শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : অক্টোবর ৩০, ২০২০

ফ্রিতি নদীর বাঁধের জল নিয়ে কম্পানির সাথে নেটিভদের বিরোধিতা তুঙ্গে ওঠে। বাঁধের জলের সিংহভাগ কম্পানি তার নিজস্ব টানেলে চালিত করে। ফলে স্থানীয় মানুষের চাষবাসের কাজে তীব্র জলাভাব দেখা দেয়। এর প্রতিরোধের জন্য ভেতর ভেতর সংঘবদ্ধ হতে থাকে নেটিভরা। জুমেরান তাদের নেতৃত্ব দেয়, তাদের উদ্বুদ্ধ করে। বলে, ফ্রিতি এই প্রকৃতির সম্পদ। এই পাহাড় এই অরণ্যের মতোই ফ্রিতির জলে সবথেকে বেশি অধিকার আমাদের। মানুষ জলাভাবে মরতে বসবে আর কম্পানি পলিশি করে তাদের বঞ্চিত করে মুনাফা লুটবে, এ হতে দেয়া যায় না।

পাহাড়ে জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়ায় জুমেরান। ফ্রিতির প্রকৃতি ও তার যাবতীয় সম্পদের ঠিকানা তার নখদর্পণে। ট্যুরিস্টদের শুধু গন্তব্যে নিয়ে যাওয়াই তার কাজ নয়, প্রতিটি স্থানের ভৌগোলিক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত মাহাত্ম্যকে তুলে ধরাকেও সে তার ঐকান্তিক দায়িত্বের মতো পালন করে। সে বলে, আমি ফ্রিতির সন্তান। এ নদীর জল পান করে আমি বড় হয়েছি। ঝর্ণার জলে স্নান করে আমার উত্তপ্ত আত্মাকে শান্ত করেছি। একদিন এই পাহাড় তলেই আমার সমাধি হবে।

বাবুজীর রেস্তরাঁয় মিস্টার ওনামের আসা-যাওয়া চলতে থাকে। ওনাম আমাকে অশ্লীল দৃষ্টিতে দেখে। তার কানের কাটা দাগটা তখনও দগদগ করতে দেখি। বুঝি, ওর চেয়েও দগদগে ওর আত্মা আমাকে ছেনে বুঝে নিতে চায়। আমার শরীরের জন্য ও লোলুপ। বাবুজী নিজ স্বার্থে সেই লোভকে প্রশ্রয় দেয়। মাংসের বাটি আর মদ দিয়ে আমাকে এগিয়ে দেয় ওনামের দিকে। তার চোখ ইশারায় চকচক করে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমি এই লোকের সন্তান। ক্রমশ এই বিশ্বাস আমার দৃঢ় হতে থাকে যে, জুমেরানই আমার একমাত্র আশ্রয়। আমি মনে মনে তাকে, কেবলমাত্র তাকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরি।

সেদিন খুব বৃষ্টির একরাত। রেস্তরাঁ বন্ধ করে আমরা ঘরে ফিরেছি। ঘন অন্ধকারে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। কালো মেঘ উপদ্রুত সীমানায় তার যাবতীয় গরল ঢালতে ব্যস্ত। মুহুর্মুহু বজ্রপাতের শব্দে দিকদিগন্ত কেঁপে উঠছিল। এমন সময় দরজায় টোকা দিল কেউ। বাবুজী দরজা খুলে দাঁড়ালো। আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছি তার পিছনে। এই দুর্যোগের রাতে কে এলো? অন্ধকারে তাকে দেখা যায় না।

হঠাৎ কড়কড় করে বাজ পড়ার শব্দ। আকস্মিক বিদ্যুতের ঝলকে দরজায় দণ্ডায়মান যে মূর্তি দেখলাম তা মিস্টার ওনামের। আমার পায়ের নিচে মাটি যেন টলে গেল। বাবুজী তাকে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে দিয়ে নীরবে দরজা বন্ধ করলো। আমি পাগলের মতো ছুটে গেলাম নিজের ঘরে। দরজায় শিকল তোলার আগেই ওনাম লাথি মেরে দরজা খুলে দিল। আমি সেই চূড়ান্ত মুহূর্তে শেষ বারের মতো `বাবা` বলে কেঁদে উঠেছিলাম। নাহ্, কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো না। প্রচণ্ড বারিধারা আর ভারী হাওয়ার ধাক্কায় ঘরবাড়ি যেন কাঁপছিল। যেন ভূমি ফাঁক হয়ে যাবে যে কোনো মুহূর্তে আর আমরা প্রবিষ্ট হবো পাতালে।

ওনাম অন্ধকারে আমার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরলো। এক ঝটকায় আমাকে মেঝেতে ফেলে আমার ওপর চড়ে বসে আমার জামা কাপড় ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে লাগল। তার জিভ তার দাঁত আমার শরীরকে ছিঁড়ে তার স্বাদ নেবে বলে পাশবিক খেলায় মেতে উঠতে উন্মুখ, সেই মুহূর্তেও আমি আত্মরক্ষার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম। ওনাম আমার দুটি পা শক্ত করে ধরেছে, তার চরমতম কামের নিবৃত্তির ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় উন্মুখ, অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে হাত ঠেকলো একটা শক্ত ভারি কিছুতে। কোনো কিছু না ভেবেই সেটি তুলে নিয়ে আমি তার মাথায় আঘাত দিলাম সজোরে। ওনাম গঙিয়ে উঠলো একবার। তারপর মেঝেতে পড়ে গেল।

আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। অন্ধকারে অকালবর্ষণ উপেক্ষা করে আমার ঘর আমার এলাকা রেস্তরাঁ ফ্রিতি নদীর সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে ছুটতে লাগলাম। ঘন ঘন বজ্রপাত বিদ্দ্যুল্লেখায় এ পৃথিবী তখন কোনো পৈশাচিক অসূয়ায় আক্রান্ত হয়েছে যেন। অথচ আমার একমাত্র শক্তি ছিল আমার প্রেম। যে সেই ঘন অন্ধকারেও আমাকে বেঁচে থাকার আলো দেখিয়েছিল।

ছুটতে ছুটতে কত পথ পার করেছিলাম, জানি না। এসে থেমেছিলাম এক দরজায়। তখন অনেক রাত। দরজা খুলে জুমেরান দাঁড়িয়েছিল। সামান্য অপ্রস্তুত না হতে দিয়েই সে আমাকে গ্রহণ করেছিল। আক্রান্ত একাকী ক্লান্ত নিরাশ্রয় একটি মানুষকে সে আশ্রয় দিয়েছিল। বিধ্বস্ত আমি তার বুকে মাথা রেখেছিলাম। সে বুঝেছিল, এত রাতে দুর্যোগের ভেতর এসেছে যে ফিরে যাওয়ার তার আর কোনো পথ নেই... চলবে