শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৭

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৭, ২০২০

ফ্রিতি নদী, সুবিপুল অরণ্যরাজি, পাহাড়, নক্ষত্র, ময়ূর ও ময়ূরীকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করি আমি ও জুমেরান। হাজার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় নীল পাহাড়ের চূড়ায়। জঙ্গলের বুক চিরে উঠেছে পাথরের সিঁড়ি। হাত বাড়ালেই থরে থরে বুনো ফুল। আমি আর জুমেরান হাত ধরাধরি করে উঠি। আমার পরনে সাদা শাড়ি, চুলে গুচ্ছ ফুল। বুনো ফুলের রেণু ওড়ে বাতাসে। চারদিক কত শান্ত, মগ্ন! স্বর্গে সঙ্গীত বাজে। মেঘের রেকাবে আসে ভালোবাসার উপঢৌকন।

নীল পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এ মহাপৃথিবীকে এক স্বপ্ন বলে বোধ হয়। যেন এই মাত্র ঘুম ভেঙেছে আমার। ঘুমের ভেতর সারারাত একে অপরের মত্ততায় কেটেছে আমাদের। যেন এক নেশা। অনন্ত বিভ্রম। সেই বিভ্রমকে জাপটে ধরে সমুদ্র স্নান করেছি আমি। আমার শরীরে লেগে ছিটকে গেছে সফেন ঝিনুক। তরঙ্গের সাথে তরঙ্গ হয়ে মিশে আমার শরীরে তখন সমুদ্র গর্ভের সুগন্ধ। সেই অপরূপ খেলা থেকে জেগে উঠে হাত ধরাধরি করে আমি ও জুমেরান এসে দাঁড়িয়েছি নীল পাহাড়ের চূড়ায়।

জুমেরান আমাকে আলিঙ্গন করে। আমার খোঁপা থেকে খসে পড়ে ফুল। সে তার ঠোঁট রাখে আমার ঠৌঁটে। তার চুম্বন ক্রমশ গভীর হয়। সে লেহন করে শরীরের লাভাস্রোত। আমার হাত থেকে ঝরে যায় কাচের চুড়ি, ঝনঝন শব্দে ভাঙে। সে আমাকে বলে, তোমাকে আমি গ্রহণ করতে চাই। তুমি রাজি?

আমার দুচোখ হেসে ওঠে। খোঁপা খুলে অবলুণ্ঠিত হয় চুল। গাছেরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। নক্ষত্র খসে। ফ্রিতি নদীর জল এক পলকের জন্য গতি হারিয়ে টলটল করে ওঠে অশ্রু মোচনের ভারে। আমি ও জুমেরান এক হই।

পাহাড়ের কোলে জুমেরানের এক কামরার ছোট কাঠের বাড়িটি হয়ে ওঠে আমার আনন্দের সংসার, আমাদের উদযাপনের মহা প্রাঙ্গণ। সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে যায় জুমেরান। বাকসে করে তার খাবার গুছিয়ে দেই। তারপর লেগে পড়ি কাজে। প্রতিটি অনর্থক কাজ বড় আনন্দময় লাগে। যেন ক্লান্তি বলে কিছু নেই। কোথাও কোনো ধুলো জমতে দেই না। সমস্ত কাজের মাঝে তার ঘরে ফেরার অপেক্ষা করি। অপেক্ষা গভীর হলে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। সেখান থেকে অরণ্য দেখা যায়।

এই সামান্য জীবনটুকু কত মধুর হতে পারে, তা জানা হয়। মাধুর্য কেবল তার প্রেমে, মিলিত হতে চাওয়ায়, মিলনে। কিন্তু সেই মিলনাকাঙ্ক্ষাও যে বিরহ আর বিচ্ছেদের নৈপুণ্যে এক অসম্পূর্ণ রাগিণীর মমো বেজে চলেছে এ মহাজগতে, তা জানা হয় না। সন্ধ্যা হতে প্রদীপ জ্বালিয়ে তার অপেক্ষা করি। সে ফেরে। আমার জগৎ উদ্ভাসিত হয়।

তারপর সারারাত জেগে আমরা কল্পনা করি আমাদের সাথে অনন্ত আকাশের মধ্যখানের ব্যবধানটুকু সরে গেছে। বুনো গন্ধ নিতে নিতে ভাবি, কোথাও কোনো বাধা নেই। অগণিত নক্ষত্রের নিচে এই পৃথিবী আমাদের লীলাক্ষেত্র। এখানে কেউ নেই আমাদের বাধা দেয়ার। সেই উদ্দামতার মধ্যে জুমেরান আমার ভেতর প্রোথিত হয়। গভীর থেকে গভীরতর স্রোতের ভেতর তার প্রেমের ডিঙাটি শূন্য থেকে তরঙ্গ শীর্ষে ভেসে উঠে আবার ডুবে যায়।

তারপর একদিন সম্ভাবনাময় হয়ে উঠি আমি, অনাগত সন্তানভারে ন্যুব্জ। আমার ভেতর জন্ম নিয়েছে যে প্রাণ সে ক্রমশ বেড়ে ওঠে। সারারাত জুমেরান তার প্রাণের স্পন্দন খুঁজে বেড়ায়। বারবার কান পাতে। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একদিন রবাহুত হয়ে জেগে ওঠে সে। দ্যাখে, পাশে শুয়ে আছে অনাবিল ভবিষ্যৎ। আমাদের কন্যার নাম সে রাখে, মিশ্মি।

ফ্রিতি নদীর জল নিয়ে কম্পানির সাথে নেটিভদের লড়াই তুঙ্গে উঠেছে ততদিনে। নেটিভদের সংগঠিত করেছে জুমেরান। দিনের পর দিন তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেছে। লড়াইকে ঐক্যবদ্ধ করেছে গ্রামের মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরে। বারবার কম্পানির অফিসারদের সাথে মুখোমুখি আলাপ আলোচনায় আসার প্রস্তাব দেয় তারা। কিন্তু কম্পানি ঝুঁকতে নারাজ। জুমেরানের নাম তখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সে যেন মসিহা। কম্পানিও সে কথা জানে। তারা ভাবে, জুমেরানকে কিনে নিতে পারলেই গ্রামের মানুষের লড়াই শেষ।

একদিন সকাল বেলা কম্পানি এজেন্ট পাঠায় জুমেরানের খোঁজে। জুমেরান না থাকায় একটি চিঠি রেখে যায় আমার কাছে। বলে, জরুরি দরকার আছে। জুমেরান ফিরলে চিঠি তার হাতে দেই। দেখি, তার দুচোখে আগুন। সে চিঠিটা খুলে পড়ে। তারপর ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে যায় হনহন করে। চলবে