শ্রেয়া চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘বেহেস্ত’

পর্ব ৯

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০২০

সেদিন আমার ডে অফ ছিল। মিশ্মিকে নিয়ে বেড়াতে যাই সমুদ্রের ধারে। সমুদ্র বেহেস্তের খানিক দূরে। এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে যেতে হয়। নির্জন সৈকতে বসে সমুদ্র দেখি আর ফ্রিতির কথা ভাবি। ভাবি জুমেরানের কথা। সেই শহরে ফেলে আসা জীবন স্বপ্নের মতো মনে হয়। কোনোদিন কি আর তাকে ছুঁতে পারব? সমুদ্রের নোনতা জল আমার চোখের ভেতর নিষ্ক্রমণের পথ খোঁজে।  একটু দূরে খেলা করে মিশ্মি।

এ সমুদ্র অথৈ, তবে তার ওপরটা শান্ত। ছোট ছোট ঢেউ এসে ভিজিয়ে দেয় পা। দূরে দেখা যায় ছোট ছোট বোট। মন চায়, একটি নৌকো নিয়ে ভেসে যেতে। ভাসতে ভাসতে সমুদ্র হয়তো নিয়ে ফেলবে কোন জলপ্রপাতের সামনে। উত্তুঙ্গ শিখরের ওপর থেকে আমার আর মিশ্মির ছোট বোট জলপ্রবাহে পাল্টি খেতে খেতে ডুবে যাবে অতলে। তারপর কোনো নদীর বালিয়াড়িতে কোনো এক উজ্জ্বল ভোরে আমাদের খুঁজে পাবে কোনো এক মানুষ।

এমন সব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশের ছায়া লেগে সমুদ্রের জল আরও থিতু আরও গভীর মনে হয়। মিশ্মিকে বলি, চল এবার ঘরে ফিরি। মিশ্মি বেলুন কেনার বায়না করে। ওকে বেলুন আর চকোলেট কিনে দিয়ে ফেরার গাড়ি ধরি।

ঘরে ফিরে কাজ সেরে একটু কফি নিয়ে বসেছি সবে। মিশ্মি নিজের খেলায় মত্ত। বেহেস্তের পথে পথে জ্বলে উঠেছে সন্ধ্যাবাতি। সেই বাতির আলোয় তাকে নিসর্গের মতো লাগে। হঠাৎ দরজায় বেল দেয় কেউ। এত রাতে কে? মনের ভেতর চাপা ভয় কাজ করে। একবার দুইবার তিনবার বেল বাজে। এ শহরে এত রাতে আমার ঘরে কে আসবে? কিছুটা ভয় ও দ্বন্দ্ব নিয়ে দরজা খুলে দেখি, আরে ক্রিস্তভ! আমার বিস্মিত ভাব দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বলে, অসময়ে এসে পড়লাম বোধহয়। আজ তবে যাই। আমি সহজ হয়ে বলি, আরে না না, আসুন।

ক্রিস্তভ ভেতরে আসে। তাকে সোফায় বসতে বলে কফি করে আনি। কিন্তু মনে মনে সন্দেহ যায় না। সেদিন রাতে আমাকে ক্রেজের সামনে নামিয়েছিল ক্রিস্তভ। তবে সে আমার বাড়ি চিনলো কি করে? আর এত রাতে কেনই বা এসেছে? হৃদয়ের কথা যে সে শুনে নিতে পারে তার পরিচয় আগের দিনই পেয়েছিলাম। নীরবতা ভঙ্গ করে সে বলে, আমি যে আপনাকে অনুসরণ করেছি তার জন্য মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। আসলে আগের দিন আপনাকে ক্রেজের সামনে নামিয়ে ভাবলাম এতরাতে মেয়েকে নিয়ে ফিরতে যদি কোনো বিপদের সম্মুখীন হন। তাই পেছন পেছন আপনার বাড়ি অবধি এসেছিলাম। আজ এদিকে এসেছিলাম একটা কাজে। তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। জানি, খুবই বিব্রত করে ফেলেছি...

নাহ্, বিব্রত হইনি। তবে একটু অবাক হয়েছিলাম এ সত্য।  তবে সব জেনে ভালো লাগছে। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনি আমাদের জন্য এত ভেবেছেন... আমি বলি।

হা হা করে হেসে ওঠে ক্রিস্তভ।  তারপর বলে, না-না, কোনো পরোপকার বা সৌজন্য নয়। কেন জানি না, কিছু কিছু মানুষকে দেখে মনে হয়, তাদের সাথে দেখা হওয়াটা নেহাত কাকতালীয় নয়। আপনিও তেমন একজন।

আমি তার কথার কি জবাব দেব, ভেবে উঠতে না পেরে নীরব হয়ে দেখি। ক্রিস্তভের চোখ দুটি গভীর, চেহারায় সৌম্যভাব আর এক অদ্ভুত ঔদাসীন্য।  সে বলে, কেন জানি না মনে হয় আমি আপনাকে চিনি, যেন বহুদিনের পরিচয়। অথচ দেখুন আপনার বাড়ির ঠিকানা অবধি অজানা ছিল...

এই অবধি বলে সে থামে। কফিতে সিপ নেয় ধীরে ধীরে। যেন এবার কিছু শোনার প্রতীক্ষা। অথচ সে প্রতীক্ষা বড় শান্ত। কোনো উচাটন নেই। আমি বলি, আমার নামটাই বোধহয় বলা হয়নি আপনাকে। আমি মারিয়া। বেহেস্ত আমার কাছে নতুন। আমি ফ্রিতির মেয়ে।

ক্রিস্তভ কফির কাপটা নিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ তার সুদূরে। বলে, নাম বা ঠিকানা জানলে যা জানা হয় তা আসলে সামান্য। একদিন শুনবো ফ্রিতির কথা। এরই মধ্যে মিশ্মি এসে দাঁড়িয়েছে। অবাক দৃষ্টিতে সে দেখে ক্রিস্তভকে। ক্রিস্তভ তার মাথায় হাত রাখে। পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে তার হাতে দেয়। তারপর বলে, আজ আসি। যদি অনুমতি দেন আবার আসবো।

তার চোখ আমার চোখের ভেতর পরিচিত শব্দের ছোঁয়া খোঁজে, সাড়া পেয়ে বা না পেয়ে সে ডুবে যায়। ক্রিস্তভ যেতে দরজা বন্ধ করে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। তাকে মিলিয়ে যেতে দেখি দূরে। আমার এই অনুভূতি আনন্দের না বিস্ময়ের না বেদনার, তা বুঝি না। হঠাৎ ফ্রিতির কথা মনে পড়ে যায়।  বুকটা হু হু করে ওঠে। মিশ্মি এসে আলতো করে তার মাথা রাখে আমার বুকে, যেন আমার বুকের ভেতর কোনো নদীর বয়ে চলার শব্দ সে শোনে। অনেকখানি সময় এভাবে থাকার পর বলে, মা, বাবা কবে ফিরবে তুমি জানো? আমি তাকে আরও গভীর করে জড়িয়ে ধরি। চলবে