শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০২০

জুমেরান আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যায়, কিন্তু মাঝে মাঝেই আসে দেখা করতে। কখনো ট্রিপ থেকে ফেরার সময় ঝিমধরা সন্ধ্যাবেলা, কখনো অলস কর্মহীন দুপুরে। সাধারণত সে সময়গুলো আমি রেস্তরাঁর কাজে ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু তার আসার ইঙ্গিত পেলে কাজ ফেলে দৌড়তাম ফ্রিতি নদীর দিকে। আমার ছুটে যাওয়ার বিকেলগুলোয় পৃথিবীকে অকারণেই বড় আনন্দময় মনে হতো। পাহাড় ভাঙা পথ ক্লান্তিকর লাগতো না। বরং এক অনিবার্য গুনগুন মনের ভেতর ক্রমাগত বেজে চলতো। এর নাম প্রেম। আমি জুমেরানের প্রেমে পড়েছিলাম।

ফ্রিতি নদীর কাঠের ব্রিজে গা এলিয়ে সে অলসভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো। নিচে জলোচ্ছ্বাস আর ওপরে সুনিবিড় আকাশ। মধ্যখানে জুমেরান। আমি দাঁড়াতাম, যেন হাঁফ ধরেছে এমন ভঙ্গিমায়, আসলে দূর থেকে তাকে দেখবো বলে। ভালোবাসার মানুষকে দূ...র থেকে দেখার এক অন্য শিহরণ আছে। তাকে ছুঁতে পারার যে গৌরব, তা এ শিহরণ থেকে আলাদা। জুমেরান কি সেসব জানতো? সে কিছু দূরে আমাকে স্থির দেখে হেসে হাত নাড়তো। আমি আবার চলা শুরু করতাম তার কাছে পৌঁছবো বলে।

তারপর দুজন মিলে আমরা চলে যেতাম পাহাড়ঘেঁষা অরণ্যের কাছাকাছি। বুনো সবুজ গন্ধ, নানা বর্ণের ফুল, ঝরাপাতার ওপর আমাদের হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলার মর্মর— এসব মিলিয়ে আমরা হারিয়ে যেতাম অন্য এক জগতে। এমনই একদিন অরণ্যের প্রান্তে ঘন লাল ফুলের শোভা দেখবো বলে দাঁড়িয়ে পড়েছি। নির্নিমেষ দৃষ্টি কিছুটা ভ্রষ্ট হয়ে যেই পড়েছে জুমেরানের ওপর, দেখি সে আমার দিকে চেয়ে আছে। যেন আমিও এক ফুল। তারপর সময় বয়ে যায় সঘন প্রশ্বাসে। জুমেরানের হাত তখন ফুলের স্পর্শ নিতে ব্যস্ত, তার মদির গন্ধে উন্মত্ত। পাপড়ি দ্রুত অবিন্যস্ত হতে হতেও শাখা লগ্ন থাকতে উন্মুখ। ফুলের কপালে গালে ঠোঁটে তখন ভালোবাসার লোধ্র মাখামাখি, সামান্য দূরে তীক্ষ্ণ কেকা রবে ঘোর কাটে আমাদের। দেখেছিলাম পেখমে মেলে দাঁড়িয়ে আছে এক ময়ূর।

কখনো বা গিয়ে বসতাম ফ্রিতি নদীর ধারে কোনো সুবৃহৎ পাথরের খণ্ডের ওপর। এক মনে দেখতাম পাহাড়ি নদীর বয়ে চলা। পাথরে আঘাত লেগে বড় মরমী তরঙ্গগুলো আরও ক্ষিপ্রতার সাথে বয়ে যেত। মনে হতো, প্রেমও ওরকম। আঘাত পেলে সে আসলে শক্তি পায়, তার ভেতরের সমস্ত বিদ্যুৎ একত্র করে পাথর টপকে বয়ে চলার শক্তি।

