়িতে লিফ্ট দিতে দুদণ্ড দাঁড়িয়েছিল সে জুমেরান ছিল না। সে ক্রিস্তভ। কিভাবে কেন তার পথ আর আমার পথ এক বিন্দুতে এসে মিলেছিল, তা আমার জানা নেই। কিন্তু তার প্রতিটি শব্দের যে অভিঘাত, যে নির্ভুল প্রয়োগ তাতে ক্রমাগত বিস্মিত না হয়ে পারছিলাম না। আশ্চর্যের বিষয়, সে যা বলছিল বিনা প্ররোচনায় তা আমার জীবনেরই কথা।

গাড়ি এসে দাঁড়ায় বেহেস্তের রাস্তায়। তখন বেশ রাত হয়েছে। আমি প্রায় তিন ঘণ্টা লেট। গাড়ি থেকে নামার আগে ক্রিস্তভ একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল। সে দৃষ্টিতে অদ্ভুত কিছু ছিল। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাতে সে বলেছিল, আবার দেখা হবে।

আবার দেখা হবে! কেন হবে? এ প্রশ্ন না করেই গাড়ি থেকে নেমে যাই আমি। কিছু কিছু প্রশ্ন জীবনে অমীমাংসিত থেকে যাওয়াই ভালো। আমি গাড়ি থেকে নেমে ক্রেজের দিকে ছুটছিলাম। গাড়িটি আমাকে ড্রপ করেও কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়েছিল। গাড়ির উইন্ডো দিয়ে ক্রিস্তভ আমাকেই দেখছিল। আমি একবারও পিছনে না ঘুরেও তা বুঝেছিলাম। চলবে