শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৮

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৪, ২০২০

গ্রামের মানুষকে উদ্দীপিত করে জুমেরান। কোনোভাবেই কম্পানির কাছে মাথা নত করবে না সে। কম্পানি তাকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে মোটা মাইনের চাকরি। সরে দাঁড়াতে হবে আন্দোলন থেকে। জুমেরান বলে, নদীর জল নিয়ে কোনো অন্যায় মেনে নেবে না ফ্রিতির মানুষ। এই নদীর জল তাদের জীবনরেখা। লড়াই চলছে, চলবে।

কম্পানির বাইরে ধর্ণায় বসে গোটা গ্রামের মানুষ। সে দৃশ্য ভোলার মতো নয়। সমবেত মানুষের ঢল দেখে ভয় পায় কম্পানির কর্মকর্তারা। জুমেরান গোটা দলের আগে দাঁড়ায়। ফ্রিতির মানুষের হয়ে কম্পানির সাথে মুখোমুখি কথা বলতে সে প্রস্তুত। দিন কেটে যায়। সন্ধ্যা নামে। কম্পানি জানায়, বাঁধের জলে পূর্ণ অধিকার কম্পানির, এই শর্তেই বাঁধ নির্মিত হয়েছে। সুতরাং পশ্চাৎপসরণের কোনো প্রশ্ন নেই। জুমেরান বলে, তবে আরও বড় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হবে গ্রামের মানুষ।

সেদিন রাতে বড় অস্থির লাগে জুমেরানকে। জানলার কাছে পায়চারি করে সে। চোখ রাখে অন্ধকার আকাশে। সে আকাশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সুবিপুল অরণ্য। তারপর এসে বসে বিছানায়। মিশ্মিকে কোলে তুলে নেয়। ঘুমন্ত মেয়ের মুখ তার কাঁধে। ছোট ছোট শ্বাস তার কাঁধে এসে লেগে। দেখি জুমেরানের চোখে জল। নদীর মতো তিরতির করে সেই জল নামে তার গাল বেয়ে। কিন্তু কেন এই অশ্রু? মায়াবন্ধনের আতিশয্যে? নাকি কোনো অজানা আশঙ্কায়? তার কাঁধে হাত রাখি আমি। দেখি তার দুটি চোখ নীরব, ঝড় ওঠার পূর্বেই খবর পেয়েছে যে বৃক্ষরাজি, তাদের মতো স্থির।

দুদিন পর জুমেরান কাজ থেকে সবেমাত্র ফিরেছে ঘরে। গ্রাম থেকে কেউ ছুটে এসে খবর দেয়, গ্রামে আগুন লেগেছে। ঘরবাড়ি জ্বলছে দাউদাউ। জুমেরান শোনা মাত্র ছুটে বেরিয়ে যায়। চৌকাঠে মেয়ে কোলে নিয়ে আমি বসে থাকি সারারাত। জুমেরান আর ফেরে না। রাত ফুরিয়ে সকাল হয়। ছুটতে ছুটতে গ্রামে যাই। দেখি বাড়িঘর পুড়ে ছাই। সেই মহাশ্মশানে তন্নতন্ন করে খুঁজি তাকে। জুমেরানকে কোথাও পাই না। ঘরে ফিরে তার অপেক্ষা করি। দিন যায় রাত কাটে, তার অপেক্ষা করি। কেবল অপেক্ষা করি। গ্রামের মানুষ দেখলেই তার কথা জিজ্ঞেস করি। কেউ কেউ বলে, জুমেরানকে শেষ দেখা গিয়েছিল ফ্রিতি নদীর ওপর কাঠের সেতু পার হতে। কোথায় যাচ্ছিল সে তবে? ফেরে না আর জুমেরান।

গ্রামের লোকের মুখে শুনি, গ্রামে আগুন দিয়েছে কোম্পানির লোক। কেউ বলে, একটি জ্বলন্ত গৃহে ঢুকতে দেখেছিল জুমেরানকে। তবে কি সে...? না, বিশ্বাস হয় না। পুড়ে যাওয়া শরীরগুলো সনাক্ত করার মতো অবস্থায় ছিল না। সেগুলো ফ্রিতি নদীতে ভাসিয়ে দেয় গ্রামের মানুষ। জুমেরান নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও সে আছে সন্তর্পণে। সময় হলেই আপন স্ত্রী সন্তানের কাছে ফিরবে সে। এই অপেক্ষা নিয়ে বাঁচি। মাঝে মাঝে মিশ্মি তার বাবার নাম ধরে কেঁদে ওঠে। তাকে বুকের দুধ দিয়ে শান্ত করি। এক একদিন অপেক্ষারও ক্লান্তি আসে। মিশ্মিকে বুকে ধরে ঘোরের মধ্যে কেটে যায় সেই দিনগুলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে আসে জুমেরান।

সে আমার শ্রান্ত মাথায় হাত রাখে। চুলের ভেতর বিলি কেটে বলে, তোমাকে বড় শাস্তি দিলাম। কিন্তু কি করবো বলো, অন্যায় মেনে নিতে পারলাম না যে। ফ্রিতি যে আমার মা। তার সাথে অন্যায় মেনে নেয়া যায়? আমি ঘোরের মধ্যে তাকে আলিঙ্গন করে বলি, বেশ করেছ। কিন্তু কবে ফিরবে বলো? কবে? একথা বলার সাথে সাথেই সে কেমন অস্পষ্ট হয়ে যায়। ঝাপসা হতে হতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, যেতে যেতে বলে, আসবো... ঠিক আসবো। ঘুম ভেঙে সারারাত জেগে থাকি তার ফেরার পথ চেয়ে। জুমেরান ফেরে না।

তারপর ধীরে ধীরে জীবনের প্রয়োজন অদম্য হয়ে ওঠে। ঘরে যা ছিল তা প্রায় শেষ। অভাব বড় বিষম বস্তু।  কিভাবে মেয়েকে বড় করবো, এই চিন্তা প্রবল হতে থাকে। অপেক্ষায় দিন কাটে না। বাঁচার জন্য খাবার চাই। ভাবি, বাবুজীর কাছে ফিরে যাব কিনা। মন সেই শর্তে সায় দেয় না। একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে রেস্তরাঁর দিকে যাই। ফ্রিতি নদীর সেতুর ওপারে তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে। আকাশে ডুবে যাওয়া দিনের রেখা জাজ্বল্যমান। সেতুর কাছে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। জুমেরানের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল ঠিক এইখানে। তার স্পর্শ লেগে আছে ফ্রিতির বাতাসে। দূরে দেখা যায় বাবুজীর রেস্তরাঁ। না, রেস্তরাঁ অবধি আর যাই না। ফিরে আসি। যে নিজের মেয়েকে বিক্রি করতে দ্বিধান্বিত হয়নি, তার কাছে হাত পাতার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। নিজের অতীতকে চিরতরে পিছনে ফেলে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকি। ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যায় ফ্রিতি নদীর, কাঠের সেতু, বাবুজীর রেস্তরাঁ।

নতুন করে শুরু করি ভাগ্যান্বেষণের চেষ্টা। একদিন বহুদূর এক শহরের সন্ধান পাই, স্বপ্নের শহর... বেহেস্ত। চলবে