জুমেরানকে বলেছিলাম, আমি শত বাধায় তোমার সাথে থাকতে চাই। আমাদের এই বয়ে চলা শাশ্বত হোক।
সে হেসেছিল। আমার কানের পাশের কুঞ্চিত চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, কিন্তু নদীও যে পথ পরিবর্তন করে মারিয়া। কখনো যদি আমাদের পথ আলাদাও হয়ে যায়, থেমো না। ভুলে যেও না যে, বয়ে চলাই তোমার ধর্ম। আমি থাকবো কোথাও না কোথাও। আমার জল তোমাতেই এসে মিশবে কোনো না কোনো খাতে।

কেন জানি না, তার উদাস চোখদুটি দেখলেই আমার ভয় হতো। যেন তার গন্তব্য বহু দূরে কোথাও। আমি তার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকতাম ফ্রিতি নদীর ধারে।

আমার অনুমান ঠিক প্রমাণিত হয় কিছুদিনের মধ্যেই। হঠাৎ এক দুপুরে মিস্টার ওনাম এসে উপস্থিত বাবুজীর রেস্তরাঁয়। আমাকে দেখেই তার চোখে খেলে গেল হায়নার হাসি। আমাকে বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ হওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাবুজী তার সমাদর করা শুরু করলো। চা ও ফ্রাই টেবিলে রেডি। মিস্টার ওনাম ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে বসলো। বাবুজীর সাথে অত্যন্ত চাপা স্বরে তার কথোপকথন চলছিল। কম্পানিতে মিস্টার ওনাম অনেক উচ্চপদে ছিল। তার সুবাদে কম্পানির স্টাফদের মিল সাপ্লাই দেয়ার কনট্র্যাক্ট পেত বাবুজী। গোপনে মদের কারবারও চলতো। প্রচুর লাভ। বাবুজীর ব্যবসা তরতরিয়ে এগোচ্ছিল। এমতাবস্থায় যে কোনো শর্ত রক্ষার জন্যই সে যে পিছপা হবে না, তা আমি জানতাম।

বাবুজী ইশারা করে আমাকে ডাকলো। আমি কিছুটা ইতস্তত করে তার কাছে যেতেই সে অদ্ভুত অমায়িকভাবে আমাকে ইতরটার পাশে বসতে বললো। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম, আপন সন্তানকেও বিক্রয় করতে প্রস্তুত, এও পিতা? আমার হৃদয় ফুঁসছিল। চোখ ভরে উঠছিল জলে। আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলাম রেস্তরাঁ থেকে। ছুটে চললাম ফ্রিতি নদীর দিকে।

একাই বসে রইলাম অনেকক্ষণ একটি পাথরের ওপর। আমার চোখে বাঁধভাঙা জল, জিভে তার নোনতা স্বাদ। সমস্ত পৃথিবী ঝাপসা লাগছিল। এ পৃথিবীতে তবে কোন স্থানটি আমার জন্য সুরক্ষিত? একটি প্রেমের জন্য নত সমর্পিত ভিক্ষুক আমি দেখছিলাম, জল কেমন করে বয়ে যায়। আমার ভেতর ওরকমই একটি পাহাড়ি নদী পাথরে পাথরে মাথা কুটে মরছিল।

তখন প্রায় সন্ধ্যা। দূরে পাহাড়ের কোলে একটি দুটি করে আলো জ্বলে উঠেছিল। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল ফ্রিতি নদীর কুলকুল বয়ে চলার শব্দে বুঁদ হয়ে বসেছিলাম। জুমেরান এসেছিল। আমার পাশে বসে আমার হাতদুটি তার হাতের ভেতর মুঠো করে ধরেছিল। আমার অশ্রুসিক্ত মুখ নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়েছিল। আমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শুষে নিচ্ছিল যাবতীয় ব্যথা... ভালোবাসা কত করুণ, সেদিন তা বুঝেছিলাম। চলবে